এখনকার সময়ে বাচ্চাদের খাওয়ানোটা বেশ দুরুহ বিষয় হয়ে উঠেছে। অনেক সময় বাচ্চারা খাবার খেতে গিয়ে অনেক বাহানা করে। বাবা মায়ের অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আজকাল মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারের মায়েদের একটি কমন সমস্যা হল তাদের বাচ্চা খেতে চায় না। এটা নিয়ে তারা প্রায়শই ডাক্তারের শরণাপন্ন পর্যন্ত হয়ে থাকেন। বাচ্চা খেতে চায় না এটাই ডাক্তারের কাছে তার প্রধান অভিযোগ। তারা বুঝতেই চাননা একটি শিশু আসলে একজন মানুষ, এবং ক্ষুধা লাগা তার একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। ক্ষুধা ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবেই হয়ে থাকে, এর জন্য কোন ঔষধের প্রয়োজন নেই।
আপনার শিশু কি খেতে চায় না? খাওয়ার চেয়ে টিভি বা ফোনে বেশি আসক্ত? উত্তর ইতিবাচক হলেও মন খারাপ করার কিছু নেই, এই সমস্যা শুধু আপনার একার নয়। প্রায় প্রতিটি ঘরেই শিশুর খেতে না চাওয়ার সমস্যা আছে। কমবেশি সব মায়েরই এক অভিযোগ—বাচ্চা কিচ্ছু খায় না। আপনার শিশু খেতে না চাইলে কী করবেন?
খাবারের প্রতি শিশুর এই বৈরাগ্য ভাব কাটাতে প্রথম থেকেই সচেতন হতে হবে। তা না হলে শিশুর স্বাদবিষয়ক অনুভূতিগুলো যখন ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে, তখন সে খাবারের ব্যাপারে খুঁতখুঁতে হবে। তবে ভালো খবর হলো, কিছু উপায় আছে, যেগুলো অবলম্বন করে আপনার শিশুসন্তানকে খাওয়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারবেন।
বাচ্চার ক্ষুধাকে বুঝতে হবে: বাচ্চাকে দিনে তিন বেলাই খাওয়াতে হবে—এমন কোনো বাঁধাধরা নিয়ম কিন্তু নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠেই যদি খেতে না চায়, তাহলে তাকে সে সময় খেতে বাধ্য না করাই ভালো। যখন খিদে লাগবে, তখন খেতে দিন। আবার এক বেলা যেটুকু খাওয়াতে চান, সেটা একবারে খেতে না চাইলে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে খাওয়ান। মানে, আগে যেখানে তিন বেলা খাওয়াতেন, এখন সেই খাবারটুকুই ছয়বারে পরিবেশন করুন।
রুটিনমতো চলা: শিশুর খাবারের সময় একবার ঠিক হয়ে গেলে নিয়মিত সেই সময়ে তার খিদে লাগবে। মিলগুলো যেন প্রতিদিন একই সময়ে পরিবেশন করা হয়, তা নিশ্চিত করুন। লক্ষ্য থাকবে, প্রতিদিন তিন বেলার খাবার ছাড়াও দুইবার হালকা নাশতা বা স্ন্যাকসজাতীয় কিছু খাওয়ানো। শিশুকে কী ধরনের স্ন্যাকস দিচ্ছেন, অবশ্যই সেটা খেয়াল রাখতে হবে। মুখরোচক কিন্তু অস্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস মূল খাবারের সময় খিদে কমিয়ে দিতে পারে। স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস হিসেবে বাচ্চাকে দিতে পারেন ফল বা বাদাম।
খাবার পরিবেশন হোক আকর্ষণীয়: সুন্দরভাবে পরিবেশিত খাবার কিন্তু অনেক শিশুকে খাবারের প্রতি আগ্রহী করে। শিশুর খাবার পরিবেশনে তাই কিছু সৃজনশীল উপায় ভেবে বের করুন। এই যেমন শিশু এমনিতে হয়তো পাউরুটি খেতে চায় না, তবে সেটা যখন প্লেটের ওপর নৌকা বা বাঘের মতো দেখাবে, সে খেতে আগ্রহী হবে। গোটা ফলও খেতে না চাইলে সেটা দিয়ে ফুল, লতাপাতা বানিয়ে শিশুকে খাওয়াতে পারেন। তাই ফল বা সবজি কাটার জন্য কুকি কাটার ব্যবহার করতে পারেন। হামাস বা জেলিতে ডিপিং করেও নানা রকম খাবারের চেহারা বদলে দিতে পারেন।

স্বাদ আবিষ্কারের সুযোগ দিন: বিভিন্ন ধরন ও স্বাদের খাবার আবিষ্কারে আপনার সন্তানকে সাহায্য করুন। এতে সে খাবারের ভিন্নতা গ্রহণ করতে শিখবে। কোনো খাবার থাকে রসাল, কোনোটি মাখানো, কোনো খাবার দানাদার, কোনোটা টুকরা করে কাটা। প্রথমে মাখানো বা রসাল স্মুদ টেক্সচারের কোনো খাবার দিয়ে শিশুর অভ্যাস গড়ে তুলুন। এরপর বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকি ধরনের খাবার একটা একটা করে পরিবেশন করুন। সব খাবার একসঙ্গে শিশুকে খাওয়ানোর দরকার নেই।
