শিশুরা
অনুকরণপ্রিয়। মায়ের মতো কানে দুল ঝোলাতে চাইবে ছোট্ট মেয়েটি। কিংবা
স্কুলের বন্ধু হয়তো কান ফুঁড়িয়েছে, এই সময় তারও চাই এক জোড়া দুল। বড়দের
জীবনে অনেক জোড়া দুল যে আনন্দ আনতে পারে না, শিশুর জন্য এক জোড়া দুলই
তা নিয়ে আসে। এই দুলের জন্য কান ফোঁড়াতে হবে।
কান ফোঁড়ানোর আনন্দের মধ্যেও অবশ্য কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে
হবে মা-বাবাকে। শিশু যেন কান ফোঁড়ানো নিয়ে কোনো ঝক্কিতে না পড়ে। রাজধানীর
আজগর আলী হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিভাগের পরামর্শক অধ্যাপক ডা. মো.
জাহেদুল আলম বলেন, ‘কান ফোঁড়ানোকে সাধারণভাবে আমরা কোনো কিছু মনেই করি না।
কিন্তু এটি ছোটখাটো অস্ত্রোপচার। তাই কিছু বিষয়ে সতর্কতা জরুরি।’
রেড বিউটি স্যালনের রূপবিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বলেন,
আদরের মেয়েটির কানে প্রথমবারের মতো দুল পরানো মা-বাবার অনেক শখের একটা
বিষয়। অনেকে এটিকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠানও করেন। তবে কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে
হবে বলে জানালেন তিনিও।
কান ফোঁড়ানোর আদ্যোপান্ত
কানের কোন অংশ ফোঁড়ানো হচ্ছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ বলে
জানালেন অধ্যাপক মো. জাহেদুল আলম। তিনি বললেন, কানের নরম অংশের (লতি)
মাঝামাঝি জায়গায় ফোঁড়ানো উচিত। অনেকে কানের লতি ছাড়াও অন্যান্য অংশে
ফুঁড়িয়ে থাকেন, যা আসলে পরিহার করাই ভালো। কানের লতি ছাড়া অন্য অংশে
ফোঁড়ানোর সময় কানের তরুণাস্থি আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যার ফলে
মারাত্মক প্রদাহ হতে পারে। পরবর্তী সময়ে কানের আকৃতি নষ্ট হয়ে গিয়ে এমন
পরিস্থিতি দাঁড়াতে পারে, যা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। তখন আর কানে অলংকার পরার
কথা ভাবার অবস্থাও থাকে না। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা এড়াতে অবশ্যই কানের
লতি ছাড়া অন্য অংশ ফোঁড়ানো থেকে বিরত থাকা উচিত, যাতে কানের তরুণাস্থিতে
কোনোভাবেই আঘাত না লাগে।
যা দিয়ে কান ফোঁড়ানো হচ্ছে, তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও
জীবাণুমুক্ত কি না, তা নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। কান ফোঁড়ানোর যন্ত্র বা
পিয়ার্সিং গান দিয়ে বিউটি পারলারে কান ফোঁড়ানো হয়ে থাকে। এই যন্ত্রে যে
দুলজোড়া দেওয়া হচ্ছে, তা যদি একই কনটেইনারে রাখা অনেকগুলো দুল থেকে তুলে
নেওয়া হয়, তাহলে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যায়। তাই একটি সিলগালা
কনটেইনারে এক জোড়া দুল আছে, এমন দুল বেছে নেওয়া ভালো।
যে সুইয়ের সাহায্যে কান ফোঁড়ানো হচ্ছে তা যেন পুরোপুরি
জীবাণুমুক্ত হয়। আর একই সুই একাধিক ব্যক্তির জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়
কখনোই। কারণ, একজনের রক্তে জীবাণু থাকলে তার শরীরে ব্যবহৃত সুইয়ের মাধ্যমে
অন্য কারও রক্তে সেই জীবাণু পৌঁছে যেতে পারে অনায়াসেই। হেপাটাইটিস বি, সি
(এটির টিকাও নেই) এবং এইচআইভি নামক ভাইরাস (এটি এইডসের কারণ) রক্তের
মাধ্যমে ছড়াতে পারে। তাই ব্যবহৃত সুই পুনর্ব্যবহার করবেন না।
শিশুদের মানায় গোল দুলখুব
কম বয়সে কান ফোঁড়ানো ঠিক নয়। সাধারণত ৫-৭ বছর বয়সে কান ফোঁড়ানো হয়ে থাকে।
এই বয়সটা সব দিক থেকেই ভালো। শিশু ব্যথা পেতে পারে কান ফোঁড়ানোর সময়।
সুইয়ের চেয়ে ‘পিয়ার্সিং গান’ ব্যবহারে ব্যথা কম হয়।
সচরাচর যে ধরনের পদার্থে অ্যালার্জি হয় না, তা দিয়ে কান
ফোঁড়ানো উচিত। কানের দুলের বেলায়ও একই কথা। প্রচলিত নানান ধরনের ধাতব
পদার্থের মধ্যে সোনার কানের দুল ব্যবহার করাই বেশি নিরাপদ। তবে অন্যান্য
ধাতব পদার্থ যদি নন-ইরিট্যান্ট হয়, যেগুলোতে অ্যালার্জি হওয়ার প্রবণতা কম,
সেগুলোও পরানো যেতে পারে।
কান ফোঁড়ানোর পর
‘পিয়ার্সিং গান’-এর সাহায্যে যে টপ জাতীয় দুলটি পরানো হয়,
তা ৩-৫ দিন পর খুলে ফেলে রিং পরিয়ে দেওয়া উচিত। এর ফলে ফোঁড়ানোর স্থানটি
আর চেপে থাকে না বা ঢেকে থাকে না। ফলে স্থানটি ভালোভাবে শুকিয়ে যাওয়ার
সুযোগ পায়। কান ফোঁড়ানোর পর তা না শুকানো পর্যন্ত শিশুকে নিয়মিত ভিটামিন
সি–সমৃদ্ধ খাবার (টক ফলমূল) খাওয়ানো উচিত। এতে ক্ষতস্থান দ্রুত নিরাময় হয়।
জটিলতা
যথাযথ নিয়ম মেনে কান ফোঁড়ানো না হলে ফোঁড়ানোর স্থানে
জীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে কান ফোঁড়ানোর বেশ কিছুদিন পর শক্ত
গোটা হতে দেখা যায়। এ ধরনের জটিলতা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ছোট্ট শিশুর কানে রিং জাতীয় দুলই বেশি মানায় বলে জানালেন
আফরোজা পারভীন। কেউ হয়তো সাদামাটা রিং পছন্দ করেন, কেউ পছন্দ করেন
চ্যাপ্টা ও চওড়া ধাঁচের রিং। কারও পছন্দ চিকন রিং, কেউ আবার রিং-এর মধ্যে
ছোট্ট ছোট্ট গুটলির মতো নকশা পছন্দ করেন। এমন যেকোনো ধরনের রিং-এ ছোট্ট
মেয়েদের সুন্দর দেখায়, রিং কানে রাখাটাও ওদের জন্য সহজ। কানের টপ বা
ঝোলানো দুলে ছোট্ট শিশুকে খুব একটা মানায় না। তবে চাইলে কেউ তা পরাতেও
পারেন, এটি একেবারেই মা-বাবার ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। কেউ হয়তো হিরের টপ
দেখতে চান মেয়ের কানে। তবে বড়দের মতো নকশাদার দুল শিশুদের জন্য মানানসই
নয়। শিশুদের হালকা কানের দুল পরানো উচিত।
দোকানপাটে
সোনার দোকানে দুলের ওজন অনুযায়ী দামের তারতম্য হয়ে থাকে। দোকানের সংগ্রহ পছন্দ না হলে অর্ডার দিয়ে গড়িয়েও নিতে পারেন। ২১ বা ২২ ক্যারেট স্বর্ণের জন্য ৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ পড়তে পারে বলে জানা গেল বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের নন্দন জুয়েলার্স লিমিটেড ও দি মিনা জুয়েলার্সে কথা বলে। কান ফোঁড়ানোর স্থানটি পুরোপুরি সেরে যাওয়ার অনেক দিন পর শখ করে শিশুকে ইমিটেশনের কানের দুল পরিয়ে থাকেন কেউ কেউ। এ রকমটা ইচ্ছে হলে কে জেড বা জেমস গ্যালারিতে খোঁজ নিতে পারেন। ফুলেল নকশা বা হৃদয়ের আকৃতির কানের দুল বেছে নিতে পারেন। ছোট পাথরের এসব দুল পাবেন আরও নানান দোকানেই। কে জেড-এ ২ জোড়া টপ ও ১ জোড়া হালকা ঝোলানো কানের দুলের সেট পাবেন ১৫০ টাকায়। জেমস গ্যালারিতে ছোট টপ পাবেন ২৫০ টাকায়।
মৌয়ের
হতদরিদ্র বাবা হোটেল বেয়ারা হিসেবে কাজ করে দিনে আয় করেন ৭০ থেকে ৮০
টাকা। ৮ বছরের মৌকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালেও ঘুরেছেন। মেয়ের হার্টের ছিদ্র
বন্ধ করতে হবে। খরচ তো ম্যালা। দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে মেয়েটি। হোটেলের
কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপনে
চোখ আটকে যায় এই বাবার। কোনো রকম কাটাছেঁড়া ছাড়াই শিশুদের হার্টের
ছিদ্র বন্ধ করা হচ্ছে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে। ডিভাইস মিলবে বিনা
মূল্যে। মাত্র ৫৫ হাজার টাকার প্যাকেজ। এই বাবা দ্রুত যোগাযোগ করেছিলেন।
দেখলাম, শোকে–দুঃখে নুয়ে পড়া বাবা শীর্ণকায় মেয়েটিকে নিয়ে ঢুকলেন। এই
প্যাকেজে মেয়ের হার্টের ছিদ্রটি ডিভাইসের মাধ্যমে বন্ধ করা হলো।
শুধু মৌ নয়। ২০১৭ সালের ৮ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত মৌয়ের মতো
আর্থিক অবস্থায় থাকা ৭০টি শিশুর হার্টের ছিদ্র বন্ধ করা হয়েছে
স্বল্পমূল্যে। সরুভালভ ও সরু রক্তনালি ও বেলুনের মাধ্যমে ফুলিয়ে স্বাভাবিক
করা হচ্ছে এই হাসপাতালের স্বল্পমূল্যের প্যাকেজে। সেন্টার ফর জাকাত
ম্যানেজমেন্ট সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
দিনটি ছিল ২০১৭ সালের ৬ মার্চ। দুই বছরের নাহিয়ান মায়ের দুধ টেনে খেতে গেলে হাঁপিয়ে যেত। কপাল ঘেমে যেত। একটু বড় হলে খাবার খেতে গেলে শ্বাস কষ্ট হতো। বুকের পাঁজর দেবে যেত। বারবার নিউমোনিয়ার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হতো, ওজনও কম ছিল। নাহিয়ানের বাবা কিছুদিন আগে মারা গেছেন ক্যানসারে। এ রকম পরিস্থিতিতে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক মা জানতে পারলেন, নাহিয়ানের হার্টে বড় একটি ছিদ্র। ইকো পরীক্ষা করে দেখলাম ছিদ্রটি অস্ত্রোপচার ছাড়া ডিভাইস দিয়ে বন্ধ করা যাবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নাহিয়ানকে দিয়েই হাসপাতালে শুরু হলো স্বল্পমূল্যের প্যাকেজটি। নাহিয়ানের ছিদ্র বন্ধ করা হলে পরের দিনই মা ও ছেলে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরলেন।
শিশুদের জন্মগত ছিদ্রগুলো (ASD, VSD, PDA) বন্ধ করার
ডিভাইস বা বোতামের দাম প্রায় দেড় থেকে তিন লাখ টাকা। হাসপাতালে দুই দিন
থাকা ও প্রসিডিউরের খরচও প্রায় ৯০ হাজার টাকা। নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত
মা–বাবার কাছে এ টাকা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমি একটি প্যাকেজ তৈরি করলাম এবং
হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে হাসপাতালের প্রধান পরিচালন
কর্মকর্তা চিকিৎসক রত্নদ্বীপ চাসকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য চালু হলো ৫৫ হাজার টাকার প্যাকেজ, যা ছিল ৯০
হাজার টাকা। কিন্তু ডিভাইসের খরচ তো আছে, এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। আমি
আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুজন ও হাসপাতালের কিছু সুহৃদয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা
বললে অনেকেই এগিয়ে এলেন, ডিভাইসের খরচও জোগাড় হয়ে গেল। আমি বিভিন্ন
সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে গিয়ে নব্য চিকিৎসকদের জানানোর জন্য
প্রচার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তাঁরা সময় মতো একজন শিশুকে হৃদ্রোগ
বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠালে শিশুর জীবন বাঁচানো সম্ভব।
আমি সরকারি হাসপাতালে কাজ করতে পারিনি। পেডিয়াট্রিকসে
(শিশু রোগ) উচ্চতর ডিগ্রি ডিসিএইচ ও এফসিপিএস অর্জন করার পর
সাব-স্পেশালিটি করার তাগিদ অনুভব করেছি পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিতে। এই
পরিসরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক কম।
ভারতের নারায়না হৃদয়ালয়া হাসপাতালে প্রশিক্ষণ, একটানা
বেঙ্গালোর, জয়পুর, কলকাতা হৃদয়ালায়া হাসপাতাল ও ন্যাশনাল
ইউনিভার্সিটি-সিঙ্গাপুরে (এনইউএইচএস) কাজ করার সুযোগ হয়েছে আমার। দেখেছি,
জমি, গয়না বিক্রি করে হলেও বাংলাদেশের মা–বাবারা তাঁদের সোনামণির চিকিৎসা
করাতে এসেছেন অন্য দেশে। তিন বছর প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশে ফিরে এই শিশুদের
পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম।
এই শিশুদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে নিজের ছেলেমেয়েকেও সেভাবে
সময় দিতে পারিনি। ২০১১ সালের মাঝামাঝি মেয়েটি ষষ্ঠ শ্রেণি ও ছেলেটি পঞ্চম
শ্রেণিতে পড়ে। ছেলেটি রাতে জেগে বসে থাকত কখন আমি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে
ওকে মুখে তুলে খাইয়ে দেব। মেয়েটি বসে থাকত সারা দিনের গল্পের ঝুড়ি নিয়ে।
দেশের বাইরে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে প্রথম প্রথম ঘুমের মধ্যে হাত বাড়িয়ে
দিতাম ছেলেকে খাইয়ে দেব বলে। ঘুম ভেঙে ডুকরে কাঁদতাম। আবার শক্ত মনে সকালেই
হাসিমুখে কাজ শুরু করেছি। দেশে ফিরে করপোরেট হাসপাতালে কাজ শুরু করাটা
যেমন আশীর্বাদ ছিল, তেমনি ছিল চ্যালেঞ্জিং বা যুদ্ধ করা। তবে আমার সৌভাগ্য
যে, হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ আমাকে বিশ্বমানের ইকো মেশিন ও ক্যাথল্যাবসহ সব
সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন। কিন্তু সব সময় মাথায় ছিল, আমি তো চিকিৎসা দিচ্ছি
তাঁদের, যাঁরা দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারেন। কিন্তু যাঁরা এই
হাসপাতালের নাম শুনলেই ভয়ে আমার কাছে আসতে পারছে না, তাঁদের কাছে তো আমাকে
পৌঁছাতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কাছে পৌঁছানোর জন্য আমার প্রতিষ্ঠান
যেমন পাশে ছিল, তেমনি পাশে পেয়েছি আমার স্বামী ব্যবসায়ী সৈয়দ সালমান হাবীব,
মা, শাশুড়ি ও বাচ্চাদের।
তাহেরা নাজরীন, শিশু হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ, ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড ইন্টারভেনশনাল পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট কনসালট্যান্ট, অ্যাপোলো হাসপাতাল, ঢাকা
সহপাঠীদের সাহসিকতায় বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পেয়েছে সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার মধ্যনগর পাবলিক বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী মিতু মালাকার (১৪)। এই প্রশংসনীয় কাজ করায় ওই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ২৭ জন শিক্ষার্থীকে গত ২৯ নভেম্বর 2016 মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠানে বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পাওয়া মিতু মালাকারের পড়াশুনার খরচ দেওয়ার ঘোষণা দেন উপজেলার মধ্যনগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান প্রবীর বিজয় তালুকদার।
সহপাঠীদের সাহসিকতা
মিতুর সহপাঠী সোনালী সরকার ১৯ নভেম্বর বিকেলে গিয়েছিল তার
এক আত্মীয়ের বাড়ি। সেখানে গিয়ে প্রতিবেশীদের মুখে জানতে পারে, মিতুর বিয়ে
ঠিক হয়েছে ২১ নভেম্বর সোমবার সন্ধ্যায়। বর নেত্রকোনার সদর উপজেলার
ঠাকুরাকোনা এলাকার এক যুবক। ২০ নভেম্বর সকালে সোনালী বিদ্যালয়ে এসে তার
বান্ধবী পপি দাসকে বিয়ের ঘটনাটি জানায়। পপি জানায় আরেক সহপাঠী হরি প্রিয়া
সেনকে।
‘আমার সহপাঠীরা আমার বিয়ে বন্ধ করে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছে। আমি আরও লেখাপড়া করতে চাই।’
মিতুর সহপাঠীরা আলোচনা করে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূরুল
ইসলামকে ঘটনাটি জানায়। হরি প্রিয়া সেনের নেতৃত্বে ওই বিদ্যালয়ের নবম
শ্রেণির ২৭ জন শিক্ষার্থী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান প্রবীর
বিজয় তালুকদারের কাছে এসে মিতুর বিয়ে বন্ধ করতে অনুরোধ করে। তখন
চেয়ারম্যান বিয়ে বন্ধের আশ্বাস দেন।
এরপর বিকেলে সহপাঠীরা মিতুদের বাড়িতে যায়। সেখানে গিয়ে তারা মিতুর সঙ্গে কথা বলে। তারা বিয়ে থামাতে মিতুর মা-বাবাকে একই অনুরোধ করে। ২০ নভেম্বর সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান প্রবীর বিজয় তালুকদার স্থানীয় এক ইউপি সদস্যকে মিতুদের বাড়িতে পাঠিয়ে তার বাবাকে ইউনিয়ন পরিষদে ডেকে পাঠান। মিতুর বাবা ইউনিয়ন পরিষদে এসে বিয়ের আয়োজনের কথা স্বীকার করেন এবং এ জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। এমনকি তাঁর মেয়েকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে দেবেন না বলেও লিখিতভাবে অঙ্গীকার করেন।
সোনালী সরকার বলে, ‘কী জানি কী হয়ে যায়, সেই ভয়ে এই
বাল্যবিবাহের খবরটি প্রকাশ করতে পারছিলাম না। পরে ভাবলাম, যা হওয়ার হবে,
তাই বলে বান্ধবীর জীবন তো আর ধ্বংস হতে দিতে পারি না। এ কথা ভেবে বান্ধবী
পপিকে বিয়ের খবরটি জানিয়ে দিই।’
মধ্যনগর ইউপির চেয়ারম্যান প্রবীর বিজয় তালুকদার বলেন,
‘ঘটনাটি সারা দেশের মানুষের কাছে অন্যতম একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। মিতুদের
পরিবারটি খুবই দরিদ্র হওয়ায় আমি এখন থেকে তার ভবিষ্যতে লেখাপড়ার যাবতীয়
ব্যয়ভার মেটানোর দায়িত্ব নিয়েছি।’
বাল্যবিবাহ থেকে রক্ষা পাওয়া শিক্ষার্থী মিতু মালাকার
জানায়, ‘আমার সহপাঠীরা আমার বিয়ে বন্ধ করে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন
দেখিয়েছে। আমি আরও লেখাপড়া করতে চাই। আমার সহপাঠীদের কাছে আমি চিরঋণী।’
মধ্যনগর পাবলিক বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূরুল
ইসলাম বলেন, ‘আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এতে খুবই অনুপ্রেরণা পেয়েছে।
এর ফলে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এখন অনেকেই এগিয়ে আসবে বলে আমি মনে করি।’
তিনি এ জন্য উপজেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানান।
গত ২১ নভেম্বর প্রথম আলোয় ‘বাল্যবিবাহ ঠেকাতে এগিয়ে এল সহপাঠীরা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
টাকাভর্তি ব্যাগ কুড়িয়ে পেয়েছিল মম মল্লিক। তারপর পুলিশের সহযোগিতায় ফিরিয়ে দিয়েছে প্রকৃত মালিকের কাছে। নবম শ্রেণিপড়ুয়া মমর এই সততার কাহিনি এখন এলাকার সবার জানা।
খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের হাটবাটী গ্রামে ঢুকেই
দেখা যায় সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে কয়েকজন মানুষ গল্প করছেন। তাঁদের কাছে জানতে
চাওয়া হয় মম মল্লিকের বাড়ির ঠিকানা। এর মধ্যে একজন বলে ওঠেন, ‘যে দুই লাখ
টাকা পেয়ে ফেরত দিয়েছে সেই মম?’ সম্মতিসূচক বাক্যের পর তাঁরা দেখিয়ে
দেন—কোথায়, কীভাবে মমদের বাড়িতে যেতে হবে।
ওই এলাকার এখন প্রায়
সবাই চেনে মম মল্লিককে। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছোট ওই মেয়েটিই এখন ঘুরেফিরে
এলাকার মানুষের আলোচনার বিষয়। কয়েক দিন আগে ব্যাগভর্তি টাকা পেয়েও তা
মালিককে ফেরত দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে সে। ঘটনাটি শুধু গ্রাম
নয়, ছড়িয়ে গেছে আশপাশের বিভিন্ন এলাকাতেও।
তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট মম মল্লিক। হোগলবুনিয়া-হাটবাটী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে বাণিজ্য শাখায়। বাবা শংকর কুমার মল্লিক একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য। কুড়িয়ে পাওয়া ব্যাগভর্তি টাকা ফেরত দেওয়ার পর ব্যাপক প্রশংসায় ভাসছে মম।
ঘটনাটি ৯ সেপ্টেম্বর সকালের। খুব স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছিল দিনটি। অন্য দিনের মতো সকালে ঘুম থেকে উঠেই প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার তাড়া শুরু হয়। পৌনে আটটার মধ্যে যেতে হবে কয়েক মাইল দূরের সেই শিক্ষকের বাড়িতে। এ কারণে তাড়াও বেশি।
বাড়ি থেকে বেরিয়েই ভ্যানে ওঠে মম। ভ্যানচালক ছিলেন বয়স্ক
একজন। বাড়ির সামনে থেকে ভ্যানে ওঠার সময় ছিল দুজন। বটিয়াঘাটা বাজারেই নেমে
যায় অন্যরা। বাজার পার হয়ে কিছুদূর যেতেই চোখে পড়ে রাস্তার ধারে একটি ছোট
খয়েরি রঙের ব্যাগ পড়ে আছে। ব্যাগটি পড়ে থাকতে দেখেই সন্দেহ হয়। সেই সন্দেহ
থেকেই ভ্যানচালককে দাঁড় করায় সে। ব্যাগটি কুড়িয়ে চেইন খুলে দেখে তাতে অনেক
টাকা। রয়েছে কিছু কাগজপত্রও। সাতপাঁচ না ভেবে ব্যাগটি নিয়ে ভ্যানে ওঠে।
কিছুদূর পরই বটিয়াঘাটা থানা। ব্যাগটি নিয়ে থানার মধ্যে ঢোকে। এ সময় সেখানে
গিয়ে দেখে যাঁদের ব্যাগ হারিয়েছে, তাঁরা দুজন সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যদের
সঙ্গে ব্যাগ হারানোর ব্যাপারে কথা বলছেন। এ সময় তাঁদের সামনে ওই ব্যাগ তুলে
ধরা হলে তাঁরাই জানান ওই ব্যাগে দুই লাখ টাকা রয়েছে। জমি কিনতে উপজেলা
সাবরেজিস্ট্রি অফিসে টাকা নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা। তাড়াহুড়ায় দুটি ব্যাগের
একটি পড়ে যায়। ব্যাগের মধ্যে থাকা কাগজপত্রের প্রমাণ দিয়ে ওই ব্যক্তিরা
ব্যাগটি নিয়ে চলে যান। যাওয়ার সময় জোর করে কিছু টাকা বকশিশ দিয়ে যান মমকে।
মমর বাবা পুলিশ সদস্য হওয়ায় বাবার কাছে বিভিন্ন সময় শুনেছেন
