19.3 C
New York
Saturday, July 27, 2024
Home Blog

মনীষার ঝুলিতে ২৬টি গোল্ড মেডেল

0

এ যেন কোনো এক জাদুকরের কাঁধে ঝোলানো জাদুর থলে। ভেতরে হাত দিতেই অবিরাম মণিমুক্তা বেরিয়ে আসতেই থাকে। নাহ, আজ আমি কোনো রূপকথার গল্প শোনাতে আসিনি। তবে যা বলতে চাইছি সেটিও শুনতে রূপকথার মতোই শোনাবে। যদি দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থীর স্কুলব্যাগ হাতে নেন তা হলে সেখান থেকে কী বের হতে পারে? কিছু বই, খাতা, পেনসিল আর খেলার সামগ্রী। তার মধ্যে নিশ্চয়ই স্বর্ণ রৌপ্য কিছু থাকবে না। তবে আজ যার কথা বলব তার ব্যাগের মধ্যে শুধু বই-খাতা আর পেনসিল না সত্যি সত্যিই স্বর্ণ রৌপ্যে ভরা। টেবিলের ওপর থেকে ছোট্ট ব্যাগটা এনে সে যখন মেলে ধরল, তখন যেন জাদুকরের জাদুর থলের মতো সেই ব্যাগ থেকে এক এক করে ২৬টি গোল্ড মেডেল বেরিয়ে এল! এগুলো কি সে কুড়িয়ে পেয়েছে? তার কাছে কি আলাদিনের চেরাগের দৈত্য আছে যে তাকে এগুলো এনে দিয়েছে? নাহ, এর সবই সে অর্জন করেছে। ওর নাম মনীষা শংকর পাল। বাড়ি কক্সবাজার পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের আইবিপি মাঠ সড়কে। মনীষা পড়ছে কক্সবাজার সরকারি সেন্ট্রাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে। তার বাবা উদয় শংকর পাল কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর। মা জয়শ্রী নন্দী গৃহিণী। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট মনীষা।

দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া মনীষা কীভাবে ২৬টি স্বর্ণপদকের মালিক হলো? সে এগুলো দেশে বিদেশে গিয়ে প্রতিযোগিতা করে জিতে নিয়েছে। তাও কিন্তু যে সে প্রতিযোগিতা নয় বরং কারাতে প্রতিযোগিতা! মনীষা তাই দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়লেও বুক ফুলিয়ে হাবীবুর রহমান রচিত বিখ্যাত সেই কবিতার লাইন বলতে পারে ‘আমি কি আর কাউকে ডরাই? ভাঙতে পারি লোহার কড়াই’। মনীষাকে যদি প্রশ্ন করা হয় তুমি তো কারাতে জান। তোমার বন্ধুরা নিশ্চয়ই তোমাকে ভয় পায়? সে তখন মুচকি হেসে বলে- বন্ধুদের তো আর আমি মারব না। তা হলে ওরা আমাকে ভয় পাবে কেন? ওরা বরং আমার সঙ্গে ঘুরতে ভালোবাসে। ওরা মনে করে আমি সঙ্গে থাকলে ওদের কোনো ভয় নেই। আর তা ছাড়া কারাতে মূলত আত্মরক্ষার জন্য। মনীষাকে যদি প্রশ্ন করা হয় তুমি কি ব্রুস লি, জ্যাকি চ্যান এদের নাম জান? সে মাথা দুলিয়ে বলবে সে এদের নাম জানে না। নাম না জানলেও তাদের সেই বিদ্যায় খুবই পারদর্শিতা অর্জন করেছে।

মনীষার বয়স এখন ১০ বছর। ১০ বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে, বেশ লাজুক স্বভাবের। ঠিকমতো গুছিয়ে কথাও বলতে পারে না। কিন্তু তার পড়ার টেবিলটা ভরে গেছে স্বর্ণপদকে। যার মধ্যে ছয়টি আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক এবং বাকি ২০টি দেশ-বিদেশের। আছে জাতীয় পর্যায়ে প্রথম, দ্বিতীয় হওয়ার আরও ছয়টি রৌপ্য ও ব্রোঞ্জপদক। আত্মরক্ষার কঠিন কৌশল কারাতে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে এসব পদক অর্জন করেছে সে।

মাত্র চার বছর বয়সে মনীষা কারাতে শেখা শুরু করেছিল। বাবা কারাতে প্রশিক্ষক হওয়ায় প্রথম দুই বছর সে কারাতের প্রশিক্ষণ নিয়েছে বাসায়। পরের তিন বছর কক্সবাজার সদরে অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়ামের দ্বিতীয় তলার হলরুমে আরও অনেকের সঙ্গে সে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে সে প্রশিক্ষণ নিয়েছে শহরের আবু সেন্টারের ইউনাইটেড কারাতে ক্লাব বাংলাদেশে। এখানে তার সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেয় দেড় শতাধিক শিশু। এর মধ্যে মেয়ে ৮০ জন। সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার প্রশিক্ষণ চলে। স্কুলের পড়া শেষ করে সে নিয়মিত কারাতে অনুশীলন করে। প্রতিনিয়ত সে নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

ছয় বছরের প্রশিক্ষণে মনীষার অর্জন ঈর্ষণীয়। ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীদের হারিয়ে সে ছয়টি স্বর্ণপদক জিতেছে।

মনীষার বাবা উদয় শংকর পালই তার প্রশিক্ষক। বাবা প্রশিক্ষক হওয়ায় খুব ছোটবেলা থেকেই মনীষা মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে প্রশিক্ষণকেন্দ্রে যাওয়া আসা করত। অন্য ছেলেমেয়েদের কারাতে শিখতে দেখে মনীষারও ইচ্ছা জাগে শেখার। বাবাকে বলে বাবা আমিও শিখতে চাই। মেয়ের এমন আবদারে তিনি না করেননি। কারাতে প্রশিক্ষণে মোট ২৬টি কাতা বা শেডো ফাইট বা ধাপ থাকে। মাত্র দুই বছরের মাথায় মনীষা রপ্ত করে নেয় ১৬টি কাতা। প্রশিক্ষকদের মতে যা ১৬-১৭ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের পক্ষেও অনেক সময় সম্ভব হয় না। পাশাপাশি ব্ল্যাক বেল্টের জন্য ১০টি ডান থাকে। মনীষা ইতোমধ্যে দ্বিতীয় ডান সম্পন্ন করেছে। অদম্য ইচ্ছেশক্তি থাকলে যে অনেক কিছুই সম্ভব মনীষা নিজেই তার অনন্য নজির স্থাপন করে চলেছে।


আগামী ২৬ থেকে ২৮ জুলাই ভারতের কলকাতায় নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে ইন্টারন্যাশনাল কারাতে প্রতিযোগিতা ২০২৪। সেখানে বাংলাদেশ দলের হয়ে অংশ নিচ্ছে ব্ল্যাক বেল্টধারী মনীষাও। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীদের সঙ্গে লড়বে সে। যার ঝুলিতে ২৬টি স্বর্ণ পদক শোভা পাচ্ছে সেই মনীষা এবারও যে সফল হবে তা আমরা আশা করতেই পারি। আর মনীষার প্রতিটি সাফল্য যে বাংলাদেশেরই সাফল্য সেটা বলাই বাহুল্য। মনীষা ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কারাতে প্রতিযোগিতা ২০২০’-এ একক কারাতে (কাতা মহিলা) বিভাগে অংশ নেয়। সেই প্রতিযোগিতায় মোট ৯ জন প্রতিযোগী ছিল। তখন মনীষার বয়স মাত্র ৬ বছর! তার বিপরীতে অন্য প্রতিযোগীদের বয়স ছিল ১৬ থেকে ১৭ বছর! এত বড় মানুষ দেখে ভয়ে যে কেউ মুষড়ে পড়তে পারে, নাম তুলে নিতে পারে। কিন্তু মনীষা একটুও ভয় পায়নি। নিজের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। দূরন্ত সাহসী মনীষা নিজের আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে সেবার সেই প্রতিযোগিতায় ষষ্ঠ হয়েছিল। তখনই ধারণা করা হচ্ছিল ছোট্ট মনীষা একদিন অনেক নাম করবে। ওই বছরই সে চট্টগ্রামে ‘শাহজাদা চ্যালেঞ্জ কাপ ২০২০’-এ দুটি বিভাগে (জুনিয়র গার্লস কাতা ও কুমি) অংশ নেয়। উভয় বিভাগে প্রতিযোগী ছিল ১৫ জন করে। সবাইকে পেছনে ফেলে দুই বিভাগেই চ্যাম্পিয়ন হয় মনীষা। এরপর শুধু তার এগিয়ে যাওয়ার গল্প। সর্বশেষ গত ২৫ জানুয়ারি কক্সবাজার সৈকতের লাবণী পয়েন্টে অনুষ্ঠিত বিচ ফ্রেন্ডশিপ কারাতে প্রতিযোগিতা ২০২৪-এ মেয়ের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয় সে।

আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎকে আমরা যেভাবে নির্মাণ করতে চাইব সেটি আসলে সেভাবেই হবে। শিশুরা হলো নরম কাদামাটির মতো। তাকে আমরা যে শেপ দিতে চাই সেটা সেই শেপে গড়ে ওঠে। একটি চারাগাছকে আপনি যত ভালোভাবে যত্ন নিবেন সেই গাছ থেকে তত ভালো ফল পাবেন এটা আশা করাই যায়। আমাদের শিশু কিশোর কিশোরীদের আমরা যেভাবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করব তারাও সেভাবেই গড়ে উঠবে। ওদের মধ্যে বড় হওয়ার স্বপ্ন বুনে দিতে হবে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে যা করণীয় তা তাদের করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই কেবল তারা সফল হবে। মনীষা নামের ছোট্ট কিশোরী তারই বাস্তব উদাহরণ।

মনীষার স্বপ্ন কারাতেতে বিশ্ব জয়ের মাধ্যমে দেশের সম্মান বৃদ্ধি করবে। একদিন অলিম্পিকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে সে প্রতিনিধিত্ব করবে এবং স্বর্ণপদক জয়ের মাধ্যমে দেশের সম্মান বৃদ্ধি করবে।

লেখাটি দৈনিক খবরের কাগজে প্রকাশিত।

৪০ কোটি শিশু বাড়িতেই নির্যাতনের শিকার

0
Child abuse. Father yelling at his daughter. Shadow of man on wall

বিশ্বে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪০ কোটি শিশুকে বাড়িতে নিয়ন্ত্রণে রাখতে মারধর ও অপমানের মতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ গতকাল সোমবার বলেছে, এই সংখ্যাটি বিশ্বব্যাপী পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৬০ শতাংশ।

ইউনিসেফ ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১০০টি দেশের তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছে, ওই শিশুদের ঘরে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ‘শারীরিক শাস্তি’ ও ‘মানসিক পীড়ন’ দুটোই করা হয়।

ইউনিসেফের কাছে মানসিক পীড়নের মধ্যে তাদের ‘বোকা’ বা ‘অলস’ বলার মতো শব্দ অন্তর্ভুক্ত। আর শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে শিশুকে ঝাঁকুনি দেওয়া, আঘাত করা, থাপ্পড় দেওয়া বা আঘাত ছাড়াই শারীরিক ব্যথা বা অস্বস্তি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে যেকোনো কাজ অন্তর্ভুক্ত।

ইউনিসেফ বলছে, এই প্রায় ৪০ কোটি শিশুর মধ্যে প্রায় ৩৩ কোটি শিশু শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে অনেক দেশ শিশুদের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করলেও বিশ্বের পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৫০ কোটি শিশু এই ধরনের অনুশীলনের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে সুরক্ষিত নয়।

ইউনিসেফের তথ্যমতে, প্রতি চারজনের মধ্যে একাধিক মা বা দায়ী প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের সন্তানকে সঠিকভাবে শিক্ষিত করার জন্য শারীরিক শাস্তির প্রয়োজন আছে।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথেরিন রাসেল এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘যখন শিশুরা বাড়িতে শারীরিক বা মৌখিক নির্যাতনের শিকার হয়, অথবা যখন তারা প্রিয়জনের কাছ থেকে সামাজিক ও মানসিক যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়, তখন তা তাদের আত্মমর্যাদা ও বিকাশের বোধকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।’

ক্যাথেরিন রাসেল বলেন, যত্ন ও আনন্দদায়ক অভিভাবকত্ব শিশুদের নিরাপদ বোধ করতে, শিখতে, দক্ষতা তৈরি করতে এবং তাদের চারপাশ সম্পর্কে জানতে সহায়তা করতে পারে।

আজ ১১ জুন মঙ্গলবার বিশ্বে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক খেলাধুলা দিবস পালিত হচ্ছে। আর এ উপলক্ষে প্রথমবারের মতো ইউনিসেফও শিশুদের খেলাধুলার সুবিধা সম্পর্কে এই ফলাফল প্রকাশ করেছে।

৮৫টি দেশের তথ্য অনুসারে, চার বছর বয়সী প্রতি দুজন শিশুর মধ্যে একজন বাড়িতে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে খেলতে পারে না এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি আটজনের মধ্যে একজনের কাছে কোনো খেলনা নেই। দুই থেকে চার বছর বয়সী প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু বাড়িতে যথেষ্ট উদ্দীপনা বা অর্থপূর্ণ মিথস্ক্রিয়া পায় না।

ইউনিসেফ বলছে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজনের পড়া, গল্প বলা, গান গাওয়া ও ছবি আঁকার মতো বিষয়, সামাজিক এবং মানসিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ কাজের কোনো সুযোগ নেই।

ক্যাথেরিন রাসেল বলেন, ‘প্রথম আন্তর্জাতিক খেলাধুলা দিবসে শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে এবং ইতিবাচক লালন-পালন এবং আনন্দপূর্ণ যত্ন নেওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং পুনরায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।’

ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম

0

দেশে কোনোভাবেই শিশুশ্রম বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ হচ্ছে না। সরকার বিভিন্ন সময় শিশুশ্রম বন্ধে নানা প্রকল্প নিয়েছে, গত ১২ বছরে ৩৫২ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। অথচ খোদ সরকারি জরিপ বলছে, নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও গত এক দশকে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমেনি, উল্টো বেড়েছে। এরই মধ্যে সরকার নতুন করে আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিচ্ছে।

সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে শিশুশ্রমমুক্ত করতে চায়। এ জন্য ২০২১ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এ পরিকল্পনার আওতায় দুই উপায়ে শিশুশ্রম নিরসন করতে চায়। এর একটি হচ্ছে খাতভিত্তিক শিশুশ্রম নিরসন, অন্যটি হচ্ছে এলাকাভিত্তিক। কিন্তু গত তিন বছরে কোথাও এই উদ্যোগ কার্যকর করা হয়নি।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ঝুঁকিমুক্ত কাজের মাধ্যমে আয়ের পথ করে দিতে ২০১৮ সালে ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন (চতুর্থ পর্যায়)’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পের আওতায় ১ লাখ শিশুকে ৯টি বিষয়ের ওপর ছয় মাসের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং চার মাসের দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে এ প্রকল্পে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। ফলে এসব শিশুকে ঝুঁকিমুক্ত কাজে ফেরানো যায়নি।

এর আগে ২০১২ সালে ৬৮ কোটি টাকার ‘বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন (তৃতীয় পর্যায়)’ নামে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। ওই প্রকল্পে ৫০ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে ফিরিয়ে আনতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।

তারও আগে শিশুশ্রম নিরসনে ২০০২-০৯ সাল পর্যন্ত দুই ধাপে ৪০ হাজার শিশুকে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাসহ দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

এ অবস্থায় সরকার নতুন করে শিশুশ্রম নিরসনে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প নিচ্ছে। তবে প্রকল্পটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের

 ঢাকা জেলার উপমহাপরিদর্শক এ কে এম সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শিশুশ্রম নিরসনে সরকার বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। এসব প্রকল্পে কারিগরি ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ থাকবে। প্রকল্পগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে শিশুশ্রম নিরসন সম্ভব হবে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা না গেলে এতেও সুফল মিলবে না। কারণ, আগের প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না করায় সরকারের কোনো কর্মসূচি তেমন কাজে আসেনি।

সর্বশেষ গত মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ–২০২২–এ বলা হয়েছে, এক দশকে দেশে শিশুশ্রমিক বেড়েছে প্রায় এক লাখ। দেশে এখন ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ শিশুশ্রমিক আছে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯। আবার এদের প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে।

ইনসিডিন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম মাসুদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে প্রান্তিক শিশুদের নিয়ে চালানো নানা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অনেক শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে। তা ছাড়া অর্থনৈতিক মন্দার বিরূপ প্রভাবের কারণে অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তান শ্রমে নিয়োজিত হয়েছে। এতে শিশুশ্রমিক বেড়েছে।

২৪ এপ্রিল

 ঢাকার কেরানীগঞ্জের জিনজিরার তাওয়াপট্টি এলাকায় গিয়ে একটি অ্যালুমিনিয়ামজাত পণ্যের কারখানায় কাজ করতে দেখা যায় ১৪ বছর বয়সী রমজানকে (ছদ্মনাম)। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে সবার বড়। বাবা রিকশাচালক, মা গৃহিণী। কারখানায় সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সে কাজ করে। মাসে বেতন ৭ হাজার টাকা। তার বাবা জোর করে তাকে কাজে পাঠিয়েছেন।

রমজানের সঙ্গে একই কারখানায় আরও তিন শিশুকে কাজ করতে দেখা যায়।

তাওয়াপট্টি ও আশপাশের এলাকায় এক হাজারের বেশি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় পাঁচ শতাধিক শিশু কাজ করছে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দুই বছর আগে ৪৩টি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তার প্রথমেই রয়েছে অ্যালুমিনিয়াম ও অ্যালুমিনিয়ামজাত পণ্য তৈরির কাজ। অ্যালুমিনিয়ামজাত পণ্যের কারখানায় কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিউমোনিয়া, কাশি, রক্তকাশি, আঙুলে দাদ (একজিমা), আঙুলে গ্যাংগ্রিনসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের তেলঘাট থেকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ধরে চর মীরেরবাগ পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ডকইয়ার্ড। এসব ডকইয়ার্ডকে কেন্দ্র করে এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য ওয়ার্কশপ। এসব ডকইয়ার্ড ও ওয়ার্কশপে শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে।

