প্রতি বছর ১১ অক্টোবর কন্যা শিশু দিবস পালিত হয়। ২০১২ সাল থেকে সারাবিশ্বে এই দিনটিকে (১১ অক্টোবর) বিশ্ব কন্যাশিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার, আইনি সহায়তা, ন্যায়বিচার ও চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করা, বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, বাল্যবিবাহ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালনের উদ্দেশ্যে এ দিবসের সূচনা। ইসলাম ধর্মেও নারী ও কন্যাশিশুর মর্যাদা সুরক্ষায় অভাবনীয় উদ্যোগ নিয়েছিলেন নবী করীম হযরত মুহাম্মদ (স.)। কন্যাশিশুর পিতা-মাতাকে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী করে দিয়েছেন মুহাম্মদ (স.)।
আমরা সকলেই জানি, আরব ছিলো একসময় অন্ধকারাচ্ছন্ন, কুসংস্কার আর নানা অনাচারে ঘেরা এক মরু উপত্যকা। যাকে আরবী ইতিহাসবিদগণ আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময় বা ইসলামের অন্ধকার যুগ বলে অবিহিত করে থাকেন। জনশ্রুতি আছে আইয়ামে জাহেলিয়াতের সময় আরব দেশে কন্যাশিশু জন্ম দেয়াকে একরকম অশুভ কর্ম হিসেবেই দেখা হতো। কোনো পরিবারে কন্যা সন্তানের জন্ম হলে খুশী হতেন না পরিবারের অভিভাবকরা।
মেয়ে বা কন্যাশিশুদেরকে পিতার পক্ষের সম্পত্তি লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হতো। ঘাড়ের বোঝা মনে করা হতো কান্যশিশুদের। এমনও শোনা যায়, সেসময় কন্যাশিশুর মর্যাদা সমাজে এতোটাই নিচে ছিল যে কন্যাশিশুর জন্ম হলে তাকে জীবন্ত কবর দিয়ে দেয়া হতো। এরকম কতো কন্যাশিশুকে যে জীবন্ত কবরে পুঁতে দেয়া হয়েছে তা নিশ্চই আরবের সে অন্ধকার যুগের ইতিহাসের খাতায় লিপিবদ্ধ আছে।
ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) আবির্ভাবের পর আরবের নারী ও কন্যাশিশুরা তাদের মর্যাদা ফিরে পেতে লাগলো। ঐতিহাসিক রেমন্ড লার্জ বলেন, The founder of islam is in fact the promoter to the first social and international revolution of which history gives mention.অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক বিপ্লবের সূচনাকারী হিসেবে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক এর নাম ইতিহাসে প্রথম উল্লেখ করা হয়েছে।
নবী করীম (স.) মুসলিমদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের মাধ্যমে আইন জারি করলেন এই বলে যে- ‘তারা তোমাদের জন্য এক প্রকারের পোশাক এবং তোমরাও তাদের জন্য এক প্রকারের পোশাক’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৮৭)।
তাছাড়া রাসুলুল্লাহ (স.) নিজে বললেন যে, যে ব্যক্তিকে কন্যা সন্তান লালনপালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং সে ধৈর্যের সাথে তা সম্পাদন করেছে সেই কন্যা সন্তান তার জন্য জাহান্নাম থেকে আড় হবে (জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৩)।
নবী মুহাম্মদ (স.) এর সময় নারীরাও পুরুষদের পাশাপাশি আরবের ব্যবসাক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে আরবের তৎকালীন মহিলা ব্যবসায়ী খাদিজা (রা.) এর নাম উল্লেখযোগ্য। হযরত খাদিয়া (রা.) আরবের একজন সম্রান্ত ব্যবসায়ী ছিলেন। তার মাধ্যমেই হযরত মুহাম্মদ (স.) ব্যবসায় শিক্ষা লাভ করেন। মুহাম্মদ (স.) এর সততায় অভিভূত হয়ে খাদিজা তাঁকে নিজের ব্যবসায় নিয়োগ দিয়েছিলেন।
সুতরাং, খাদিজা (রা.)-র ব্যবসার বিষয়টি থেকে বুঝা যায় ইসলাম ধর্মে কখনোই নারী ও কন্যাশিশুদেরকে অসম্মান বা অমর্যাদা করা হয়নি। বরং, যখনই নারী ও কন্যাশিশুদের প্রতি অন্যায়, অবিচার হয়েছে মুহাম্মদ (স.) এর কঠোর প্রতিবাদ করেছেন। তিনি কন্যা সন্তানদেরকে একেকটি বেহেশতের সাথে তুলনা করেছেন।
ইসলাম ধর্মের অনুসারী মুসলিম উম্মাহ মনে করে- কন্যা সন্তান প্রতিপালনের তিনটি ফযিলত সকল ফযীলতের সারমর্ম হল তিনটি জিনিস। এক. আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন। দুই. জান্নাত দান করবেন। তিন. আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য দান করবেন। যা সফলতার সর্বোচ্চ চূড়া বলে মনে করেন মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা।
কন্যা সন্তানের জন্মে বেশি আনন্দ প্রকাশ করা ইসলামের শিক্ষা। কন্যা সন্তান জন্ম নিলে আনন্দ প্রকাশ করা এবং এটিকে একটি সুসংবাদ মনে করার সুনির্দিষ্ট নির্দেশ ইসলামে বিদ্যমান। তাইতো কন্যা জন্মের সংবাদকে ‘সুসংবাদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। অনেক ইসলামিক স্কলার লেখেন, যেহেতু কন্যা সন্তান জন্মানোর কারণে নিজেকে ছোট মনে করা, একে অপমান ও অসম্মানের কারণ মনে করা কাফিরদের কাজ, তাই মুসলমানগণের উচিত, কন্যা সন্তানের জন্মের কারণে অধিক খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করা।
একবার সফরে ঘটলো এক ঘটনা!