নিরাপদ জায়গা হলো থানা। এ কারণে ব্যাগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থানায় যাওয়ার কথা
মাথায় আসে তার। এ ব্যাপারে অভিভাবকসহ কারও সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হতে
পারে বা অন্য কোনো বিপদ হতে পারে, সে কথা একবারের জন্যও চিন্তা করেনি মম।
এমনকি প্রাইভেট পড়তে গিয়ে সেখানকার কারও সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে আলাপও করেনি
সে। পরে বাড়িতে গিয়ে মায়ের কাছে সবকিছু খুলে বলে।
মম মল্লিকের ভাষায়, ‘কুড়িয়ে পাওয়া ব্যাগটি তার মালিকের কাছে
ফেরত দেওয়া আমার দায়িত্ব ছিল, আমি সেটিই করেছি। এখানে অন্য কিছু ভাবাভাবি
বা কারও সঙ্গে আলাপ করার কথা একবারের জন্য চিন্তাও হয়নি।’
প্রথম থেকেই স্কুলের সহপাঠীদের কাছে খুবই প্রিয় মম। জেএসসি
পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়েছে সে। সাম্প্রতিক ওই ঘটনা সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে
তার মর্যাদা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাণিজ্য শাখায় পড়া মম বড় হয়ে বিসিএস
ক্যাডার হতে চায়। এ ছাড়া চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার স্বপ্নও দেখে
সে।
চটপটে ও সরল মনের মমকে নিয়ে গর্ব করেন ওই স্কুলের প্রধান
শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকেরা। ঘটনাটি জানার পর ফেসবুকে পোস্ট করেন প্রধান
শিক্ষক। এরপর সেটি দ্রুত আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মধ্যে। মম যে কাজ
করেছে তা একটি বিরল দৃষ্টান্ত, বলছিলেন প্রধান শিক্ষক অন্নদা শংকর রায়।
স্কুলে প্রতিদিন দুটি শপথ পড়ানো হয়। একটি দেশের শপথ ও অন্যটি সততার শপথ। ওই
সততার শপথ থেকেই শিক্ষার্থীরা ভালো কাজে উৎসাহিত হচ্ছে বলে মনে করেন
প্রধান শিক্ষক। লোভ নয়, ভালো কাজ করেও যে তৃপ্তি পাওয়া যায় সেটিই দেখিয়ে
দিয়েছে মম।
১৯৭৮ সালের দিকে পুলিশ সদস্য থাকাকালে একবার ব্রিফকেস–ভর্তি
টাকা পেয়েছিলেন মমর বাবা শংকর মল্লিক। তখন তিনি কর্মরত ছিলেন ঢাকার
সূত্রাপুর থানায়। ব্রিফকেসসহ ওই টাকা জমা দেন থানায়। পরে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন
দিয়ে টাকার মালিক খোঁজা হয়। সন্ধান পেয়ে থানায় গিয়ে উপযুক্ত প্রমাণ দিয়ে
ব্রিফকেসসহ টাকা নিয়ে যান মালিক। বিভিন্ন সময় বাবার কাছে ওই গল্প শুনেছে
মম। তাই বাবার মতো মেয়ের মনেও সততার ছোঁয়া লেগেছে বলে মনে করছেন মমর বাবা।
এমন মেয়ের জন্য গর্ব করেন তিনি।
বিশ্বের ১৮৫টি দেশ ও অঞ্চলে হানা দিয়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। এখন
পর্যন্ত ২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৩২ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন এবং মারা গেছে ১১
হাজার ৩৯৮ জন। এরই মধ্যে চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৯১ হাজার ৯১২
জন।
এদিকে, চীনে শিশুদের মাঝে সংক্রমণের হার কম থাকলেও ইউরোপে শিশুদের
আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। অনেক বাবা-মায়েরা তাদের শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে
উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
করোনা লক্ষণগুলো কি শিশুদের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো? না-কি আলাদা হবে সেটা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন।
শিশুদের করোনাভাইরাসের লক্ষণ
সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের (সিডিসি) মতে, বাচ্চাদের মধ্যে করোনাভাইরাসের লক্ষণগুলো প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যেসব লক্ষণ দেখা যায় সেই একইরকম। ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুদের মাঝে এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হালকা লক্ষণ সমুহ দেখা যাচ্ছে।
তবে সিডিসির ওয়েবসাইটে আরও বলা হয়েছে যে, এই রোগ সম্পর্কে আমরা এখনও
পুরোপুরি জানি না। আমাদের এখনও অনেক কিছু শিখতে হবে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর
প্রকৃত লক্ষণগুলো কী সেটা এখনও জানা যায়নি। সুতরাং, ঝুঁকি না নিয়ে শিশুদের
সাবধানে রাখতে হবে। কোনোভাবেই যেন তাদের করোনায় আক্রান্ত না করতে পারে
সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। কারণ শিশুদের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে
শনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ায় এটা তাদের জীবনের জন্য গুরুতর ঝুঁকির সৃষ্টি
করতে পারে।
ওয়েবসাইটটিতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চিত কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুদের
মাঝে সাধারণত হালকা লক্ষণগুলো দেখা যায়। এরমধ্যে রয়েছে-জ্বর, সর্দি, শুষ্ক
কাশি ইত্যাদির মতো ঠান্ডা জাতীয় লক্ষণ। কিছু কিছু শিশুর ক্ষেত্রে বমি ও
ডায়রিয়ারও খবর পাওয়া গেছে।
নেত্রকোনা সদর উপজেলায় বাল্যবিবাহ বন্ধ করে দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মধ্যেও গতকাল রোববার বেলা দুইটা থেকে তাদের বাল্যবিবাহের (আইনত নিষিদ্ধ) প্রস্তুতি চলছিল।
ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্র বলছে, বরের বয়স ১৬ বছর আর কনের ১৫ বছর।
স্থানীয় লোকজন ও প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, তারা একই মাদ্রাসায় ভিন্ন শ্রেণিতে পড়ে। বর এবার দশম শ্রেণিতে, কনে অষ্টম শ্রেণিতে।
অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় বর আগেভাগে কনের বাড়িতে এসে একটি কক্ষে লুকিয়ে থাকে। পরে সন্ধ্যার দিকে বরের বাড়ির লোকজন কনের বাড়িতে আসে। আপ্যায়ন ও খাওয়াদাওয়া শেষে রাত আটটার দিকে বিয়ে সম্পন্ন করতে কাজির অপেক্ষায় থাকেন দুই পক্ষের লোকজন। এ সময় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুর রহিম বিয়েবাড়িতে গিয়ে হাজির হন। কিন্তু তাঁর অনুরোধে বিয়ে বন্ধ করতে রাজি হয়নি বর ও কনের পরিবার। কিছুক্ষণ পর জেলা প্রশাসক মঈনুল ইসলামের নির্দেশে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বুলবুল আহমেদ গিয়ে হাজির হন ওই বাড়িতে। পরে তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বিয়েটি বন্ধ করেন।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময়েও লোকসমাগম করে বাল্যবিবাহের এই আয়োজনের খবর স্থানীয় এক যুবক গণমাধ্যমকর্মীদের জানান। পরে তা জেলা প্রশাসককে জানানো হয়। জেলা প্রশাসক স্থানীয় ইউপির চেয়ারম্যানকে বিয়েটি বন্ধের জন্য অনুরোধ জানান। রাত আটটার দিকে চেয়ারম্যান গ্রাম পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে বিয়েবাড়িতে গিয়ে দুই পক্ষকে বিয়েটি বন্ধের অনুরোধ জানান। কিন্তু বর ও কনের লোকজন তা মানতে রাজি না হলে রাত সাড়ে আটটার দিকে সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) পুলিশ নিয়ে হাজির হন।
ওই কর্মকর্তাও প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে বর-কনেকে বাল্যবিবাহের কুফল সমন্ধে বোঝান। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসালে আদালতের কাছে বর-কনেসহ দুই পরিবার দোষ স্বীকার করে। প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দেবে না মর্মে আদালত দুই পক্ষের কাছে মুচলেকা আদায় করে বিয়েটি বন্ধ করেন।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) বুলবুল আহমেদ প্রথম আলোকে এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বিয়েতে অর্ধশতাধিক লোকের সমাগম হয়।
দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে ৮ বছরের এক শিশুকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। শিশুর শরীরে জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টের লক্ষণ দেখে তার অভিভাবকেরা গতকাল সোমবার দুপুরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান।
বিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সোলায়মান হোসেন আজ মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটির অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তার শরীরের তাপমাত্রা কমেছে। তার শরীরের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। আজ বিকেলের মধ্যে সংগৃহীত নমুনা ঢাকায় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হবে।
দিনাজপুরের সিভিল সার্জন মো. আবদুল কুদ্দুস জানান, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে দিনাজপুরে এই প্রথম কাউকে আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। শিশুটির নমুনা আইইডিসিআরে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
হর্নের শব্দ আর হর্নের শব্দ, কিছুই মাথায় আসে না, প্রতিদিন এই শব্দের শিকার হতে হতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে আমার কানটা, কানটা আমায় মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে ‘তুই আমার জন্য কি করেছিস, পেরেছিস কোনো খুশির বাক্য আমার দ্বারা গমন করাতে? যতবার তুই তমা’কে বলেছিস তুই বিস্তৃত রোদে মাখা বালুকনার অভ্যন্তরে থাকা ভেজা বালুর মতো মিথ্যেবাদী নস, তুই যতবারই সত্যি প্রকাশ করতে গিয়েছিলি ততবারই আমাকে গ্রহণ করিয়েছিস এক একটি তিক্ত কথা, তোর বরঞ্চ মঙ্গল কামনা করা উচিত যে আজো তোর কর্ণগোচর করায় সমস্যা উপলব্ধি হচ্ছে না!’ উহহহ কান যা ভাবায় না আমায়, তবে এগুলাও সেই হর্ণের শব্দের ন্যায় অভ্যাস হয়ে গেছে হয়তো! কিন্তু এমন অভ্যাস তো আমার ছিলো না, ১ তালায় থাকার সময়েও তো হর্ণে জোরালো শব্দে মস্তিষ্কে বিষ ধরে যেতো না! যাই হোক এখন ৬ তলায় থাকি তাও হালকা এবং অভ্যাস হয়ে যাওয়া হর্ণের শব্দে প্রতিদিনকার ন্যায় আজো ঘুম ভেঙে গেলো!