তেলঘাট এলাকার ১২ শিশুশ্রমিক, চারটি ওয়ার্কশপের মালিক এবং আট শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেন, এলাকার শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরানোর বিষয়ে সরকারি কোনো উদ্যোগের কথা তাঁরা জানেন না।

তাওয়াপট্টি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি আকতার জিলানি দাবি করেন, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরিয়ে নিতে সরকার কখনো কোনো উদ্যোগ নিয়েছে, এমন তথ্য তিনি জানেন না।

এক খাত থেকে অন্য খাতে স্থানান্তর

তেলঘাট এলাকার একটি ডকইয়ার্ডে উত্তপ্ত চিমনির মুখে মবিল ঢালছিল ১৬ বছর বয়সী শিশু আরিফ (ছদ্মনাম)। আরিফ জানায়, সে দেড় বছর ধরে ডকইয়ার্ডে কাজ করছে। এর আগে স্থানীয় একটি পোশাক কারখানায় তিন বছর কাজ করেছিল। পারিবারের আর্থিক টানাপোড়েনে বাধ্য হয়ে সে ডকইয়ার্ডে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে।

আরিফের মতো অনেক শিশুশ্রমিক এক খাত থেকে অন্য খাতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নজরদারির কারণে ওই খাতের শিশুশ্রমিকেরা অপ্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন খাতে স্থানান্তরিত হয়।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের  ঢাকা জেলার উপমহাপরিদর্শক এ কে এম সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শিশুশ্রমিক নিয়োগ দেয়, এমন প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময় নোটিশ বা মামলা দিয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়। কিন্তু এতে শিশুশ্রম নিরসন হচ্ছে না। এক খাতের শিশুশ্রমিক অন্য খাতে চলে যাচ্ছে। শিশুশ্রম স্থায়ীভাবে নিরসন করতে হলে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

নীতিমালা কার্যকর হয়নি, সুফল নিয়ে শঙ্কা

জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০-এ বলা হয়েছে, শিশুশ্রমের প্রথম ও প্রধান কারণ অর্থনৈতিক দুরবস্থা। দ্বিতীয়ত, কোনো দরিদ্র পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষের মৃত্যু হলে শিশুর ভরণপোষণই দায় হয়ে পড়ে। তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো শহরে এসে চরম দারিদ্র্যের মুখে পড়ে।

এসব কারণে দরিদ্র পরিবারের পক্ষে ভরণপোষণ মিটিয়ে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালানো সম্ভব হয় না। তাই পরিবার বাধ্য হয়ে শিশুকে শ্রমে নিয়োজিত করে।

এসব পরিবারের শিশুদের শ্রম থেকে প্রত্যাহার ও দারিদ্র্যের চক্র থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে মা–বাবাকে আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে সম্পৃক্ত করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের বিশেষ বিবেচনায় আনা, শিশুশ্রম নিরসনে আইন প্রণয়ন, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন করাই এই নীতিমালার উদ্দেশ্য। তবে নীতিমালা প্রণয়নের ১৪ বছর পরও সেটি কার্যকর করা যায়নি।

অর্থাভাবে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যাচ্ছে না

বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশন ২০২২ সালে কেরানীগঞ্জে শিশুশ্রমিকদের নিয়ে একটি জরিপ চালিয়েছিল। এতে দেখা যায়, ওই এলাকায় ১৫ হাজার শিশুশ্রমিক বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। জরিপের উদ্দেশ্য ছিল, শিশুদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। তবে অর্থাভাবে এসব শিশুকে শ্রম থেকে সরিয়ে আনা যায়নি।

বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জেড এম কামরুল আনাম প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের পুনর্বাসন করতে জরিপে শিশুশ্রমিকের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু পুনর্বাসনে অর্থ লাগবে। সরকার বলেছে, নতুন প্রকল্পে পুনর্বাসনের বিষয়টি রাখা হবে। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

শিক্ষকের বেতের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর চোখ

0

শিক্ষিকার বেতের আঘাতে চোখে আঘাত পেয়ে শয্যাশায়ী শিশু মোহাম্মদ আয়াতুল ইসলাম।

‘মাদ্রাসায় বেত দিয়ে ম্যাডাম আমাকে মেরেছে। বেতটা বাঁ চোখে লেগেছে। এরপর অনেক ব্যথা শুরু হয়। এখন চোখে দেখছি না। আমি পড়তে চাই, আমার চোখ লাগবে।’ মায়ের কোলে বসে এসব কথা বলছিল সদ্য মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া সাত বছরের শিশু মোহাম্মদ আয়াতুল ইসলাম। সে প্রশ্ন করছিল, ‘মা, আমি কি আর চোখে দেখব না?’ এ প্রশ্ন শুনে মায়ের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল বেদনার জল। কোনো উত্তর দিতে পারছিলেন না মা স্বপ্না আক্তার।

বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে আয়াতুলদের বাড়ি। কিছুদিন আগেও বাড়ি মাথায় তুলে রাখা ছেলেটা এখন নিস্তেজ, চোখের যন্ত্রণায় কাতর। তার সে উচ্ছলতা এখন থেমে গেছে। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। রাতে-দিনে ঘুমাতে পারছে না। কেন এমন হলো, তা জানতে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে ছেলেকে উপজেলার জোটপুকুরপাড় এলাকার বাগে সিরিকোট তাহফিজুল কোরআন আইডিয়াল মাদ্রাসায় হেফজ বিভাগে ভর্তি করেন বাবা মো. সাজ্জাদ হোসেন ও মা স্বপ্না আক্তার। তাঁরা জানান, সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। শুরুতে বাসা থেকে মাদ্রাসায় ছেলেকে আনা–নেওয়া করতেন। এরপর কয়েক মাস ধরে মাদ্রাসায় থাকছে ছেলেটা। গত ২৬ মে পড়া না পারার কারণে ছেলেকে বেদম মার দেন মাদ্রাসার শিক্ষিকা। বাঁ চোখে বেতের আঘাত লাগে। কিন্তু এ ঘটনা তাঁরা জেনেছেন আরও পরে।

মো. সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৮ মে নাশতা নিয়ে ছেলেকে দেখতে যান তাঁরা। তখন মাদ্রাসা থেকে বলা হয়, আয়াতুলের চোখে রক্ত উঠে লাল হয়ে গেছে। তাই দেখা করা যাবে না। এরপর তাঁরা চলে আসেন। পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে হঠাৎ বাড়িতে এসে হাজির হয় ছেলে। তারপর ঘটনা জানাজানি হয়।

সাজ্জাদ বলেন, ভোরে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. মহিউদ্দিন মাহমুদ বাসায় হাজির হন। ছেলের জ্বর উঠেছে, এ কথা বলে দ্রুত বের হয়ে যান। এরপর ছেলে জানায়, পড়া না পারার কারণে তাকে মারধর করা হয়। চোখে ড্রপ দেওয়া হয়। এমনকি মারধরের বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য ভয়ও দেখানো হয়েছে। পরে ছেলেকে নিয়ে মাদ্রাসায় গেলে অধ্যক্ষ বলেন, ছেলের চোখে রক্ত উঠেছিল। ড্রপ দেওয়া হয়েছে। মারধর করা হয়নি।

বাড়িতে আসার পর শুরু হয় আয়াতুলের চিকিৎসার তোড়জোড়। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী চক্ষু হাসপাতালে চোখে সার্জারি হয়। পাশাপাশি দেখানো হয় একাধিক চিকিৎসক। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে সাজ্জাদ বলেন, ছেলের বাঁ চোখে দুটি সার্জারি হয়। বর্তমানে সে চোখে দেখছে না। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বাঁ চোখে দেখতে পারবে না সে। এটি ফেলে দিতে হবে।

মো. সাজ্জাদ হোসেন স্থানীয় একটি প্রসাধনী বিক্রির দোকানে চাকরি করেন। বেতন পান সাকল্যে ৯ হাজার টাকা। তিনি জানান, ছেলের চিকিৎসার জন্য ইতিমধ্যে ৬০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে। জমানো টাকা ভেঙে খরচ করেছেন। এখন আর হাতে কোনো টাকাপয়সা নেই। কিন্তু চিকিৎসা শেষ হয়নি। দীর্ঘদিন ধুরে দুই চোখের চিকিৎসা করতে হবে। এ ছাড়া মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ এখনো ছেলের কোনো খোঁজ নেয়নি।

এ ঘটনায় কোথাও লিখিত অভিযোগ করেছেন কি না, জানতে চাইলে মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ২৪ জুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে। দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। পাশাপাশি ওই ছেলের সঙ্গেও কথা বলেছেন।

তবে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন মাহমুদ। তাঁর দাবি, আয়াতুলকে কেউ মারধর করেননি। সে খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে। তার মা–বাবা মিথ্যা বলছেন। এ ছাড়া তাঁদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা হয়েছে। টাকাপয়সার জন্য এসব কথা বলছেন।