মহানবী (স.) যখন কোন সফরে যেতেন, তখন মহিলারাও সঙ্গে থাকতেন। ফলে সকলকে তিনি ধীরে ধীরে চলার উপদেশ দিতেন। যেন নারী ও কন্যাশিশুরা পিছনে না পড়ে যায়। একবার এরকম এক অবস্থায় যখন সৈনিকরা তাদের ঘোড়া ও উটগুলোকে লাগাম ঢিলা করে দিয়ে জোরে তাড়া করতে শুরু করল, তখন তিনি বললেন, ‘আরে তোমরা করছ কি! কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখ! কাঁচের প্রতি খেয়াল রেখ! অর্থাৎ, করছ কি! মেয়েরাও তো সঙ্গে আছে। তোমরা যদি এভাবে উট দাবড়াতে থাকো, তাহলে তো ওই কাঁচগুলো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে’ (বোখারী, কিতাবুল আদাব)।
আরেকবার এক যুদ্ধের ময়দানে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার কারণে উট ও ঘোড়াগুলোকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছিল না। রাসূল করিম (স.) পর্যন্ত ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়েছিলেন। অনেক মহিলাও পড়ে গিয়েছিলেন সেসময়। তখন এক সাহাবী পেছন থেকে রাসূল (স.)-এর সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। রাসূলুল্লাহ (স.)-এর পা তখনও রেকাবের মধ্যে আটকে এবং ঝুলন্ত অবস্থায় ছিলেন। তিনি (স.) তাড়াতাড়ি পা ছাড়িয়ে নিজকে মুক্ত করলেন এবং ওই সাহাবীকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমাকে ছাড়ো, ঐদিকে, মেয়েদের দিকে যাও।’
নারীদের সঙ্গে সর্বদা উত্তম আচরণ করার উপদেশ
রাসূল করিম (স.)-এর মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে এলো, তখন তিনি সব মুসলমানদের সমবেত করে যে সব ওসিয়্যত করেছিলেন, তার মধ্যে একটি কথা এই ছিল যে, ‘আমি তোমাদের আমার এই শেষ উপদেশ করছি যে, নারীদের সঙ্গে যেন সর্বদা উত্তম আচরণ করা হয়।’ এ কথাও তিনি প্রায়ই বলতেন যে, ‘যার ঘরে মেয়েরা আছে এবং সে তাদের লেখাপড়া শেখায় এবং ভালভাবে তরবিয়ত করে, কেয়ামতের দিন খোদাতায়ালা তার জন্য দোজখ হারাম করে দেবেন’ (তিরমিযি শরীফ)।
সাধারণ আরবদের মধ্যে একটি রেওয়াজ ছিল যে, স্ত্রীলোকরা যদি কোন ভুল-ত্রুটি করত, তবে তাদের মারধর করা হতো। হযরত রাসূল করিম (স.) যখন বিষয়টা জানতে পারলেন, তখন তিনি বললেন, ‘নারীরা আল্লাহর দাসী, তোমাদের নয়। তাদের কখনই মারধর করবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে না কিংবা তাকে মারধর করে, তার সম্পর্কে আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি যে, সে খোদার দৃষ্টিতে সৎ বলে বিবেচিত হবে না।’
এ ঘোষণার পর নারীর অধিকার রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত হয়। মহানবী (স.)-এর অনুগ্রহে প্রথমবারের মতো নারীরা স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে (আবু দাউদ, কিতাবুন নিকাহ)।
হযরত মাবিয়া আল কুশায়বি (রা) বলেছেন, ‘আমি রাসূল করিম (স.)-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার কী?’ তিনি বললেন, ‘খোদা তোমাকে যা খেতে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে খেতে দাও, খোদা তোমাকে যা পড়তে দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাকে পড়তে দাও এবং তাকে থাপ্পড়ও মেরো না, গালিও দিও না এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দিও না’ (আবু দাউদ)।
তৎকালীন আরবে নারীদের ভোগ্য সামগ্রী মনে করত। নবী মুহাম্মদ (স.) তাদেরকে সেই নিচু স্তর থেকে সুমহান মর্যাদা এনে দিয়েছেন। তারা ছিল পুরুষদের দাসীমাত্র। কন্যা সন্তানদের জীবন্ত দাফনপ্রথা সিদ্ধ ছিল। পরিবারের কর্তা ইচ্ছে করলে নারীকে ক্রয়-বিক্রয় এবং হস্তান্তর করতে পারতো। পিতা এবং স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের কোন অংশ ছিল না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের সমাজে অভূতপূর্ণ মর্যাদা দিয়ে সবার প্রথম ঘোষণা করলেন, জননীর পদতলে সন্তানের বেহেশত।