এখন আর কফি,চা কিছুই খাই না অথচ সেসময়টাতে খালি কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে যেতাম উঁকি মারতাম ঠিক বা পাশের দোতলায় বেলকুনির দিকে! থাক এসব ভেবে এই সময়টা নষ্ট করবার নয়, সময় যতটুকু নষ্ট হয়েছে সেটুকুতে মুখ ধোয়া শেষ করে কেনো যেনো আজ তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জানালার পাশ কাটিয়ে পাশের রুম পেরিয়ে চলে গেলাম বারান্দায়, বারান্দাটা মেহরাবের রুমের সাথে! বারান্দার পাশের রুমটা মেহরাবকে দেয়ার অবশ্য তীক্ষ্ণ হলেও কিছু কারণ ছিলো, মূলত বারান্দায় যাওয়ার অভ্যাসটাকে বাদ দিয়ে এখন বারান্দায় না যাওয়ার বদ অভ্যেস করার প্রয়াসেই আছি! আমি কি আজ সত্যিই বারান্দায় এসেছি, গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা তানবিন নামের ২৫ বছরের ছেলেটি কি সত্যি সত্যিই আমি
নাকি আমি আবার আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি আমায় ছেড়ে উড়াল দেয়া মানুষটার কথা, যাকে ফিরে পাবার কথা মনে করাটা অনেকটা গুলিস্তানে মানিব্যাগ হারিয়ে পরদিবসে খুজতে যাওয়ার ন্যায়! যাই হোক আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেক ভাবনা মেলাতে পারলাম, মিলাতে পারলাম যে পাখি মেঘের উপরেও উড়ে তবে পরক্ষণেই কাঁধের উপর পাঁচ আঙুলের এক স্পর্শ অনুভব করলাম, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি বলে হয়তো বেশ শিহরিয়া উঠলাম নয়তোবা ৪ বছর পার হয়ে গেলো কোনো হাতের স্পর্শ আমায় শিহরিয়া উঠাতে পারে না! পেছন ঘুরে তাকালাম দেখলাম মেহরাব ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি বারান্দায় এসে নিজে নিজেই যতটা না বিব্রত হয়েছি তার চেয়ে মেহরাবকে বেশি বিব্রত দেখাচ্ছে, ও আসলেই আমার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে হয়তো বছর দুই এক পর আমাকে বারান্দায় আসতে দেখে, সে হয়তো ভাবছে বকা দিয়ে আমাকে আমার রুমে যেতে বলবে নাকি ভালোভাবেই বলবে কিন্তু সে কিছুই বললো না শুধুমাত্র তিনটে শব্দ ছাড়া আর তা হলো ” অফিসে যাবি না! ” আমার মুখপানে চেয়ে এর বেশি কিছু সে হয়তো বলতে পারলো না!
ওহ আজ না অফিসে যেতে হবে, কাজের তেমন চাপ নেই জুন ফাইনাল শেষ, এখন অবশ্য দু তিন ঘন্টা পরেই অফিসে যাই বেলা ১২ টা বাজে আমার অফিসে পৌছতে! যাই হোক ১০.৩০ বেঁজে গেছে এবারে খেয়েদেয়ে অফিস যেতে হবে। এই সফটওয়্যার কোম্পানির জবটাও মেহেরাব খুজে দিয়েছিলো, নিজের আপন লোক থাকলেও মনে হয় আমার জন্য এমনটা ভাবতো না, তবে মেহেরাব এর উপস্থিতিতে কখনোই আমার মনে হয় না যে আমার আপন বলে কেউ নেই, আপন করে কাউকে অবশ্যি আর নিতেও পারবো না ওকে ছাড়া, এতে অবশ্য কারো নিষেধাজ্ঞা নেই, মেহরাবও অনেক চেষ্টা করে আমাকে বেঁধে দিতে কোনো মেয়ের সাথে কিন্তু অনেক দেখলেও সাহস কুলোয় না ওর আমাকে বলতে, আসলে নিজ চোখে দেখেছেতো ও কিভাবে কি হয়ে গিয়েছিলো! নাহ মেহেরাব রুমে গেলো মিনিট দশেক হয়ে গেলো এখন রুমে যাওয়াই শ্রেয়, খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়লাম! বাসার নিচ থেকেই বাসে উঠলাম, পাশের দিকের সামনের সীটে দেখলাম একটা ছোট বাচ্চা হয়তো নার্সারি কিংবা কেজিতে পড়ে সে বাদাম খাচ্ছে আর তার মা তাকে খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছে, দৃশ্যটা দেখে কেমন যেনো হারিয়ে গেলাম অদৃশ্যে যদিও এমনটা হবার কথা না কারণ বছর ৪ যে হয়ে গেলো আমি বাদাম খাই না সবশেষ চারবছর আগেই বাদাম কিনতে গিয়েই যে আমি ১ম আঘাত পেয়েছিলাম! সেদিন যদি বাদাম কিনতে না যেতাম তবে মনে হয় এমন কিছু হতো না! সেই বাদাম গুলো এভাবে ছড়িয়ে পড়ে থাকতো না! পড়ে অবশ্য কয়েকদিন সেই বাদাম ওয়ালার খোজ করেছি সেই রাস্তার পাশে গিয়ে কিন্তু আর না পেয়েছি বাদাম ওয়ালার খোঁজ আর ২বছরের মধ্যে না পেয়েছিলাম তমার খোঁজ! যাই হোক এক ধোয়াসে অবস্থানে চলে গিয়েছিলাম ঠিক তখনই বাস কন্টাক্টারের ডাক মামা ভাড়াটা, ভাড়া বের করার সময়টাতে খেয়াল করলাম সামনের সীটের লোক বদল হয়ে গেছে, হয়তো বাচ্চাটা আর তার সাথে থাকা মহিলা উভয়েই আরো আগেই নেমে গেছেন!
এক বয়ষ্ক লোক বসেছেন সেখানে ওনাকে দেখতে পেছন থেকে অনেকটাই আমার মামার মতো, ছোট বেলায় বাবা মাকে হারিয়েছি তাদের চেহারাও স্মরণে নেই, ১৯ বছর পর্যন্ত মামার কাছে মানুষ হয়েছি তবে এই মামা সেই মামা নয় আসলে আমার একটাই চাচা ছিলেন আর তাকেই আমি মামা বলতাম তিনিও ওপারে চলে গেলেন ঘর সংসার বাধার আগেই! কি জানি বুঝিনা যে অপ্রাপ্তবয়স অবস্থাতেই আমায় ছেড়ে চলে যাওয়াটা সবার এমন রোগ কিন্তু আমি কেনো চাইলেও ওপারে যেতে পারিনা আমায় তো নেয় না, কই মেহরাবকে তো আমি আপন করিনি, ওই আমাকে আপন করেছে তাহলে ওর আপন মানুষ তানবিন কেনো চলে যায় না! নাহ বাস অফিসের সামনে এসে গেছে, এবার বাস থেকে নেমে একটু হাটার পথ অতিক্রম করলেই অফিস! আজ একটু দ্রুত গতিতে হাটার প্রয়াস চালাচ্ছি তাও মনে হচ্ছে ২/৩ মিনিটের রাস্তাটা ২/৩ কিলোমিটারের হয়ে গেছে বাস্তবেও অবশ্য দূরত্ব অনেক ক্ষেত্রেই বেড়ে গেছে! যাকজ্ঞে লিফট দিয়ে উঠে গেলাম ৪তলায়, বা দিকের প্রথম লাইনের তিন নাম্বার ডেক্সটা আমার, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়াররা এই প্রথম লাইনেই বসে! টাই টা হালকা লুজ করে বসলাম ইজি চেয়ারে পেছন দিকে হেলে! আজ যে কি হলো বুঝতেছিনা যেদিকেই তাকাই যার দিকেই তাকাই কেনো যেনো কিছু একটা ধোয়াসার ন্যায় ভেসে উঠে! কি হলো আজ! এটা কি আমি! আচ্ছা আজ কি বিশেষ কোনোদিন! আজই কি সেইদিন! আজ সেইদিন বলেই কি মেহরাব গতকাল রাতে ক্যালেন্ডার এর পাতাটা ছিড়ে সেলফের বই গুলোর নিচে দিলো! এসি টা অন করে কম্পিউটার টা চালু করলাম হোম স্ক্রিন আসার সাথে সাথেই নজরে পরে গেলো আজকের তারিখ, হ্যাঁ আজই তো সেইদিন! ৪বছর আগে ঠিক আজকের এই কথা দিনেই তো নিচতলার বাসায় উঠেছিলাম! সারাদিন ঘরে আনা জিনিসপত্র গোছাবার শেষে সন্ধ্যের দিকে চা বানিয়ে চলে যাই বারান্দায়! বারান্দায় গিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় অর্ধেকটা কাপ খালি করে ফেলেছি, বাকী নেই অবশ্যি আর শেষ করা হয়ে উঠেনি! অর্ধেক শেষ হবার পরে বা দিকে ঘাড় ঘুরাতেই দোতলার বারান্দায় চোখ পড়ে গেলো! আমার দৃষ্টি ওদিক যেতে না যেতেই সোডিয়াম বাতির মৃদু আলোয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অপরূপা মুগ্ধকারী মেয়েটি চুল আউলিয়ে ঘুরে ঘরে ঢুকে গেলো! কিন্তু আমার ঘাড় মাথা কিছুই আর ঘুরলো না! স্টাচু হয়ে চায়ের কাপ হাতে ওদিকে চেয়েই রইলাম!