শিশু-কিশোরদের মোবাইল ফোনের নেশা দূর করার উপায়

0

এখনকার শিশু-কিশোররা সারাক্ষণ মোবাইল ফোনে বুঁদ হয়ে থাকে। খাওয়ার সময়ও তাদের ফোন লাগে। একটা সময় শিশুরা টিভিতে কার্টুন দেখে সময় কাটাতো। সেই শিশুরাই এখন ইউটিউবে সময় কাটায়। বলা যায় তারা এখন স্মার্টফোনের নেশায় আসক্ত। জানুন কীভাবে শিশু-কিশোরদের ফোনের নেশা কাটাবেন। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। বড়দের হাতে স্মার্টফোন দেখলে সে-ও স্মার্টফোন নিতে আগ্রহ পায়। তাই শিশুর সামনে স্মার্টফোনে চ্যাট করা, গান শোনা, গেম খেলা, ইউটিউবে ভিডিও দেখা ইত্যাদি এড়িয়ে চলুন।

আসক্তির কারণ ও প্রভাব

স্মার্টফোনের নেশা শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বাচ্চাদের এই আসক্তি কমাতে অভিভাবকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রচুর। শুধুমাত্র মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব নয়, শরীরেও মোবাইলের খারাপ প্রভাব পড়ে। 

করোনা ও তার পরবর্তী সময়ে শিশু-কিশোরদের মোবাইলে আসক্তি মারাত্মক বেড়েছে। ঘরবন্দি শিশুদের কাছে ইন্টারনেট, স্মার্টফোন এখন খুবই সহজলভ্য। স্মার্টফোন বা মোবাইলের যন্ত্রে একসঙ্গে বিভিন্ন রকম বিনোদন হচ্ছে। 

গেইম, নানা ধরনের বিনোদনমূলক অত্যাধুনিক অ্যাপের হাতছানি, ইন্টারনেট প্রভৃতি এক জায়গায় উপলব্ধ, যা আগে ছিল না। 

বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করা, খেলাধুলা, বই পড়া প্রভৃতির মাধ্যমে ধীর গতিতে আমাদের কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে। কিন্তু মোবাইলে খেলা, ভিডিও দেখার সময় অতি সত্বর শিশুমনে আনন্দ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হলেও কল্পনাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। 

টিভি, মোবাইল গেম বা যে কোনও ধরনের ভার্চুয়াল এন্টারটেনমেন্ট দেখার সময়ে আমাদের মস্তিষ্কের কোষ থেকে ক্ষরণ হয় এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার, যার নাম ডোপামিন। 

এই ডোপামিনের ক্ষরণ আমাদের মনে এক ভালো লাগার অনুভূতি সঞ্চার করে। তার ফলে অতি সহজেই আমরা এই ধরনের এন্টারটেনমেন্ট মিডিয়ামগুলোতে আসক্ত হয়ে পড়ি।

যেসব বাচ্চা মুখচোরা, সবার সঙ্গে মিশতে পারে না, বন্ধু ও সমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পছন্দ করে আমরা বলি তাদের ‘ডিস্ফোরিয়া’ আছে। এই অবস্থা থাকলে, সে নিজেকে ভাল রাখতে ও জীবনের আনন্দ খুঁজে পেতে স্মার্টফোনকে সঙ্গী করে।

আসক্তি কাটানোর উপায়

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের স্মার্টফোনে হাতেখড়ি হয় তার অভিভাবকদের হাতেই। কিন্তু চাইলে অভিভাবকরাই পারেন সন্তানকে মোবাইলের আসক্তি থেকে বের করে অন্য জগতে তাদের ভুলিয়ে রাখতে। সাধারণত বাবা-মা যা করবেন সেটা দেখেই শিশু শিখবে। এই আসক্তির পিছনে তাঁদের ভূমিকাও কম নয়। নেশাই পারে নেশা ছাড়াতে। 

স্মার্টফোন ছাড়াও দুনিয়াতে আনন্দের আরও অনেক কিছু রয়েছে। যে জগতে স্মার্টফোনের থেকে অনেক ভালো অভিজ্ঞতার হাতছানি থাকবে, সেদিকে শিশুর ঝোঁক বাড়াতে হবে।

বাচ্চার চোখে চোখ রেখে কথা বলা, তার ভিতরের সুপ্ত প্রতিভা ও ইচ্ছাগুলোকে চিনতে বা জানতে পারলে তবেই সেদিকে শিশুর ঝোঁক বাড়ানো সম্ভব।

শিশুর কোমল মন থেকে মোবাইল আসক্তি কাটানো খুব সহজ নয়। তার প্রবল ঝোঁকের বা আগ্রহের জায়গাটা খুঁজে মোবাইলের সম বিকল্প ও আকর্ষণীয় জিনিসের প্রতি তার আগ্রহকে বাড়িয়ে তুলতে পারলে তবেই শিশুর মুঠোফোনের প্রতি আসক্তি কমবে। যেমন, ছবি আঁকা, গান গাওয়া বা কোনও বাদ্যযন্ত্রের প্রতি খুদের কৌতূহল থাকলে সেই আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। তবেই ফোনের স্ক্রিনের থেকে বেশি সময় এইসব কাজে তারা ব্যয় করবে।

এছাড়া শিশুকে পড়াশোনার পাশাপাশি কম্পিউটার কোডিং ল‌্যাঙ্গুয়েজ শেখানো, বিভিন্ন রহস্য-রোমাঞ্চকর গল্পের প্রতি ঝোঁক তৈরি করা খুব দরকার। তবেই সে ধীরে ধীরে মোবাইল ভুলে ভাল নেশায় আসক্ত হবে। এর লাগাম থাকবে অবশ্যই অভিভাবকদের হাতে। শিশুর এগিয়ে চলার স্বচ্ছন্দ গতির উপর তাদের সুষ্ঠু বিকাশ নির্ভর করে, যার পরিকল্পিত রূপ দেওয়ার কারিগর হলেন বাবা-মা।

সন্তানকে সময় না দিয়ে তার বদলে হাতে মোবাইল ধরিয়ে দেওয়া বা টিভিতে কার্টুন চালিয়ে দেওয়াটা অনুচিত। অনেক শিশু একাকিত্বের কারণে মোবাইল ফোনের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাবা-মায়ের প্রথমত খেয়াল রাখা উচিত শিশু স্মার্টফোন ব্যবহার করেও প্রতিদিনের কার্যকারিতা সঠিকভাবে পালনে সক্ষম কি না। যদি তা নির্দ্বিধায় করে সেক্ষেত্রে ১-২ ঘণ্টা ফোন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যায়।

phone

বাড়ির আবহে পড়াশোনা-খেলাধুলার পরিবেশ থাকা অত্যন্ত জরুরি। ঘরের ছোট্ট খুদেটির সঙ্গে বাবা-মায়ের কোয়ালিটি টাইম কাটানো দরকার।

রাতে ঘুমানোর আগের একঘণ্টা ও সকালে ঘুম ভাঙার পর প্রথম এক থেকে দুই ঘণ্টা খুদেটির ফোন ব্যবহার নিষেধ রাখতে হবে। এই নিয়ম বাবা-মায়ের জন্যও প্রযোজ্য হলে ভাল। উল্লেখযোগ্য, সপ্তাহে একটি দিন বাড়ির প্রত্যেক সদস্যের জন্য একটি স্মার্টফোনবিহীন দিন রাখতে হবে, সেদিন প্রত্যেক সদস্যের ছুটির পর শিশুটির সঙ্গে সময় কাটানো দরকার।

স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের প্রতি নির্ভরশীলতা বাড়লে শিশুর আনন্দসূচক ক্রমে কমতে থাকে ও তারা অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে। ওদের মুঠোফোনের বাইরের পৃথিবীর সংস্পর্শে রাখা বর্তমান প্রজন্মের অভিভাবকদের মূল দায়িত্ব। স্ক্রিনজনিত বিনোদনের বদলে খেলাধুলা ও নিয়মানুবর্তিতার সঞ্চার করা ভীষণ প্রয়োজন।

৯০ ভাগ কিশোর-কিশোরী মোবাইল ফোন ব্যবহার করে

0

দেশের ৯০ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। বিবাহিত কিশোরীদের প্রায় অর্ধেক ও অবিবাহিত কিশোরীর এক-চতুর্থাংশের নিজস্ব মোবাইল ফোন আছে। কিশোরদের ৫০ শতাংশ এবং বিবাহিত এবং অবিবাহিত কিশোরীদের ২০ শতাংশ সপ্তাহে কমপক্ষে একবার ইন্টারনেট ব্যবহার করে। প্রতি পাঁচটি পরিবারের একটিতে কমপক্ষে একজন কিশোর/কিশোরী (১৫-১৯ বছর বয়সী) আছে; যাদের মধ্যে ৯৭ শতাংশ জীবনের কোনো না কোনো সময় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় (স্কুল, কলেজ বা মাদ্রাসা) অংশ নিয়েছে।