খাওয়ার সময় অন্য বিনোদন বাদ: বাচ্চা যখন টিভি দেখে বা ফোনে থাকে, তখন তাকে খাওয়ানো একদমই উচিত না। এতে শিশু প্রতিবার খাওয়ার সময় কিছু না কিছু দেখতে চাইবে, পরে যা অভ্যাসে পরিণত হবে। খুঁতখুঁতে বাচ্চাদের খাদ্যাভ্যাসের উন্নতি ঘটাতে চাইলে ভিডিও দেখানোর অভ্যাস বন্ধ করতে হবে। কেননা, টিভি বা ফোনে ভিডিও দেখার সময় বাচ্চার পুরো মনোযোগ পর্দায় থাকে। সে কী খাচ্ছে, তার চেয়ে পর্দায় কী ঘটছে, তার প্রতিই তার মনোযোগ থাকে। তার চেয়ে বরং শিশুর সঙ্গে গল্প করুন। যে খাবারটি খাওয়াচ্ছেন, সেটার পুষ্টিগুণ শিশুর মনের মতো করে বলতে পারেন।
খাবার তৈরিতে শিশুদের সঙ্গে রাখুন: বাচ্চাদেরও মাঝেমধ্যে বাজারে নিয়ে যাওয়া উচিত। তারা কোন কোন খাবার খাবে, সেটা তাদের পছন্দ করতে দিন। এরপর সবজি কাটাকুটি থেকে শুরু করে রান্না পর্যন্ত তাদের ছোটখাটো কাজে অংশগ্রহণ করতে দিন। এতে তারা শুধু জীবনমুখী কাজগুলো করতে শিখবে না; বরং নিজে যে খাবার রান্না করতে সাহায্য করেছে, সেসব খাবার খেতেও চাইবে।
ধৈর্য রাখুন: দেখুন, কোনটা তার জন্য ভালো আর কোনটা খারাপ, এটা বোঝার জন্য বাচ্চারা যথেষ্ট পরিপক্ব না। তাই শিশুকে খাওয়ানোর ক্ষেত্রে ধৈর্য রাখতে হবে। বড়দের মতো ঝটপট শিশুরা খাবে না, এটা আপনাকেও বুঝতে হবে। ধৈর্য রাখলে আপনার শিশু খাবারদাবার বিষয়ে এই খুঁতখুঁতে আচরণ থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসবে।
বাচ্চার না খাওয়া নিয়ে বাবা-মায়ের ধ্যান ধারনা
অধিকাংশ বাবা-মায়েরা ধারনা করে থাকেন তাদের বাচ্চা খাচ্ছে না মোটেই, বিশেষ করে শহরের ফ্লাট বন্দি বাবা-মায়েরা। আর এই সমস্যা এখনকার সমাজে একটা সংক্রামক পর্যায়ে চলে গেছে। এ ব্যাপারে তারা যেটা বলে থাকেন- আমার বাচ্চা তো কিছুই খায় না।
আশেপাশের মানুষ কি বলে
আপনার বাচ্চা খাচ্ছে না- একথা শুনে আশেপাশের মানুষ কি বলে? তারা বলবে- না খেলে বাচ্চা বেঁচে আছে কিভাবে? কিংবা বলে আগেকার জামানায় মায়েদের অনেকগুলো বাচ্চা সামলাতে হত তাই কে খেল আর কোনটা না খেয়ে আছে দেখার সুযোগই পেত না। এখনকার মায়েদের যেহেতু একটি বা দুইটি বাচ্চা তাই সারাদিন এদের পেছনেই লেগে থাকে। কেওবা বলে- একদিন না খাইয়ে রাখুন পরের দিন দেখবেন এমনি এমনি খাবার চেয়ে খাবে।
উপরের কথাগুলো একদিকে যেমন সঠিক আবার এর মাঝে ভুলও আছে। একটু পরেই সেটা নিয়ে আলোচনা করছি।আপনার বাচ্চা খেতে না চাইলে কি করবেন জানতে পড়তে থাকুন।
আসুন জেনে নেই মানুষের ক্ষুধা কেন লাগে
একজন মানুষের খাওয়া আর না খাওয়ার পুরো ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রন করে মস্তিস্কের হাইপোথ্যালামাসে থাকা দুইটি অংশ- ফিডিং সেন্টার আর স্যাটাইটি সেন্টার। পেট খালি হলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায় আর মস্তিস্কের ফিডিং সেন্টার উত্তেজিত হয়ে সিগন্যাল প্রদান করে আর আমরা ক্ষুধাবোধ করি এবং খাবার খাই। আর পেট ভর্তি থাকলে, রক্তে গ্লূকোজের মাত্রা যথেষ্ট থাকলে স্যাটাইটি সেন্টারের উত্তেজনার কারণে সিগন্যাল প্রদান করে এবং আমরা খাওয়া বন্ধ করি। এটা একটা স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এখানে একটা কথা থেকে যায়।
অটোমেটিক নার্ভাস সিস্টেম অন্যকোন নির্দিষ্ট সিগন্যালের কারনে উত্তেজনা তৈরি করে স্যাটাইটি সেন্টার সিগন্যাল প্রদান করতে পারে, সেক্ষেত্রে পেট খালি থাকলেও মস্তিস্কের ফিডিং সেন্টার সিগন্যাল দেবেনা ক্ষুধার। বরং দেখা দেবে উদ্বেগ কিংবা উত্তেজনা। এছাড়া শুধু স্যাটাইটি সেন্টার নয় ক্ষুধার জন্য আরও কিছু নিয়ামক আছে যেমন মনের অবস্থা, পরিবেশ, পরিবার ইত্যাদি।
আপনার বাচ্চা খেতে না চাইলে কি করবেন, জানুন।
ছবি: প্রথম আলো