অনেকক্ষণ পর মেহেরাব এসে ডাক দিলে আমার স্মৃতি ফিরে! সেদিনের সেই মুহূর্ত আমি কোনো জন্মেই ভুলতে পারবো না! যাই হোক সেদিনের পর থেকে আমি যতবার বারান্দায় গেছি আমাকে দেখার সাথে সাথেই সে চলে গেছে! এই ‘সে’ ই ছিলো তমা! আমি ভাবতাম সে হয়তো আমায় খুবই অপছন্দ করতো বলে আমায় দেখে চলে যেতো কিন্তু তার যাওয়ার মুহূর্তের মুচকি হাসিটা অবশ্যি তার উল্টোটা প্রকাশ করতো! কম্পিউটার এর সামনে বসে এসব ভাবতে ভাবতে তৎ মুহূর্তে কফি নিয়ে আসলো স্টাফ বললো “স্যার আপনার কফি”! কফি দিয়ে যাওয়া থেকে আমার মনে পরে গেলো তার কিছুদিন পরের কথা! প্রায় ৭/৮ দিন আমি বারান্দায় যাই আর ও চলে যায় এভাবেই চলে! কিন্তু হঠাৎ একদিন মেহরাব বাড়িতে গেলে পরদিন সকালে দরজায় কড়া! কেয়ারটেকার এসেছে ভেবে দরজা খুলতে না খুলতেই দেখি আমার স্বপ্নের নীলাম্বর আমার সামনে দাঁড়িয়ে! বিন্দু মাত্র অবাক হবার পূর্বেই সে বললো ‘এই নাও কফি’ আমি হাতে নেবার পূর্বে যে প্রশ্ন করবো তার উত্তর সে আগেই যোগ করে দিলো, বললো ‘জানি মেহেরাব বাসায় নেই আর হ্যাঁ জিজ্ঞাসা করবে কিভাবে জানলাম, জেনেছি দারোয়ান এর কাছ থেকে যাই হোক নিজে তো চা কফি কিচ্ছুটি বানাতে পারো না সব মেহেরাব করে তাই নিয়ে আসলাম, ধরো’ এই বলে মাইক্রো সেকেন্ডও দেরী না করে চলে যেতে নিলো একটু গিয়ে ঘুরে আবার বললো ‘কাপটা রেখে দিয়ো সময় করে নিয়ে যাবো’ ব্যাস এই বলেই শেষ! কফির স্বাদ নিয়ে তেমন কিছু মনে নেই কেননা কফিতে চিনি দিয়েছিলো বেশি! সাধারনত চিনি দিয়ে কফি খাই না, চা এর বেলায় তা হয়! আর মেহেরাব এর মত কেউ বানাতে পারবে না এমন বিশ্বাস ছিলো বলে হয়তো ভালো হলেও ভাল্লাগেনি! যাকজ্ঞে তখন আমি ধরে নেই তমা আমাকে পছন্দই করে! কিন্তু করলেও কি হবে আমার সাথে তার কোনো যোগাযোগ তো নেই আর সে তেমন কোনো সুযোগও দেয়নি পেট চাপড়ে জমে থাকা কথাগুলো বলার!
এভাবে মাস খানেক চলে যায়! এর মধ্যে ৭/৮ বার চায়ের কাপটা ফেরত দেয়ার সাহস দেখাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি আর নিতেও আসেনি, এর উছিলায় হয়তো একটু কথা হতো! তখন মাথায় শুধু এটাই ঘুরতো দেখা হবেনা কথা হবেনা তবে কেন কফি দিয়ে যাওয়া! এ ভেবে রাতে ঘুম না আসা নিত্যদিনের অভ্যেস হয়ে গেছিলো! তারপরে তমা’রা স্বপরিবারে কোথায় যেনো যায় ৩মাস পড়ে ফেরে! হয়তো বেড়াতে গিয়েছিলো,হয়তো না সত্যিই গিয়েছিলো, এরকম কনফিডেন্ট হয়ে বলছি কারন ওদের সাথে ওর প্রায় সমবয়সি এক মেয়ে ওদের বাসায় আসে! মেয়েটি ওর খালাত বোন, এটা অবশ্য জানতে গিয়ে বেশ উপকারই হয়েছিলো! একদিন আমি বাইরে যেতে নেই আর ওর সেই বোন তখন উপর যেতে নিচ্ছিলো সে মুহূর্তে মুখোমুখি হয়ে গেলে সে এক অপ্রীতিকর হাসি দেয় ঠিক তখনই আমি ওর পরিচয় জিজ্ঞাসা করি আর এভাবেই জানতে পারি ও কে! আরো একটা তথ্য পেয়ে যাই সেদিন আর তা হলো তমা’র কন্ট্রাক্ট নাম্বার! তারপরে নতুন একটা অধ্যায়ে চলে যাই! কফি খাওয়া শেষ, ১ঘন্টা হয়ে গেলো অফিসে বসে আছি কম্পিউটার ওপেন করে কোনো কাজের কাজই হচ্ছেনা! মনে হয়না আজ অফিসে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত থাকতে পারবো বলে! ভাবছি আজ ছুটি নিয়ে নেই, যা ভাবলাম তাই করে ফেললাম দুপুরে লাঞ্চ করেই ছুটি নিয়ে নিলাম! লাঞ্চ করার সময় মনে পড়লো তমা’র সাথে যেদিন আমার ফোনালাপ শুরু হয় তার প্রায় ২ সপ্তাহ পর একদিন ও নিজের হাতে বিরিয়ানী রেধে দিয়ে যায়! বিরিয়ানী ছোট বেলা থেকেই বেশ পছন্দের আর ঐ দিনেরটা ছিলো সেরা! সেদিন খাওয়ার সময় মনে হতে লাগলো ইসস তমা যদি খাইয়ে দিয়ে যেতো! প্রতিদিনকার ন্যায় সেদিনও রাত ১১টায় কল দিয়ে কথা বলার সময় বললাম ‘নিজ হাতে রাঁধলে আর নিজ হাতে খাইয়ে দিলে না!’ এটা শোনার পর সে ফোন কেটে দিলো! কয়েকবার কল দিলাম ধরলো না! কি হলো কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি! প্রায় এক মাস তার সাথে আর কথা হয়নি একদিন বারান্দায়ও আসেনি! একটা বিষয় অবশ্যি ছিলো বটে তখন অবধিও কিন্তু আমি তাকে কিংবা সে আমাকে ভালোবাসি বলে উঠিনি!
ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ না হলে হয়তো কাউকে খাইয়ে দেয়ার কথা বলা যায় না, তাই হয়তো যোগাযোগ করেনি এ ভেবেই এক মাস চলে যায়! যাই হোক লাঞ্চ শেষ হয়ে যেতে না যেতেই বেরিয়ে যায় বাসায় যাবো বলে, বেরিয়ে আবার সেই সকালের ন্যায় বাসে উঠি! এমন একটা সময় বাসায় ফিরছি যে এ সময়ে চোখে ঘুম পেয়েই থাকে সবার! আমার ছিটের পাশে এক মোটামুটি বয়সের বাচ্চা বসেছে, হয়তো ৭ম কিংবা ৮ম শ্রেনীতে পড়বে, ছেলেটি একটু পর পরই ঘুমিয়ে পড়ছিলো আর হেলে যাচ্ছিলো আমার দিকে! তখন আমার মনে পড়ছিলো একদিন এইভাবে হেলান দেয়া হয়েছিলো! সেটা ছিলো এক অন্যরকম হেলান দেবার সুযোগ! তমা’র সাথে মাস খানেক কথা হচ্ছিলো না, ঠিক আমার জন্মদিনের আগের রাতে ১১টায় সে ফোন দিয়ে কোনো কিছু না বলে শুধু বললো কাল দুপুর ২টায় বাড়ির ছাদে যেতে আর ঐ সময়েই যেতে কেননা তখন কেউ ছাদে থাকেনা, এইটুকু বলেই কেটে দিলো! আমি হ্যাঁ কিংবা না বলার সময় টুকু পাইনি! কাল যে আমার জন্মদিন ছিলো তাও আমার মনে ছিলোনা! মনে না থাকার দুটো কারণ ছিলো অবশ্য তা হলো এক মেহেরাব বাসায় ছিলো না আর দুই হলো তমা কেন দেখা করতে বললো! ২য় টা ভাবতে ভাবতেই সে রাত চলে যায় তাই মনে পরেনি জন্মদিনের কথা! পরদিন ঠিক সময়ে ছাদে গিয়ে দেখি তমা দাঁড়িয়ে আছে এক হাতে একটা পাখি আর অন্য হাত হাত দিয়ে পাখিটায় হাত বুলাচ্ছে! পাখিটাকে দেখেই বুঝে যাই এটা সেই পাখিটা যেটা ওদের বারান্দায় ও পুষতো! ও আমায় ডাক দিয়ে বললো পাখিটাকে ধরো, আমি ধরলাম তারপরে বললো এবার ছেড়ে দাও, আমি আমতা আমতা করে পাখিটাকে ছেড়ে দেই, ছেড়ে দেবার মুহূর্তেই সে জোড়ে জোড়ে বলছিলো ‘শুভ জন্মদিন তানবিন, শুভ জন্মদিন, শুভ হোক তোমার পথচলা’ আমিতো পুরো অবাক! ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম শুধু আর ও পাখিটাকে উড়তে দেখছে আর আমার দিকে না তাকিয়ে বলছে গিফটটা কেমন হলো! আমি কিছু না বলে ওর হাতটা ধরে ছাদের ডান দিকের ছিটে বসি, বসে ওর কাধে হেলান দিয়ে বলি ‘উপহারটে কিভাবে উড়ছে দেখছো?’ সে বললো আমি এ দিনটার অপেক্ষাতেই পাখিটাকে রেখেছিলাম! আমি সেদিন বেশ চমকিতো হই! হেলান দেয়া অবস্থাতেই জিজ্ঞাসা করি ‘তুমি কিভাবে জানলে আজ আমার জন্মদিন’! তমা কিছুই বললো না, কিছু না বলেই সাথে সাথে উঠে গেলো আর ছাদ থেকে নেমে বাসায় চলে গেলো! আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি!