জরিপে দেখা যায়, ৭৩ শতাংশ অবিবাহিত কিশোরী এবং ৬৬ শতাংশ অবিবাহিত কিশোর বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। এই তথ্যের জন্য কিশোরীরা বইয়ের ওপর নির্ভর করলেও কিশোরদের তথ্যসংগ্রহের মূল মাধ্যম ইন্টারনেট। বিবাহিত ও অবিবাহিত কিশোরীদের ৯৮ শতাংশই ঋতুকালীন সময়ে একবার ব্যবহারযোগ্য প্যাড বা সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে বহুবার ব্যবহার করা যায়-এমন উপাদান ব্যবহার করে। তবে ঋতুকালীন স্বাস্থ্যকর আচরণের প্রবণতা বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যে নয় শতাংশ এবং অবিবাহিতদের মধ্যে ১২ শতাংশ মাত্র। প্রতি চারজনের একজন কিশোরী (বিবাহিত এবং অবিবাহিত) ঋতুকালীন সময়ে কমপক্ষে একদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ রাখে। 

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, কিশোরীদের মধ্যে তিন শতাংশের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে, স্বামীর থেকে পৃথক আছে অথবা বিধবা হয়েছে। এছাড়া কিশোরীদের ১৭ শতাংশ বর্তমানে চার বছর বা অধিক সময় ধরে বিবাহিত। ৩০ শতাংশ কিশোরীর স্বামীর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য কমপক্ষে দশ বছর। জরিপে আরও দেখা যায়, সর্বোচ্চসংখ্যক কিশোরী (৪৫ শতাংশ) যাদের স্বামীর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য দশ বছর বা তার অধিক। 

জরিপে প্রতিবেদনে দেখা যায়, এক-তৃতীয়াংশ (৩৪ শতাংশ) বিবাহিত কিশোরী এবং প্রায় এক-পঞ্চমাংশ (১৮ শতাংশ) অবিবাহিত কিশোরী মনে করে স্ত্রী কথা না শুনলে স্বামী তাকে শারীরিকভাবে আঘাতের অধিকার রাখে। ৮৮ শতাংশ অবিবাহিত কিশোরী পথে এবং ১৯ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পথে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। 

প্রতিনিধিত্বশীল ৭২ হাজার ৮০০ পরিবারকে জরিপের নমুনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। যার মধ্যে ৬৭ হাজার ৯৩টি পরিবারে জরিপ পরিচালনা করা হয়। এরমধ্যে চার হাজার ৯২৬ জন বিবাহিত কিশোরী এবং সাত হাজার ৮০০ অবিবাহিত কিশোরী। এছাড়া পাঁচ হাজার ৫২৩ অবিবাহিত কিশোরকে জরিপের আওতায় সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। 

সমীক্ষা অনুসারে, প্রতি দশজন অবিবাহিত কিশোর-কিশোরীর মধ্যে একজন কৃশকায় ও কম ওজনের। অন্য দশ ভাগের এক ভাগ স্থূলকায় বা বেশি ওজনের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-৭৬ শতাংশ কিশোর এবং ৮৫ শতাংশ কিশোরী খাদ্যের পাঁচটি গ্রুপ যেমন-শাকসবজি, স্টার্চ জাতীয় খাবার, দুগ্ধ, প্রোটিন এবং ফ্যাটযুক্ত খাবারের মধ্যে চারটি গ্রুপেরও বেশি খাবার গ্রহণ করে থাকে। বেশিরভাগ কিশোর-কিশোরী (৭০-৮০ শতাংশ) আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খায়। মাত্র এক চতুর্থাংশ কিশোর-কিশোরী ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করে।

জরিপের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নান; স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মোহাম্মাদ আলিনূর এবং মার্কিন দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি’র পপুলেশন, হেলথ, নিউট্রিশন অ্যান্ড এডুকেশন অফিসের পরিচালক জার্সেস সিধওয়া।

কচ্ছপের কান্না

0

(উত্তর আমেরিকান,নেটিভ আমেরিকান রূপকথা)

এক গ্রীষ্মের সকালে, যখন প্রখর রোদে পাথর গরম হয়ে চামড়া পুড়ে যাওয়ার উপক্রম, তখন এক কচ্ছপ খাবার খুঁজতে বেরিয়েছিল। সে থাকত নদীতে। কচ্ছপটি হামাগুড়ি দিয়ে একটু ভালো খাবার খুঁজতে বেরিয়েছিল। কিন্তু সূর্য এমন প্রখর হবে তা সে জানত না।  সূর্যের আলো যদি বেশি পড়ে তাহলে সে মারা যাবে। ইতিমধ্যে গরমে তার যন্ত্রণা হলো। তার ওপর মাটি বেশি শুষ্ক হলে তার বাড়ি ফিরতে কষ্ট হবে। তাছাড়া কচ্ছপ হাঁটে খুব ধীরে ধীরে। তাই সে পাহাড়ের নিচে একটা বড়ো পাথরের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল।

কচ্ছপ এত জোরে কাঁদতে লাগল যে, পাশ দিয়ে এক নেকড়ে যাচ্ছিল, সে শুনে ফেলল। সে ভাবল, হয়তো কেউ গান গাইছে। ভাবল সেও গান শিখবে। তাই সে পাথরের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল। চারপাশে উঁকি দিয়ে সে কান্নারত কচ্ছপকে দেখতে পেল।

‘তুমি তো চমৎকার গান গাইতে পারো।’—কচ্ছপকে বলল নেকড়ে।

‘এটা গান ছিল না।’—কচ্ছপ বলল।

‘আমি শুনেছি এটা গান ছিল। আমি তোমার কাছে গান শিখতে চাই। তুমি যদি আমাকে গান না শেখাও তাহলে তোমাকে গিলে ফেলব।’

‘আমাকে গিলে ফেললে আমার কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ আমার শক্ত খোল তোমার গলায় আঘাত করবে।’

‘আচ্ছা, তাহলে তোমাকে প্রখর রোদে ফেলে দেবো।’

‘তাতেও আমার কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ আমি খোলের নিচেও হামাগুড়ি দিয়ে চলতে পারি।’—কচ্ছপ বলল।

‘তাহলে তোমাকে নদীতে ফেলে দেবো—আমাকে যদি গান না শেখাও।’

এবার কচ্ছপ কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘না না, দোহাই তোমার, এমনটি কোরো না। তাহলে আমি ডুবে যাব!’

‘না আমি ফেলবই।’—এই বলে নেকড়ে কচ্ছপটিকে মুখে তুলে নদীতে ফেলে দিল।

এদিকে কচ্ছপ নদীতে ফিরে এসে তার বাড়িতে চলে গেল সাঁতরে। যেতে যেতে মাথা তুলে নেকড়েকে বলল, ‘অনেক অনেক ধন্যবাদ নেকড়ে—আমাকে নদীতে ফেলে দেওয়ার জন্য। আমি এখানে আসার জন্যই কান্না করছিলাম। কোনো উপায় ছিল না তাই পাথরের নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাকে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ।’

এদিকে নেকড়ে খুব রাগান্বিত হলো এবং দাঁত কটমট করে চলে গেল।

ভাষান্তর-
টি এইচ মাহির

কোটি টাকার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কোটিপতি মায়াঙ্ক

0
কারণ সে ইতিমধ্যে কৌন বনেগা ক্রোড়পতির জুনিয়রস উইকে কোটিপতি হয়ে গেছে

একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েই কোটিপতি বনে গেলো কিশোর মায়াঙ্ক।একটি কুইজ শোতে কোটি টাকার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ১ কৌটি রূপি জিতে নিয়েছে সে।বাংলাদেশী মুদ্রায় যা প্রায় ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা।অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া মায়াঙ্ক কোটি টাকা জিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

ঘটনাটি ভারতের একটি শোতে ঘটে।ভারতের একটি কুইজ শো “কৌন বনেগা ক্রোড়পতি”।শোতে হোস্ট হিসেবে ছিলেন অমিতাভ বচ্চন। কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’র ১৫ তম আসরে অংশ নেয় কিশোর মায়াঙ্ক।অনুষ্ঠানে মায়াঙ্কের মায়াঙ্কের বুদ্ধিমত্তা এবং বুদ্ধিতে বিমোহিতে হয় দর্শক এবং বিচারকরা।কিশোর মায়াঙ্ককে কোটি টাকার প্রশ্নে যেতে উত্ত্র দিতে হয়েছে ১৫টি প্রশ্ন।হোস্টের করা একের পর এক প্রশ্নের উত্তর আত্মবিশ্বাসের সাথেই দিয়েছে মায়াঙ্ক।তারপর ১৬তম প্রশ্নে পৌঁছায়।যেটি ছিলো কোটি টাকার প্রশ্ন।সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েও কোটি টাকা জিতে নেয় মায়াঙ্ক।তাকে করা প্রশ্নটি ছিল,

“কোন ইউরোপীয় মানচিত্রকার সদ্য আবিষ্কার করা মহাদেশের ম্যাপ তৈরি করেছিলেন, যার ওপর আমেরিকা লেখা ছিল? “

A- আব্রাহাম অরটেলিয়াস, B- গেরাদাস মার্কেটর, C- জিওভানি বাতিস্তা অ্যাগনেস এবং D- মার্টিন ওয়াল্ডসিমুলার।

মায়াঙ্কা উত্তর দেয় অপশন ডি মার্টিন ওয়াল্ডসিমুলার।যা ছিল সঠিক উত্তর।প্রশ্নের উত্তর সঠিক হওয়ায় কেঁদে ফেলে মায়াঙ্ক।কারণ সে ইতিমধ্যে কৌন বনেগা ক্রোড়পতির জুনিয়রস উইকে কোটিপতি হয়ে গেছে।তারপরে সে সাত কৌটির প্রশ্নেরও মুখোমুখি হয়।কিন্তু উত্তর জানা না থাকায় গেম থেকে বেরিয়ে আসে।