এতোক্ষনে পাখিটাও আমার দৃষ্টি থেকে বহুদূরে চলে গেছে! সে তার স্বাধীনতা আমার উপহার হিসেবে রেখে গেলো! তবে আমার কাছে আজো এটাই অজানা রয়ে গেলো যে সে কিভাবে আমার জন্মদিন জানলো, এখন তো আর এই অজানা জিনিসটাকে জানতে পারবো না, জানার উপায় না রেখেই তো সে দূরে চলে গেলো! যাকজ্ঞে বাস বাসার কাছে এসে গেছে ভাড়াটা দিয়ে নেমে গেলাম! দু মিনিট হাটলেই বাসা! তারপরে হেটে উঠবো ৬তলা অবধি! যাই হোক বাসায় যাওয়ার রাস্তা অতিক্রম করবার সময় খেয়াল করলাম ওপাশে একটা ছেলে আর মেয়ে বসে বাদাম খাচ্ছে! আর এটা দেখার পর হাটার শক্তি হারিয়ে তখনই হারিয়ে গেলাম পুরোনো স্মৃতিতে! আমার জন্মদিনের ৩দিন পর ১৯শে শ্রাবণ সে আমাকে দেখা করতে বলে! ওটাই ছিলো আমাদের প্রথম এবং শেষ বাইরে কোথাও দেখা করা! তমার কথা মত ওর বলা যায়গাতেই দেখা করতে গেলাম! গিয়ে দেখি ওর হাতে একটা গোলাপ! মনে মনে নিশ্চিতই হয়ে গিয়েছিলাম আজ ও আমাকে নিশ্চয়ই ওর হবার কথা বলবে! দেখা হবার পর বললো ‘ঐদিন জিজ্ঞাসা করেছিলে না যে তোমার জন্মদিন কিভাবে জানলাম আসলে ওটা বলার জন্যই ডেকেছি, আচ্ছা দেখো ঐদিকে বাদাম বিক্রি করছে, আমার না বাদাম বেশ ভালো লাগে, তুমি কি বাদাম কিনে আনবে?’ আমার হ্যাঁ সূচক সম্মতি বুঝতে পেরে সে বললো ‘তুমি নিয়ে আসো আর আমি এখানে দাড়াই!’ সে দাঁড়িয়ে থাকলেই হয়তো ভালো হতো, তাহলে আমার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়টা পার করতে হতো না! আমি ওপারে যাই বাদাম কিনি আর ওকে ডাক দিয়ে বলি ‘এপারে এসো’ আর এই এপারে আসো বলাটাই আমার জন্য সবচেয়ে ভুল ছিলো এপারে আসতে বলে ওকে জীবনের তরে ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছি ভেবে আমি নিলজ্জ! আমি ডাকার সাথে সাথে এক মুহূর্ত দেরী না করে ডান বামে না তাকিয়ে এপাশে আসতে নেয় তমা! আর এটাই ছিলো ওর জীবনকে অন্তিম পথে নিয়ে যাবার প্রথমাংশ যার জন্য আমি দায়ী বলে নিজেকে জীবন্ত লাশ বলে মনে হয়! ও যখন আসতে নেয় ঠিক তখনই বাম পাশ থেকে একটা প্রাইভেটকার এসে ধাক্কা দিলে পড়ে যায়, গতিতে চলমান থাকায় গাড়িটা ওর পায়ের উপর দিয়ে উঠে যায় আর এমন দৃশ্য দেখার সাথে সাথেই আমি জোরে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই! সেদিন আর কি হয়েছিলো তা আমি জানি না! যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমি বাসায়! মেহেরাব বললো একটু আগে নাকি আমাকে হাসপাতাল থেকে আমা হয়েছে! এতোটাই আঘাত পেয়েছিলাম যে প্রায় ২০ ঘন্টা পর আমার জ্ঞান ফিরে! আমি উঠে সাথে সাথে কিছু মনে করতে পারছিলাম না, মিনিট পাঁচেক পরে মনে পড়লে একটু উত্তেজিত হয়ে পড়ি! মেহরাবের কাছে জানতে চাইলে মেহরাব বললো ‘তমা এখন হাসপাতালে ভর্তি, এ যাত্রায় বেঁচে গেছে’। আমার শরীর এতোটাই খারাপ ছিলো যে ৩দিনের মধ্যে উঠতে পারিনি! প্রায় ৭/৮ দিন পর ঘর থেকে বের হয়েছি! তমার খোজ নিতে সাহস করে ওদের ঘরের সামনে যাই গিয়ে দেখি তালা মারা, ভেবেছিলাম এখনো হয়তো হাসপাতাল থেকে ফেরেনি কিন্তু মনের সংকোচ রয়েই গেছিলো! দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করতেই মাথায় বজ্রপাত পড়লো, জানতে পারলাম তমা’রা এ বাসা থেকে চলে গেছে! আমি সাথে সাথে রুমে গিয়ে ওর নাম্বারে কল দিলাম দেখি সুইচড অফ!
তারপর থেকে যতদিন কল দিয়েছি এটাই শুনেছি! এখন তো আর কল দিলেও লাভ হবেনা জানি! ধরবার মানুষটা যে নেই! আমি তারপরে অনেক চেস্টা করেছি ওদের ঠিকানা বের করবার কিন্তু পারিনি! মেহেরাবও কোনো খোজ দিতে পারলো না! ও যে পঙ্গু হয়ে গেছে, হুইল চেয়ারে চলাফেরা করে বলে আমার সামনে আসতে সাহস পায়নি তাই বাসা বসলে চলে গেছে তা হয়তো কোনোদিন জানতে পারতাম না ও যদি এভাবে না চলে যেতো! যাই হোক ওদের বাদাম খাওয়া শেষ আমি স্টাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আগের কথা ভেবেই যাচ্ছি! এ ভেবে লজ্জা লাগলো যে আজকে সারাদিনের সব ভাবনা ঠিক থাকলেও এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকাটা মোটেও ঠিক হয়নি, বাসায় চলে গেলাম! ৬টা তালা সিড়ি বেয়ে উঠতে একটু কষ্টই হয়েছে বটে! চাবি দিয়ে রুম খুলে ভিতরে ঢুকলাম! মেহরাব বিকালে আসবে বাসায়! ওর আসতে আরো ঘন্টাখানেক বাকী! কি করবো কোনো কাজ না পেয়ে মেহেরাবের টেবিলের উপর থেকে পেপারটা নিয়ে পড়া শুরু করে দিলাম! আগে আমিই পেপার রাখতাম প্রতিদিন পড়তাম কিন্তু বছরখানেক ধরে অভ্যাসটা বদলে দিছি! মেহেরাব পড়ুক বা নাইবা পড়ুক আগের ধারাবাহিকতায় পেপার ঠিকই রাখে! যাই হোক পেপার পড়তে গিয়ে দেখি চোক ধাধানো আর্টিকেলের দিকে, দেখলাম চায়নাতে প্লাস্টিকের ডিম আবিষ্কার হয়েছে, দিনাজপুরে বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন হয়েছে, রোনালদোর ডাবল হ্যাট্রিক, ক্যান্সার কোষের সহজ দমন হচ্ছে বাংলাদেশে! লাস্ট লাইন টা দেখে খুবই কাতর হয়ে পড়লাম! মনের আন্দাজে চোখের কোণে পানি জমে গেলো! ঐসব ঘটনার প্রায় ২বছর পর একটা আননোন নাম্বার থেকে আমার ফোনে কল আসে! কল ধরতে না ধরতেই ওপাশ থেকে এক ভদ্র মহিলা বললো ‘হেলো বাবা আমি তমার মা, তমা খুব অসুস্থ, মনে হয়না আর বাঁচবে বলে, লাইফ সাপোর্টে আছে তুমি একটু এসে দেখে যাও’ এই বলে সে হাসপাতালের ঠিকানা বলে দিলো! আমি যেতে বড্ড দেরী করে ফেলি! আমি যাবার মিনিট পাঁচেক আগেই তমা সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে! গিয়ে দেখি ওকে রিজার্ভে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! তমার মা এতোটাই শোক পেয়েছেন যে তার চোখ দিয়ে এখন আর বিন্দুমাত্র জল বেরোচ্ছে না হয়তো কাঁদার শক্তিও সে হারিয়ে ফেলেছে! তারপরেও কষ্ট করে সে বললো ‘আমি তোমাদের সব কথাই জানি, প্রথমদিনের দেখা হতে শুরু করে সবই তমা আমাকে বলেছে! ও ওর পা হারিয়েছে এটা তুমি দেখলে সহ্য করতে পারবে না বলে ও আমাকে ওর দিব্যি দিয়ে বলেছে যেনো তুমি কোনোভাবেই ওর সাথে দেখা করতে না পারো, তাই চলে যাওয়া, তাই যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া, ও প্রতিদিন তোমার কথা বলতো আমায়, এই দু বছর প্রতিদিন ও কিছু না কিছু লিখেছে ওর ডায়রিতে, ওটা যে ও কোথায় রাখতো তা ও ছাড়া কেউ জানে না! গতবছরের শেষ ওর পায়ের এক সাইডের ইনফেকশন থেকে ক্যান্সার হয় আর ক্যান্সার ধরা পরার ৬ মাসও টিকে থাকতে পারলো না চলে গেলো, তোমায় খুবই ভালোবাসত, মা আর মেয়ে আমরা বন্ধুর মতো ছিলাম তো তাই আমি সবই বুঝি, ও বেশ চুপটি করে থাকা মেয়ে তো তাই কিছুই বলতে পারেনি তোমায়, ভালো থেকো বাবা, এখন যাও!’ তখন আর কোনো কিছু বলার ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম না! সাহস হলোনা আর আন্টির সামনে থাকার! বেরিয়ে চলে আসলাম! কাঁদতে কাঁদতে জামা-কাপড় ভিজে গিয়েছিলো! এখন অবশ্য আর কাঁদি না, এখন আর কান্না পায় না, শুধু মনে মনে কিছু কথা ভাবি যার উত্তর আজো পাই না! প্রশ্ন গুলো আমার মাথায় প্রতিদিন আঘাত করে, ‘তুমি কবে চায়ের কাপটা ফেরত নিবে? তুমি কিভাবে আমার জন্মদিন জানলে? তুমি কার জন্য গোলাপ এনেছিলে?’ আমার ভালবাসা অসমাপ্ত রেখে, তোমায় ভালোবাসি বলার সুযোগ না দিয়ে উপহারের পাখির ন্যায় কেন আমায় ছেড়ে উড়ে গেলে!
তরুণ অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার জামশেদ শামীম নির্মাণ করেছেন শিশুতোষ (স্বল্পদৈর্ঘ্য) চলচ্চিত্র ‘পাথুরে ফুল’। চলচ্চিত্রটি সমপর্কে জামশেদ শামীম বলেন, প্রত্যেক দম্পতির ভেতরে পছন্দের অমিল থাকতেই পারে। সংসার জীবনে হাজারটা ইস্যু নিয়ে কথা কাটাকাটি বা ঝগড়া হতে পারে। তবে এসব যেন তাদের সন্তানের সামনে না হয়। তাদের এই ছোট্ট অবহেলা বা অসচেতনতার কারণে সন্তান বা আগামী প্রজন্মের মানসিক অসুস্থতা বাড়তে পারে, ভুল কিছু শিক্ষায় বেড়ে উঠতে পারে। চলচ্চিত্রটিতে আমি এতটুকুই বলতে চেয়েছি যে, আপনারা সন্তানের সামনে ঝগড়া করবেন না, সন্তানকে ভুল ও অন্যায় কিছু শিখাবেন না। পাথুরে ফুল-এর বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন নীতি, শায়লা রহমান, রহিম সুমন, কাজী রাকিব, মুনিয়া, সেলজুক তারিক, লাবণ্য, স্বাধীন, সানী, সাবিনা, শতাব্দী রায় ও শুভ হায়াত সহ আরো অনেকে।
চলচ্চিত্রের ইতিহাস সঙ্গত কারণেই খুব বেশি দিনের নয়। আজ থেকে প্রায় ১১৭ বছর আগে (২৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৫) প্যারিসের হোটেল ডি ক্যাফেতে অগাস্ট লুমিয়ের (১৮৬২-১৯৫৪) ও লুই লুমিয়ের (১৮৬৪-১৯৪৮) নামে দুই ভাই চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী করেন। এর আগেও প্রদর্শনী হয়তো হয়েছে। কিন্তু এটিই ছিল প্রথম সফল বাণিজ্যিক প্রদর্শনী। কিংবা বলা যেতে পারে এর আগের কোনও তথ্য আমাদের হাতে নেই। তাই এই সময়কেই চলচ্চিত্রের সূচনাবিন্দু ধরা হয়। তখন একে চলচ্চিত্র বা সিনেমা নয়, বায়োস্কোপ নামেই ডাকা হতো। ভারতীয় উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হয় এর মাস ছয়েক পর ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই। লুমিয়ের ভাইদের একজন এসে মুম্বাই শহরের ওয়াটসন হোটেলে উপমহাদেশে বায়োস্কোপের প্রথম প্রদর্শনী করেন। ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় বায়োস্কোপের প্রদর্শনী হয়। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম বায়োস্কোপ প্রদর্শনী হয় কলকাতার ব্রেডফোর্ড বায়োস্কোপ কোম্পানির উদ্যোগে ১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল বাকেরগঞ্জ জেলার ভোলা মহকুমার (অধুনা ভোলা জেলা) এসডিওর (অধুনা ডিসি) বাংলোতে। ১৭ এপ্রিল বায়োস্কোপ প্রদর্শনী হয় ঢাকায় পাটুয়াটুলীর ক্রাউন থিয়েটারে। ক্রাউন থিয়েটারের অস্তিত্ব এখন আর নেই। এই বায়োস্কোপের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন চলচ্চিত্র ছিল। শিশুদের উপযোগী কাহিনী কিংবা শিশুচরিত্রকে প্রাধান্য দিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রকে শিশুতোষ চলচ্চিত্র বলা হয়। স্বাধীনতার আগে ফজলুল হক পরিচালিত ‘সান অব পাকিস্তান’ (১৯৬৬) একমাত্র শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত। অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি সিনেমা হলে তেমন চলেনি। তবে বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পরে ড. আশ্রাফ সিদ্দিকীর স্কুলপাঠ্য গল্প ‘গলির ধারের ছেলেটি’র চলচ্চিত্রায়ন করেন খ্যাতিমান পরিচালক সুভাষ দত্ত। ছোটদের জন্যে এটি নির্মিত হয়নি। কিন্তু দারিদ্র্যক্লিষ্ট এক কিশোরের জীবনকাহিনী বর্ণিত হওয়াই এটি শিশুকিশোরদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এরপর আরও অনেকগুলো শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ হলেও শিশুদের একান্ত নিজস্ব ভুবন নিয়ে কাহিনীর আবর্তন পুরো চলচ্চিত্রে অনুপস্থিত থেকে যায়। আসলে নির্ভেজাল শিশুতোষ চলচ্চিত্রের জন্য প্রয়োজন শিশুদের মনস্তত্ত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করা। তাদের চাওয়া-পাওয়ার গুঢ় রহস্য উদ্ঘাটনের অনন্য ক্ষমতা। আজ আমরা তোমাদের মতো ছোটদের জন্য নির্মিত বাংলাদেশের শিশুতোষ চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব। শিশু মনস্তত্ত্বের জটিল দিকটি বিশেষভাবে উপলব্ধি করে শিশুদের মানসিক বিকাশ এবং নির্ভেজাল আনন্দ প্রদানের লক্ষ্যে শিশুদের উপযোগী করে নির্মিত চলচ্চিত্রকে শিশুতোষ চলচ্চিত্র বা শিশুচলচ্চিত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়, সেটা আগেই জেনেছ। শিশুতোষ চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ বরার্ট বয় বলেন, ‘সেই ছবিই আদর্শ ছোটদের ছবি, যা দেখে ছোট ছোট দর্শক নিজেদের দেখতে পায়, আবিষ্কার করে, চিহ্নিত করতে পারে।’ শিশুতোষ চলচ্চিত্রের লক্ষ্য থাকবে শিশুর বিকাশ। ছবি দেখে শিশু নিজেকে নিয়ে ভাববে, আবিষ্কার করবে ভিন্নভাবে এবং প্রত্যয়ী হয়ে উঠবে। প্রকৃতপক্ষে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিশুদেরকে শিক্ষাদানের জন্য চলচ্চিত্র যেমন মহান শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে তেমনি তোমাদের সুপ্ত বৃত্তি ও প্রতিভার উন্মেষ, মানসিক উন্নতি সাধন ও নির্মল আনন্দদানের ক্ষেত্রেও বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম। শিশু মনস্তত্ত্বাত্বিক কাহিনী, দৃশ্যপট ও সংলাপময় শিশুতোষ চলচ্চিত্রের কোনো বিকল্প নেই। শিশুমনের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশে চলচ্চিত্রের এই ব্যাপক প্রভাবকে উপলব্ধি করার পরপরই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্মিত হতে থাকে শিশুতোষ চলচ্চিত্র। এ ধরনের চলচ্চিত্র শুধু তোমাদের জন্যই নয়; বড়রা তোমাদের প্রতি কতটুকু যতœবান হবেন তারও একটি গুপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া থাকে এই ধরনের চলচ্চিত্রে। অথচ যেভাবে আমাদের দেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্রের বিকাশ হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত বছরে একটি করেও যদি শিশু-কিশোরদের জন্য চলচ্চিত্র তৈরি হতো তাহলে ৪১টি চলচ্চিত্র পাওয়ার কথা। অথচ হিসেব করে দেখ এককের ঘরটিও এখনো আমরা পার করতে পারিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারি পর্যায়ে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বলা হয় সরকারি অনুদানে তিনটি ছবির মধ্যে অবশ্যই একটি শিশুতোষ হতে হবে। হয়েছে কি? আদৌ তা হয়নি। ‘গলির ধারের ছেলেটি’র পর ১৯৮০ সালে সরকারি অনুদানে বাদল রহমান তৈরি করেন ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’। সরকারি অনুদানে এটিই বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র। এরপর ছুটির ঘণ্টা, ডুমুরের ফুল, দিপু নাম্বার টু, দূরত্বসহ হাতে গোনা কয়েকটি ছবি নির্মিত হয়। অথচ আজকের শিশুরাই আগামী দিনে জাতির ভবিষ্যৎ। সবাই বলে চলচ্চিত্র ব্যয়সাপেক্ষ। এই ধরনের ছবি বানিয়ে কেউ দেউলিয়া হতে চান না। অথচ তথ্যপ্রযুক্তিতে পৃথিবী অনেক এগিয়েছে। পশ্চিম প্রান্তের খবর পূর্ব প্রান্তে বসে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই আমরা পেয়ে যাই। সেখানে দ্রুত গতির চলচ্চিত্র সেই পুরনো ইতহাস নিয়েতো বসে থাকার কথা নয়। আজ চলচ্চিত্র নির্মাণে যোগ হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। নির্মাণ ব্যয় চলে এসেছে হাতের মুঠোয়; তারপরেও কিন্তু আমাদের দেশে ছোটদের জন্য চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে না। তাহলে টাকার অজুহাত পিছিয়ে থাকার কারণ কী? তারা আমাদেরকে অন্ধকারে রেখেই বিদেশী শিশুতোষ চলচ্চিত্রের নামে ফ্যাস্টিভ্যল করে অন্য কিছু শিখাতে চান। প্রিয় বন্ধুরা, শিশুতোষ চলচ্চিত্রের এই দুর্দিনে ২০০৯ সালে তোমাদের জন্য তৈরি করা হয় দেশের প্রথম শিশুতোষ ডিজিটাল চলচ্চিত্র ‘দূরবীন’। আমাদের আজকের আলোচনা এই দূরবীনকে ঘিরেই। তোমরা অনেকেই হয়তো ইতোমধ্যে ছবিটি দেখেছ একবার, দু’বার, বহুবার। ছবিটি দেখে হয়তো কেউ হেসেছ আবার কেউ কেঁদেছও। দেশের সকল প্রচার মাধ্যমে ছবিটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। এমনকি দেশের বাইরেও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ছবিটি নিয়ে খবর বেরিয়েছে। এই ছবিটির জন্য পরিচালক আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কারও অর্জন করেছেন। আমরা এখন দূরবীনের গোড়া থেকে জানতে চেষ্টা করবো। প্রথমেই শ্যুটিং থেকে শুরু করা যাক। একটা সিনেমা বা ছবি তৈরি করার জন্য ৪টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এগুলোকে বলা হয় প্রি-প্রোডাকশন, প্রোডাকশন, পোস্ট-প্রোডাকশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন। একটি ছবির ভালো-মন্দ নির্ভর করে প্রি-প্রোডাকশনের উপর। যার প্রি-প্রোডাকশনের কাজ ভালো হবে তার প্রোডাকশন মানে ছবিটিও ভালো হবে। সে জন্য পৃথিবীর সেরা চলচ্চিত্র পরিচালকদের দেখা যায় প্রি-প্রোডাকশনে অনেক সময় দিচ্ছেন। তোমরা যদি কেউ ছবি বানাতে চাও তাহলে প্রি-প্রোডাকশনটা ভালোভাবে মাথায় রাখবে। তো, দূরবীনের প্রি-প্রোডাশনের কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তার পরের বছর মানে ২০০৯ সালের ৬ ফেব্রয়ারি সকাল ১১টায় ক্যামেরা অন হওয়ার মাধ্যমে ছবিটি প্রোডাকশনে চলে যায়। পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ শেষ হয় অক্টোবরে। আর ডিস্ট্রিবিউশন শুরু হয় অক্টোবরেরই ২৯ তারিখে বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সেÑ শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে। ভাবছো, কত সহজেই প্রি-প্রোডাকশন থেকে ডিস্ট্রিবিউশনে চলে এসেছি, এ আর এমন কঠিন কী কাজ! অথচ এর মাঝে চলে গেলো প্রায় ২টি বছর। অনেক পরিশ্রম অনেক ব্যয় অনেক সময় অনেক মেধা এরপর তৈরি হয় ৯০ অথবা ১২০ মিনিটের একটি ছবি। যা তোমরা মাত্র ৯০ অথবা ১২০ মিনিটেই দেখে শেষ করতে পারো। অথচ আসল কথা হচ্ছে ৮ ঘণ্টা শ্যুটিংয়ের পর ৬ মিনিটের সঠিক ফুটেজ পাওয়াও অনেক সময় কষ্টকর। দূরবীনের পরিচালক জাফর ফিরোজ। বয়সে খুবই তরুণ, মনে তার শিশুসুলভ স্বপ্ন। সব সময় চিন্তা করেন তোমাদের নিয়ে। স্বপ্ন দেখেন তোমাদের জন্য কিছু করার। ওই যে বললাম, মনটা তার একেবারেই শিশুদের মতো! কল্পনা-চিন্তাগুলো সে কারণেই তোমাদেরকে নিয়ে আবর্তিত হয়। আর সেই স্বপ্ন ও কল্পনা থেকেই তোমাদের জন্য বানালেন ‘দূরবীন’। ছবিটির কাহিনী, চিত্রনাট্যও লিখেছেন তিনি। তোমরা যারা ছবিটি দেখেছ তারা সাঈফ স্যারকে মনে রেখেছ। ছাত্রদের কত প্রিয় সেই সাঈফ স্যার! বাস্তবেও ঠিক তাই। সেই সাঈফ স্যারই এই ছবির পরিচালক। শিশু বয়সের ভাবনা, দুরন্তপনা, অজানাকে জানার ইচ্ছা, শ্রেণী-বৈষম্য বিরোধী ভাবনা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, দেশপ্রেমÑ এসব নিয়েই ছবিটি বানিয়েছেন স্বপ্নচারী এই তরুণ পরিচালক। দূরবীনের প্রযোজনায় রয়েছে জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠন অনুপম সাংস্কৃতিক সংসদ। পরিবেশনায় বাংলাদেশ ডিজিটাল ফিল্ম সোসাইটি। নির্বাহী প্রযোজক নিজামুল হক নাঈম। তিনি ছবিটির নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, চলচ্চিত্র অনেক বড় একটি শিল্প মাধ্যম। আর আমাদের প্রথম কাজটি শিশুদের জন্য করতে পারার জন্য আমরা আনন্দিত। দূরবীনকে সবাই যেভাবে সাদরে গ্রহণ করেছে এবং করছে তাতে মনে হয় শুধু শিশুদের জন্য নয়, সব বয়সের মানুষের জন্যই এই দূরবীন। আসলে আমরা দূরবীনকে সবার উপযোগী করেই বানিয়েছি। আশা করি পরবর্তী শিশুতোষ চলচ্চিত্রে ‘দূরবীন’ পথ নির্দেশকের ভূমিকা পালন করবে ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা বন্ধুরা, যাকে কেন্দ্র করে ছবিটি তৈরি হয়েছে অর্থাৎ যে শিশুটির জীবনাচার ও স্বপ্ন-কল্পনা এবং বাস্তবতা নিয়ে এর কাহিনী চিত্রিত হয়েছে, তার সাথেও একবার পরিচিত হয়ে নিলে কেমন হয়? ছেলেটির নাম লাবিব। ছবির প্রধান চরিত্র। ছবিটি দেখতে দেখতে তোমরা লাবিবের জন্য চোখের পানি ফেলেছ সেটা আমরা জানি। আবার লাবিবের পুরস্কার ও বৃত্তির খবরে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছ তাও জানি। এই জায়গাটিতে নিজেকে কখনোই ধরে রাখা যায় না। লাবিব তো দূরবীনের ছেলেটির নাম, প্রকৃত নাম আবু সায়াদ তামিম। বর্তমানে ও মতিঝিল মডেল হাই স্কুলের নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান ক শাখার ছাত্র। অষ্টম শ্রেণীতে সরকারি বৃত্তিপ্রাপ্ত তামিম জেএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাসও পেয়েছে।