১৪ বছর বয়সী কিশোর মায়াঙ্ক ভারতের হরিয়ানার মহেন্দ্রগড়ে বাস করে।সে বর্তমানে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে তাকে টুইটারে এক ভিডিও বার্তায় অভিনন্দন জানিয়েছে।তাকে ‘জিনিয়াস’ বলে অ্যখ্যা দিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী।অনুষ্টানে যখন মায়াঙ্ক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে কোটি টাকা জিতে নেয় তখন উপস্থিত ছিলো মায়াঙ্কের মা বাবা।তার মা বাবা তার ব্যতিক্রমী জ্ঞানের প্রতি আগ্রহকে স্বীকার করে।মায়াঙ্ক জানায় “একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হল আপনার জ্ঞান।”মায়াঙ্ক কুইজে দুদার্ন্ত গেম প্লে প্রদর্শন করে।সে হরিয়ানায় সর্বকনিষ্ঠ কৌটিপতি হওয়ায় তার মা বাবাকে ধন্যবাদ জানায়।তার মা বাবার দিক নির্দেশনা তাকে অনুপ্রাণিত করেছে।মায়াঙ্কের বুদ্ধিমত্তা এবং দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিল দর্শকরাও।তারে তাকে অভিবাদন জানায় এবং উল্লাস করে।অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মায়াঙ্ক জানায় তার খাঁটো উচ্চতা নিয়ে সবাই মজা করে।কিন্তু মায়াঙ্ক বুঝিয়ে দিয়েছে শারিরীক উচ্চতা জ্ঞান,বুদ্ধিমত্তা এবং দক্ষতার ক্ষেত্রে কখনো বাঁধা হতে পারে না।

-টি এইচ মাহির

১২ বছর বয়সী সফল উদ্যোক্তা মিয়া মনজিডেলিস

0

কিশোরী একটি মেয়ে। নাম মিয়া মনজিডেলিস। এখন যার বয়স মাত্র ১২ বছর। স্কুলের বন্ধুদের সাথে খেলা করে,টিভি দেখে আর রেস্টুরেন্টে গিয়ে মজার মজার খাবার খেয়ে দিন পার করা আর দশজন কিশোর কিশোরীর মত নয় সে। ফেসবুক,ইউটিউব,টিকটক বা ইন্সটাগ্রামে ছবি আর ভিডিও পোস্ট করা মিলিয়ন ভিউ পাওয়া তথাকথিত সেলিব্রেটিও সে নয়। তবুও সে সেলিব্রেটি। তবুও সে বিশ্বব্যাপী আলোচিত এবং প্রশংসিত! সে সবার থেকে বেশ আলাদা। কারণ এই বয়সেই সে প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী। মনজিডেলিস মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই পাওয়ারপনি আবিস্কার করেছিল। এখন আমাদের জানা দরকার এই পাওয়ার পনি জিনিসটা আসলে কী? পনি শব্দের অর্থ টাট্টু আর টাট্টু কথাটা বলার সাথে সাথে যে বিষয়টা মাথায় আসে সেটা হলো ঘোড়া। যে ঘোড়া খুবই ছোট তাকে আমরা টাট্টুঘোড়া বলি। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে মনজিডেলিস কিভাবে টাট্টুঘোড়া আবিস্কার করলো? এখানে একটি ছোট্ট তথ্য দিতে হচ্ছে। পনি শব্দের আগে সে পাওয়ার শব্দটি ব্যবহার করেছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে পাওয়ারপনি হলো ব্যাটারি চালিত টাট্টুঘোড়া! হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন। মিয়া মনজিডেলিস যেটা আবিস্কার করেছে সেটি হলো ব্যাটারি চালিত ঘোড়া। আর এই ঘোড়ায় চড়লে সত্যিকার ঘোড়ায় চড়ার মতই অনুভূত হয়। মিয়া মনজিডেলিস একই সাথে নিউইয়র্কে অবস্থিত “দ্য ফ্যামিলি এন্ড চিলড্রেন এসোসিয়েশন” এর মেম্বার। এটি একটি দাতব্য সংস্থা, যারা অসহায় শিশু কিশোর ও বয়স্কদের সহযোগিতা করে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো মিয়া গত বছর এই সংস্থাকে ৫ হাজার ডলার সাহায্য দিয়েছে এবং বাংলাদেশী টাকায় যার পরিমান সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা! দ্য হেরাল্ড ট্রিবিউনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সে বলেছিলো ” আমি সব সময় অসহায় শিশু ও তাদের পরিবারকে সাহায্য করতে ভালোবাসি”। আর আশ্চর্য বিষয় হলো তার এই সাহায্য দেওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল যখন তার বয়স ছিলো মাত্র ৩ বছর!

মনজিডেলিস ছোটবেলা থেকেই ঘোড়ায় চড়তে পছন্দ করতো। তার ছিলো ঘোড়ার প্রতি দূরন্ত ভালোবাসা। কিন্তু মন চাইলেইতো আর ঘোড়ায় চড়া যায় না। বিশেষ করে ছোটরা ঘোড়ায় চড়তে গেলে কতরকম বিপদ হতে পারে। আর সে জন্য ছোটরা যখন ঘোড়ায় চড়ে তখন বড় কেউ না কেউ সাথে থাকতে হয়। কিন্তু দেখা গেলো বাবা অফিসে, মা রান্নার কাজে কিংবা বাজারে গিয়েছে এমন সময় ঘোড়ায় চড়তে ইচ্ছে করছে। তখন উপায় কি? একা একাতো ঘোড়ায় চড়তে পারবে না। ঘোড়ার পিঠেইতো উঠতে পারবে না। সুতরাং এমন একটা ঘোড়া দরকার যেটা হবে তার মত ছোটদের জন্য। যার পিঠে সে একা একাই উঠতে পারবে এবং যখন খুশি সে সেই ঘোড়ায় চড়তে পারবে। এমনকি মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে তার যদি ইচ্ছে করে একটু ঘোড়ায় চড়বো তো কারো সাহায্য ছাড়াই সে একা একা সেই ঘোড়ায় চড়তে পারবে। কিন্তু এমন আজব ঘোড়া কি দুনিয়ার কোথাও একটাও আছে? ধরে নিলাম একটা আছে আর সেই ঘোড়াটা কোনো ভাবে মনজিডেলিসের জন্য সংগ্রহ করা হলো। সেটা দেখে যদি তার বন্ধুরা বলে তাদেরও অমন একটি ঘোড়া চাই। তখন কোথায় পাবে সেই ঘোড়া? বাবা মা তখন কষ্ট পাবে। মনজিডেলিসের উপর রাগ করবে। সুতরাং সে সিদ্ধান্ত নিলো এমন একটি ঘোড়া সে নিজেই তৈরি করবে! মাত্র পাচ বছর বয়সে সে এমন কিছু ভাবতে পারে কেউ কি কল্পনা করতে পারে? রুপকথার গল্পে হলে না হয় মানা যেত। বাস্তবে এমন ঘোড়া! কিন্তু সে যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই সে এমন একটি ঘোড়া তৈরি করেই ছাড়বে এবং শুধু একটি নয় পরবর্তীতে দুনিয়ার সব শিশু কিশোর কিশোরীদের জন্য এমন টাট্টুঘোড়া তৈরি করবে বলে সে সিদ্ধান্ত নিলো। নাম দিলো পাওয়ারপনি।

মনজিডেলিস আবিস্কৃত সেই পাওয়ারপনিতে আইওএস সাপোর্ট করে! আছে একটি জুমি ইঞ্জিন! আর এটা আবিস্কারের পর তার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। শিশু কিশোর কিশোরীদের মধ্যে তার আবিস্কৃত পাওয়ারপনি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। সে নিশ্চয়তা দিয়েছে এই টাট্টুঘোড়ায় যারা চড়বে তারা প্রত্যেকেই অনেক আনন্দ পাবে।

নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে থাকে মনজিডেলিস। সে পাওয়ারপনির আবিস্কারক এবং প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে শোর রোড এলিমেন্ট্রি স্কুলে সিক্সথ গ্রেডে পড়াশোনা করছে। ছোটবেলা থেকেই ঘোড়া পছন্দ করতো এবং স্বপ্ন দেখতো একদিন সে একটি ঘোড়ার মালিক হবে। কিন্তু সে যেখানে থাকতো সেখানে ঘোড়া রাখার মত জায়গা ছিলো না। সুতরাং বাবা মা তাকে ঘোড়া কিনে দিতে পারেনি। কিন্তু সে কখনো হাল ছাড়েনি। সে তার স্বপ্ন পূরণে সব সময় ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এক ক্রিসমাসে সে একটি খেলনা ঘোড়া এবং একটি হভারবোর্ড উপহার পেয়েছিল। সে ভাবলো আচ্ছা যদি ঘোড়াটাকে হভারবোর্ডের উপর বসিয়ে দেই তাহলে কেমন হয়? তাহলেইতো একই সাথে দুটোতেই চড়া হবে আর তার ইচ্ছেও পূরণ হবে। আর সেই সময়েই তার মাথায় আইডিয়া আসলো ব্যাটারি চালিত ঘোড়া তৈরি করবে যেন যখন খুশি, যেখানে খুশি সে চড়তে পারবে। আর এ কাজে তাকে তার বাবা খুবই সহযোগিতা করেছে। যখন সে তার আইডিয়া বাবার সাথে শেয়ার করলো বাবা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলো।তারপর তিনি তাকে সবরকম সহযোগিতা করলেন। একসময় বাবা কঠোর পরিশ্রম করতেন। কিন্তু মনজিডেলিসের আইডিয়াটা শেয়ার করার পর দুজনে মিলে যখন সত্যি সত্যিই পাওয়ারপনি তৈরি  করে ট্রায়াল দিয়ে সফল হলেন এবং বাজারে বিক্রি করে দারুণ সাড়া পেলেন তখন থেকে তাদের ভাগ্যই বদলে গেলো। মনজিডেলিস তাই নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবতী মেয়ে মনে করে।