তোমরা আজ প্রথম যারা দূরবীন সম্পর্কে পড়ছো ও জানছো, তারা নিশ্চয়ই এর কাহিনী সম্পর্কে জানতে চাইছো। ঠিক আছে, এবার দূরবীনের কাহিনীটা সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক। তবে যারা ইতোমধ্যেই ওটা দেখে ফেলেছ, তারা কিন্তু আবার মুখ গোমড়া করে ফেলো না। তোমার জানাটা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে তো তোমারই ভালো লাগবে। লাবিবের মা নেই। বাবা বড় ব্যবসায়ী। সবসময় সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ছেলেকে দেয়ার মতো তার তেমন সময় নেই। বাড়ি, গাড়ি, দামী খেলনা কোনো কিছুর অভাব নেই লাবিবের। কিন্তু এসব ওর মনকে এতটুকু খুশি করতে পারে না। ও পাখি হয়ে স্বাধীনভাবে আকাশে উড়তে চায়। ঘাসের বুকে রঙিন পাখা মেলে উড়ে বেড়ানো ফড়িং বা প্রজাপতি ধরতে চায়। স্কুল থেকে বাড়ি আর বাড়ি থেকে স্কুলÑ নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা এই গোলকধাঁধা ওর একদম ভালো লাগে না। কিসের একটা প্রচণ্ড তৃষ্ণা ওর হৃদয়-মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে সর্বদা। চাপা একটা চাওয়া-পাওয়ার মাঝখানে ওর মন নামক সুন্দর ভুবনটা ক্রমেই ছোট থেকে ছোটতর হতে থাকে। নিজের মধ্যে কেমন গুটিয়ে যায় ও। এভাবেই কাটছিল দিন। এর মাঝেই একদিন ওর পরিচয় হয় সাঈফ স্যারের সাথে। সাঈফ স্যারের উপস্থিতি ওর জীবনে সূচনা করে এক নতুন দিগন্ত। সাঈফ স্যার হয়ে যায় ওর বন্ধু। যে কল্পনার রঙ মেখে স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়াত লাবিব, সেই রঙ বাস্তবে ওর জীবনে বয়ে আনে সাঈফ। সুযোগ পায় মুক্ত আকাশে ডানা মেলার। এই ছবিতে আমরা একজন শিক্ষককে শাসক নয়, বন্ধু হিসেবে দেখতে পাই। শিক্ষক যে ছাত্রদের মানসিক বিকাশ ঘটাতে সক্ষম তা এখানে দৃশ্যমান। আমরা দেখতে পাই শিশু লাবিবের মানসিক বিকাশ ও জাতীয় শিশু অভিনয় প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার দৃশ্য, প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তিপ্রাপ্তির মতো আনন্দময় সুখবর। একজন স্নেহবঞ্চিত অমনোযোগী শিশুর পক্ষে এসব কিছুই সম্ভব হয় একজন স্নেহপরায়ন আদর্শ শিক্ষকের কারণে। এই ছবিটিতে আমরা দেখি লাবিব শিশু হলেও তার মাঝে মানবিক কিছু গুণ প্রতীয়মান। খাবার টেবিলে বসে ভাবছে এই বুঝি মা ওর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। অথচ তখন ওর পাশে শূন্য চেয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। এই জায়গাটিতে এসে কেউ নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। বিড়ালকে খাবার দিয়ে লাবিব বুঝিয়ে দেয় যে, সমাজে সবাই ভালোবাসার মাঝে বেড়ে উঠতে চায়। শুধু লাবিব নয়, তার অন্য বন্ধুদের দায়িত্ববোধ চোখে পড়ার মতো। বন্ধুরা লাবিবের দুর্দিনে পাশে দাঁড়ায়। ছবিটিতে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান। লাবিব মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে লাবিবের বাবার ভুল ভাঙে। তিনি বুঝতে পারেন তার অমানবিকতা এবং ছেলের প্রতি অবহেলার বিষয়টি। তাই সাঈফ স্যার ও বন্ধুদের মাঝে ফিরিয়ে দেন লাবিবকে। লাবিব ফিরে পায় আপন ঠিকানা। ছবিটিতে তোমরা যে স্কুলটি দেখছ তা ঢাকার বিখ্যাত সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল। আর বাড়িটি বনানীর ১৩ নম্বর রোডের মমতা। ছবিটি নিয়ে দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিরা চমৎকার সব মন্তব্য উপহার দিয়েছেন। সেসবের কয়েকটি তোমাদেরকে বলার লোভ সামলাতে পারছিনে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ ধরনের চলচ্চিত্র সুন্দর জাতি গঠনে বিশেষ অবদান রাখবে। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেন, শিশুদের মেধা বিকাশে শিশুতোষ চলচ্চিত্র কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। একান্তই শিশুদের কথা চিন্তা করে শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘দূরবীন’ নির্মাণ করায় এর কলাকুশলীকে অভিনন্দন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী বলেন, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের কর্ণধর। শিশুদের সঠিকভাবে পরিচর্যার দায়িত্ব আমাদের সকলের। দূরবীন সে কাজটি করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সে সময়ের বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর চেয়ারম্যান শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, শিশুদের আকাক্সক্ষা নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র দূরবীন ভবিষ্যতের দূরকে স্পষ্ট করে দেখাতে পারে, মানুষে মানুষে দূরত্ব দূর করতে পারে। বাংলাদেশ ডিজিটাল ফিল্ম সোসাইটির চেয়ারম্যান (এ.সি) মোহাম্মদ আসাফ্ উদ্দৌলাহ্ বলেন, পৃথিবীর সব শিশুর মনে দূরবীন আলো ছড়াবে। শিশুদেরকে দেশপ্রেম, মহানুভবতা, আত্মত্যাগী ও সত্যভাষী হিসেবে তৈরি করবে এটা আমার বিশ্বাস। সেভ দ্যা চিলড্রেন অস্ট্রেলিয়ার কান্ট্রি ডিরেক্টর সুলতান মাহমুদ বলেন, I am very happy to know that ONUPOM has taken the task producing DURBEEN, the first ever digital children film in Bangladesh as far as my knowledge gose. I hope this film will help the people to realize about to take more responsibility to create an enabling environment for children to grow with their full potential. After watching this film the children will be very much curious in education. Congratulations the young people who are working in this field and we are always with you. জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বাংলাদেশের সিনিয়র অফিসার সাইদ মিলকী মনে করেন এই ছবিটি তৈরি করা হয়েছে ছোট-বড় সবার জন্য। বিশেষ করে শিক্ষকদের জন্য এই ছবিটিতে অনেক মেসেজ রয়েছে। মেসেজ রয়েছে বাবা-মায়ের জন্যও। এখন সময় হয়েছে ছবিটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করার। চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম দূরবীন নিয়ে এতো বেশি-ই আশাবাদী, তিনি মনে করেন মার্জিত ও রুচিবোধের ছবি দূরবীন। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন মনে করেন, শিশুরা ফুলের মতো। আর যারা এই ফুলের সংস্পর্শে আসে তাদের কাছ থেকে ফুলের সুবাসই প্রত্যাশা করা যায়। দূরবীনের মাঝে সেই ফুলেরই ঘ্রাণ। দূরবীন অসাধারণ একটি ছবি। বিখ্যাত টিভি ব্যক্তিত্ব মাহবুবুল আলম গোরা মনে করেন দূরবীনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুস্থ সুন্দর চলচ্চিত্রের বীজ বপন হল। এখন অপেক্ষা সুন্দর চলচ্চিত্রের জয়গানের। বাংলাদেশ ডিজিটাল ফিল্ম সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান (এ.সি) মো: দেলাওয়ার হোসেন বলেন, দূরবীন শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সকল শিশুদের মনের খোরাক যোগাবে। চিত্রনায়ক শেখ আবুল কাশেম মিঠুন বলেন, দূরবীন দূর দেখাচ্ছে বাংলাদেশের শিশুতোষ চলচ্চিত্রের। বাংলাদেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্র অনেক তৈরি হবে সে পথ দূরবীনই বাংলাদেশকে প্রথমে দেখিয়েছে। দূরবীনে দু’টি গান রয়েছে অসাধারণ। মা শিরোনামে গানটি লিখেছেন পরিচালক নিজেই। সুর করেছেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আমিরুল মোমেনীন মানিক। শিশু শিরোনামে গানটি লিখেছেন আবু তাহের বেলাল। সুর করেছেন গোলাম মাওলা। মা গানটি শুনে কারো অশ্রু ঝরেনি এমনটি হয়নি। এই গানটি শুনলে মনে হয় মা কতো বড় সম্পদ। অথচ আমরা মাকে কতো জ্বালাতন করি। শিশু গানটি শিশুদের অধিকার নিয়ে। গানটির কথা এই রকমÑ “প্রতিটি শিশুরই সুকোমল মন সুবাসিত ফুলের মতন/পৃথিবীতে তারা আনবে ফাগুন করো যদি সোহাগ যতন…।” গত ৪ আগস্ট ২০১২ সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাব ভিআইপি লাউঞ্জে হয়ে গেল ছবিটির ডিভিডি রিলিজ অনুষ্ঠান। মার্কেটিং-এ রয়েছে সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ (সসাস)। এখন বসুন্ধরা সিটিসহ যে কোনো ডিভিডি দোকানে ছবিটি পাওয়া যাবে। ছবিটিতে আরো যারা অভিনয় করেছেনÑ প্রফেসর কাজী অখতারুজ্জামান, মাহবুব মুকুল, ফারুক খান, আবদুল্লাহিল কাফি, ফেরদৌস কামাল, আমান, সাইফুল্লাহ, বান্না, আফনান, ইব্রাহিম, ফয়সাল, প্রান্ত দাস, শান্ত, উইলিয়াম, তারিক, তুহিন, রুবিনা, মেহেদী হাসান ও বিশেষ একটি চরিত্রে কবি আবদুল হাই শিকদারসহ আরো অনেকে। ছবিটির ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি হীরা আজাদ, সম্পাদনায় সামসুল আলম, মিউজিক করেছেন পারভেজ জুয়েল, প্লেব্যাকে আমিরুল মোমেনীন মানিক, টুম্পা দাস ও আবদুল্লাহ বিন ফায়েজ। গ্রাফিক্স তাওহিদ ও শাহিদী। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার স্নেহ ভালোবাসা, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা এবং শিক্ষক-ছাত্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছবিটিকে করেছে অমূল্য। ছবিটি বিনোদনের পাশাপাশি মানবিক ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন হওয়ার শিক্ষা দেয়।