মনজিডেলিস নিজে যেহেতু ছোট তাই সে ছোটদের বিষয়টা মাথায় রেখেই তার ব্রান্ডের একটি সুন্দর নাম খুঁজতে শুরু করলো। অনেক নামের ভীড়ে শেষে পাওয়ারপনি নামটা তার বেশি পছন্দ হলো।তার বন্ধুরা তার এই আবিস্কারে ভীষণ এক্সাইটেড ছিলো। যখনই সে নতুন একটি পাওয়ারপনি তৈরি করে তার ট্রায়াল দিয়েছে তখনই বন্ধুরা উৎসাহ নিয়ে সেটা দেখেছে। উপভোগ করেছে। একবার এক সাক্ষাৎকারে মনজিডেলিসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তুমি এই পাওয়ারপনি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোন জিনিসটি শিখেছ? সে তখন বলেছিল ”ছোট বলে কাউকে অবজ্ঞা করা যাবে না। এবং ছোটদের কল্পনায় যা আসে সেটিকেও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সেই আইডিয়াও বাস্তব জীবনে নিয়ে আসা সম্ভব যা আমি করে দেখিয়েছি। বিশ্বাস,আস্থা,সহযোগিতা আর গ্রুপওয়ার্ক করতে পারলে অনেক কিছুই করা সম্ভব যা প্রাথমিক ভাবে অসম্ভব মনে হতে পারে।” 

তার প্রতিষ্ঠানে রয়েছে স্পেশাল ডিজাইনার,ইঞ্জিনিয়ার,ইলেক্ট্রিশিয়ান। আর প্রতিটি কাজই সে নিজে তদারকি করে থাকে। ডিজাইনার যখন ডিজাইন করে তখন সে নিজে সেটা দেখে এবং জাস্টিফাই করে যে সেই ডিজাইনটি তার গ্রাহকশ্রেণীর পছন্দ হবে কি না। যদি কিছু মডিফাই করার দরকার হয় তাহলে সে সেভাবেই ইন্সট্রাকশন দেয়। মনজিডেলিসের মতে নিজের মত করে একটি ব্যবসা দাড় করানো খুবই কঠিন বিষয়। তবে যদি নিজের আইডিয়ার উপর নিজের প্রবল বিশ্বাস থাকে,যথাযথ পরিকল্পনা থাকে আর লেগে থাকার মত মানসিকতা থাকে তাহলে যে কেউ সেই প্রজেক্ট সফল করার পথ নিজেই খুঁজে নিতে পারবে। আর এই পথপরিক্রমায় যতই বাঁধা আসুকনা কেন, সেগুলো অনায়াসেই পার করা সম্ভব হবে।

ক্রিসমাসে পাওয়া দুটো উপহার আর নিজের একটি স্বপ্ন থেকে কিশোরী মনজিডেলিস সফল উদ্যোক্তা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে উদ্যোক্তা হবো বা কিছু করবো এমন ধারণা নিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। মিয়া মনজিডেলিসের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প থেকে আমরা এই শিক্ষাই পেতে পারি যে শুরু করার কোনো বয়স সীমা থাকে না আর শুরু করার পর লেগে থাকলে একদিন না একদিন সফলতা আসবেই। হাল ছাড়া যাবে না।

লেখক: জাজাফী

২৭ ডিসেম্বর ২০২৩

যে শিশু কিশোর কিশোরীরা ১ হাজার বই পড়েছে!

0

বইয়ের মত অকৃত্রিম বন্ধু আর হয় না। বই পড়ায় যে আনন্দ তার একটি ধারণা পাওয়া যায় বিশ্ববিখ্যাত শিশুতোষ লেখক রোয়াল্ড ডালের লেখা “মাতিলদা” বই থেকে। যেখানে মাতিলদা নামের ছোট্ট মেয়েটি বই পড়ায় এতো বেশি আগ্রহী যে পড়তে শেখার পর পরই সে লাইব্রেরীতে গিয়ে অসংখ্য বই পড়ে ফেলে। হলিউডে এটা নিয়ে দুটো সিনেমাও হয়েছে। বই পড়ে আমরা হাসি,কাদি,আনন্দপাই আবার অনেক জ্ঞানার্জনও করি। তবে অনেকেই বই পড়তে খুব একটা পছন্দ করে না। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা বইপড়তে খুবই ভালোবাসে। আর আমরা তাদের বলি বইয়ের পোকা। ছোটবেলা থেকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে জীবনে নানা সুবিধা পাওয়া যায়। কখনো নিজেকে একা লাগে না। মনে হয় সবচেয়ে সেরা বন্ধুতো আমার সাথেই আছে। আর সেই সেরা বন্ধু হলো বই। বই আমাদের নতুন এক জগতের সন্ধান দেয়। আমরা যত বেশি বই পড়ি আমাদের মনের চোখ খুলে যায়। আমরা কল্পনা করতে পারি নতুন নতুন ভূবনের। আমাদের চিন্তার প্রসার ঘটে। জ্ঞানের বিকাশ ঘটে।

কর্মব্যস্ত জীবনে অনেকেই বই পড়ার সুযোগ মেলে না বলে অভিযোগ করে। আবার উল্টোটাও দেখা মেলে। বিশ্ববিখ্যাত মানুষ বিলগেটস বা মার্ক জুকারবার্গও প্রচুর ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু তাদের বই পড়ার যে নিয়মিত অভ্যাস তাতে কোনো অসুবিধা হয় না। তারা সময় বের করে প্রতিদিনই বই পড়েন। একজন মানুষ তার সারা জীবনে ঠিক কতগুলো বই পড়তে পারে? কেউ কেউ বলেন ৫ হাজার আবার কেউ কেউ বলেন ১০ হাজার। বইয়ের সাইজ,ধরণ এসবের উপর সব কিছু নির্ভর করে। কেউ যদি রাত দিন পড়তেই থাকে তবে সে হয়তো অনেকগুলো বই পড়তে পারবে। আর যারা সবে মাত্র কিন্ডারগার্টেন শুরু করেছে এবং যাদের বয়স ১২ বছর বা তার কম তাদের পক্ষে ওই বয়সে ঠিক কতগুলো বই পড়া সম্ভব? স্কুলের পড়া,খেলাধুলা,টিভি দেখা সব কিছু বাদ দিয়ে যে সময় মেলে তাতে হয়তো ১০ থেকে ২০ টা বই পড়তে পারে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো পৃথিবীতে এমন অনেক শিশু কিশোর কিশোরী আছে যারা কিন্ডারগার্টেন পার হওয়ার আগেই ৩০০ থেকে ১০০০ বই পড়ে ফেলেছে! অনেকের কাছেই এই তথ্যটি অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। তারা চাইলে ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই এর সত্যতা খুঁজে পাবে। তেমনই কিছু শিশু কিশোর কিশোরীর গল্প শোনাতে চাই।

লানা রেনল্ড ও জুদাহ রেনল্ড

আমেরিকার  পেনসিলভেনিয়ার অন্তর্গত ব্রুকভিল নামক স্থানে একটি লাইব্রেরি আছে যার নাম রেবেকা এম আর্থার্স লাইব্রেরী। স্থানীয় মানুষ এই লাইব্রেরীর সদস্য। সদস্যদের মধ্যে রয়েছে শত শত শিশু কিশোর কিশোরী। সেই সব শিশু কিশোর কিশোরীদের অনেকেই এক হাজার বই পড়ে ফেলেছে আবার কারো কারো সংখ্যা এক হাজারের কাছাকাছি চলে গেছে। তারা এই লাইব্রেরীতে এসেই পড়ছে এবং তারা পড়াটাকে খুব উপভোগ করছে। তাদেরই একজন লানা রেইনল্ড। সে কিছুদিন আগেই এক হাজার বই পড়ে শেষ করেছে। লানা যখন খুব ছোট ছিলো তখন সে দেখতো মা তার পাশে বসে বই পড়ছে। কখনো কখনো মা তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বই পড়তেন। সেই থেকে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয় লানার মনের মধ্যে। সে হয়তো তখনই মনে মনে ভেবে রেখেছিল মায়ের মতই সেও অনেক বই পড়বে। রোজ রাতে ঘুমানোর আগেও মা তাকে বই থেকে গল্প শোনাতো। সেই সব গল্পে রাজপুত্র,রাজকন্যা যেমন থাকতো তেমনি অনেক সুন্দর সুন্দর শিক্ষনীয় ঘটনাও থাকতো। তারপর সে যখন স্কুলে গিয়ে দেখে দেখে পড়া শিখলো তখন সে মায়ের পাশে বসে তার উপযোগী বই পড়তো। 

লানা যতগুলো বই পড়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় বই “দ্য নেস্টিং বার্ড”। কারণ সে পাখির ছানা খুব ভালোবাসতো। লানার ছোট্ট একটা ভাই আছে। মা যেমন ছোট বেলায় তাকে গল্প পড়ে শোনাতো লানা নিজেও পড়তে শেখার পর তার ছোট ভাই জুদাহ রেনল্ডকে পাশে বসিয়ে বই পড়ে শোনাতো। এভাবে তার ভাইও বইয়ের প্রতি ভালোবাসায় আটকা পড়লো। ছোটবেলা থেকে লানা যে সব বই পড়েছিল সেগুলোই এখন জুদাহ নিজে পড়ছে। আর সে এরই মধ্যে ২০০ বই পড়ে ফেলেছে। বয়স যদিও মাত্র ৭ বছর! আর তার প্রিয় বই “পিটি দ্য ক্যাট”।

লানার বই পড়ার শুরুটা তার মায়ের হাতে হলেও সেটা গতি পেয়েছিল রেবেকা এম আর্থার্স লাইব্রেরীর বই পড়া কর্মসূচীর মাধ্যমে। বাংলাদেশে যেমন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়ার কর্মসূচী আছে অনেকটা সেরকম। লানার মায়ের নাম মাইলিয়া রেনল্ড তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে বইপড়া কর্মসূচীর বিষয়ে জানতে পেরেছিলেন। সেই বান্ধবী তার বেবীদেরকে খুব ছোট বেলা থেকেই ওই লাইব্রেরীতে নিয়ে যেতেন এবং নিজেও বই পড়তেন। এটা শুনে মাইলিয়ার মনে হলো তিনি লানাকেও ওই লাইব্রেরীর সদস্য করবেন। বাড়িতে বসে অনেক বই পড়া হয়েছে। আরও কত শত বই আছে যার সব কিনে পড়া যেমন সম্ভব নয় তেমনি অনেক বইয়ের সন্ধানও অনেক সময় পাওয়া হয়না। কিন্তু লাইব্রেরীতে গেলে যেমন অসংখ্য বই পাওয়া যাবে তেমনি পড়ার পরিবেশও ভালো থাকায় পড়ায় গতি আসবে। তাছাড়া মাইলিয়া মনে করতেন এই পড়ার অভ্যাস তার ছোট্ট ছেলে মেয়েকে ভবিষ্যতে সফল হতে সহযোগিতা করবে। সেই থেকে লানা আর তার ভাই জুদাহ বাড়িতে পড়ার পাশাপাশি লাইব্রেরীতে গিয়েও পড়তে শুরু করলো। উল্লেখ্য লানা ও তার ভাই মূলত হোমস্কুল করতো বলে তাদের হাতে ছিলো পড়ার মত অনেক বেশি সময় ও সুযোগ।

বেথেনি ফ্রিটজ

লানা রেনল্ডের মতই বেথেনি ফ্রিটজ নামের মেয়েটিও বইয়ের পোকা। সেও এরই মধ্যে ১ হাজার বই পড়ে শেষ করেছে। বেথেনির দাদি আন ফ্রিটজ বলেছেন বেথেনির বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন থেকে সে লাইব্রেরীর গ্রীষ্মকালীন বইপড়া কর্মসূচীতে নাম দিয়েছিলো। বেথেনিদের বাসায় যে রেফ্রিজারেটর আছে সেটার দরজায় সে একটা চার্ট লাগিয়ে রেখেছিল কবে কখন কোন বই পড়বে। রোজ সে সকালে এবং রাতে ঘুমানোর আগে নিয়ম করে বই পড়তে শুরু করেছিল। বেথেনিও লাইব্রেরী খুব ভালোবাসতো। বইয়ের রাজ্যে সে আনন্দের সাথে বিচরণ করতো। লাইব্রেরী থেকে যখনই যে অফার দিতো সে ও তার পরিবার তা লুফে নিতো। জুদাহের মত বেথেনির প্রিয় বইয়ের নামও “পিটি দ্য ক্যাট”। বেথেনি বলেছে এই বইটি তার বেশি ভালো লেগেছে কারণ যে বিড়ালটিকে নিয়ে এই বইটি লেখা হয়েছে সে খুব মজার মজার ঘটনা ঘটায়। সেগুলো পড়লে খুব আনন্দ হয়, হাসি পায়। 

লাইব্রেরীতে বসে পড়ার পাশাপাশি লাইব্রেরী থেকে পছন্দের বই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ারও সুযোগ আছে। একবার তাকে যখন প্রশ্ন করা হলো কোন বইটি তুমি বাড়িতে নিয়ে পড়তে চাও? সে বলেছিল পারলে সবগুলোই সে বাড়ি নিয়ে পড়তে চায়! বইগুলো কিন্তু খুব বেশি বড় না। ছবিযুক্ত দারুণ সব ফিচার বুক। যেখানে ছবির সাথে সাথে কয়েক লাইন করে গল্পবলা হয়। ফলে খুব দ্রুতই পড়া হয়। বেথেনি ঘুম থেকে উঠে বই পড়ে, নাস্তার টেবিলে নাস্তা করতে করতে বই পড়ে। নাস্তা শেষ হলে বই পড়ে। দুপুরে ঘুমোতে যাবার আগে বই পড়ে আবার ঘুম থেকে উঠেও বই পড়ে। রাতে খাবারের আগে বই পড়ে আবার খাবার শেষেও বই পড়ে। আর ঘুমোতে যাবার আগেও বই পড়ে! বই বই আর বই। মুনির হাসানের একটা বইয়ের কথা মনে পড়লো। যে বইটির নামই “ পড়ো পড়ো পড়ো”। বেথেনি বা লানারা যদিও মুনির হাসানের বইটির কথা জানে না কিন্তু তারা যেন পণ করেছে শুধু পড়বে আর পড়বে।

অ্যাবি হলিস:

আরেক পড়ুয়ার নাম অ্যাবি হলিস। বয়স এখন মাত্র ৬ বছর। এ বছর সে কিন্ডারগার্টেন পার করবে। এরই মধ্যে সে রেবেকা এম আর্থার্স লাইব্রেরীর গ্রীষ্মকালীন বই পড়া কর্মসূচীতে অংশ নিয়ে ৯০০ বই পড়ে ফেলেছে। অ্যাবি খরগশের গল্প পড়তে বেশি ভালোবাসে। তার ইচ্ছে ১০০০ বই পড়া শেষ করে সে লাইব্রেরী থেকে পুরস্কার নিবে। এই প্রোগ্রামে যারাই ১০০০ বই পড়া শেষ করেছে তাদেরকে লাইব্রেরী থেকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। এই এক হাজার বই পড়ার জন্য সময় পাওয়া যায় পুরো এক বছর। অনেকে ভাবতে পারে এই বয়সে এক বছরে ১ হাজার বই পড়া কিভাবে সম্ভব? তাদের জন্য একটি তথ্য যুক্ত করেছেন রেবেকা এম আর্থার্স লাইব্রেরীর লাইব্রেরিয়ান। বাচ্চাদের বই পড়ায় উৎসাহ যোগাতে তারা একটি ব্যতিক্রম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বাচ্চাদের বইগুলো সাধারণত খুব ছোট হয়। ২০ থেকে ৩০ পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ হয়। ছবি আর লেখায় বইটি পরিপূর্ণ থাকে। ফলে দেখা যায় একটি বইয়ের শব্দ সংখ্যা ৫০০ থেকে ১০০০ এর কম হয়। ফলে এক বসাতেই পুরো বই পড়া হয়ে যায়। অন্যদিকে কোনো বাচ্চার যদি কোনো বই খুব ভালো লাগে এবং সে যদি সেই বইটি বারবার পড়ে তবে প্রতিবার পড়া হিসেবে একটি সংখ্যা কাউন্ট করা হয়। মানে অ্যাবি হলিস তার পছন্দের বইটি যদি ১০০ বার পড়ে থাকে তবে সে একশোটি বই পড়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। লাইব্রেরিয়াম স্ট্রম মনে করেন রিপিটেশনের মাধ্যমে বাচ্চারা যেন বইয়ের বিষয়বস্তু আরও ভালোভাবে জানতে ও শিখতে পারে তাই এই ব্যবস্থা রাখা।

বই আমাদের মনের চোখ বাড়ায়। আমাদের জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করে। বই পড়ে আমরা যেমন আনন্দ পাই তেমনি শিখতে পারি অনেক কিছু। আমাদের জাতীয় গ্রন্থাগারের গেটের বাইরে এক সময় বড় একটি পাথরের বই তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে বড় করে লেখা ছিলো “ পড়িলে বই আলোকিত হই, না পড়িলে বই অন্ধকারে রই”। আর এ কারণেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তাদের কর্মসূচীর নাম দিয়েছিল ”আলোকিত মানুষ চাই”।

লেখক: জাজাফী

৮ জানুয়ারি ২০২৪