লেখাঃ কে এম নিহাল
“বেঁধে রেখো বাঁশি আমি দেবো তাতে সুর
প্রয়াস যত আশি আমি চলেছি বহুদূর!”
হর্নের শব্দ আর হর্নের শব্দ, কিছুই মাথায় আসে না, প্রতিদিন এই শব্দের শিকার হতে হতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে আমার কানটা, কানটা আমায় মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে ‘তুই আমার জন্য কি করেছিস, পেরেছিস কোনো খুশির বাক্য আমার দ্বারা গমন করাতে? যতবার তুই তমা’কে বলেছিস তুই বিস্তৃত রোদে মাখা বালুকনার অভ্যন্তরে থাকা ভেজা বালুর মতো মিথ্যেবাদী নস, তুই যতবারই সত্যি প্রকাশ করতে গিয়েছিলি ততবারই আমাকে গ্রহণ করিয়েছিস এক একটি তিক্ত কথা, তোর বরঞ্চ মঙ্গল কামনা করা উচিত যে আজো তোর কর্ণগোচর করায় সমস্যা উপলব্ধি হচ্ছে না!’ উহহহ কান যা ভাবায় না আমায়, তবে এগুলাও সেই হর্ণের শব্দের ন্যায় অভ্যাস হয়ে গেছে হয়তো! কিন্তু এমন অভ্যাস তো আমার ছিলো না, ১ তালায় থাকার সময়েও তো হর্ণে জোরালো শব্দে মস্তিষ্কে বিষ ধরে যেতো না! যাই হোক এখন ৬ তলায় থাকি তাও হালকা এবং অভ্যাস হয়ে যাওয়া হর্ণের শব্দে প্রতিদিনকার ন্যায় আজো ঘুম ভেঙে গেলো!
এখন আর কফি,চা কিছুই খাই না অথচ সেসময়টাতে খালি কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে যেতাম উঁকি মারতাম ঠিক বা পাশের দোতলায় বেলকুনির দিকে! থাক এসব ভেবে এই সময়টা নষ্ট করবার নয়, সময় যতটুকু নষ্ট হয়েছে সেটুকুতে মুখ ধোয়া শেষ করে কেনো যেনো আজ তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে জানালার পাশ কাটিয়ে পাশের রুম পেরিয়ে চলে গেলাম বারান্দায়, বারান্দাটা মেহরাবের রুমের সাথে! বারান্দার পাশের রুমটা মেহরাবকে দেয়ার অবশ্য তীক্ষ্ণ হলেও কিছু কারণ ছিলো, মূলত বারান্দায় যাওয়ার অভ্যাসটাকে বাদ দিয়ে এখন বারান্দায় না যাওয়ার বদ অভ্যেস করার প্রয়াসেই আছি! আমি কি আজ সত্যিই বারান্দায় এসেছি, গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা তানবিন নামের ২৫ বছরের ছেলেটি কি সত্যি সত্যিই আমি
নাকি আমি আবার আবিষ্কার করার চেষ্টা করছি আমায় ছেড়ে উড়াল দেয়া মানুষটার কথা, যাকে ফিরে পাবার কথা মনে করাটা অনেকটা গুলিস্তানে মানিব্যাগ হারিয়ে পরদিবসে খুজতে যাওয়ার ন্যায়! যাই হোক আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেক ভাবনা মেলাতে পারলাম, মিলাতে পারলাম যে পাখি মেঘের উপরেও উড়ে তবে পরক্ষণেই কাঁধের উপর পাঁচ আঙুলের এক স্পর্শ অনুভব করলাম, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি বলে হয়তো বেশ শিহরিয়া উঠলাম নয়তোবা ৪ বছর পার হয়ে গেলো কোনো হাতের স্পর্শ আমায় শিহরিয়া উঠাতে পারে না! পেছন ঘুরে তাকালাম দেখলাম মেহরাব ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি বারান্দায় এসে নিজে নিজেই যতটা না বিব্রত হয়েছি তার চেয়ে মেহরাবকে বেশি বিব্রত দেখাচ্ছে, ও আসলেই আমার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে হয়তো বছর দুই এক পর আমাকে বারান্দায় আসতে দেখে, সে হয়তো ভাবছে বকা দিয়ে আমাকে আমার রুমে যেতে বলবে নাকি ভালোভাবেই বলবে কিন্তু সে কিছুই বললো না শুধুমাত্র তিনটে শব্দ ছাড়া আর তা হলো ” অফিসে যাবি না! ” আমার মুখপানে চেয়ে এর বেশি কিছু সে হয়তো বলতে পারলো না!
ওহ আজ না অফিসে যেতে হবে, কাজের তেমন চাপ নেই জুন ফাইনাল শেষ, এখন অবশ্য দু তিন ঘন্টা পরেই অফিসে যাই বেলা ১২ টা বাজে আমার অফিসে পৌছতে! যাই হোক ১০.৩০ বেঁজে গেছে এবারে খেয়েদেয়ে অফিস যেতে হবে। এই সফটওয়্যার কোম্পানির জবটাও মেহেরাব খুজে দিয়েছিলো, নিজের আপন লোক থাকলেও মনে হয় আমার জন্য এমনটা ভাবতো না, তবে মেহেরাব এর উপস্থিতিতে কখনোই আমার মনে হয় না যে আমার আপন বলে কেউ নেই, আপন করে কাউকে অবশ্যি আর নিতেও পারবো না ওকে ছাড়া, এতে অবশ্য কারো নিষেধাজ্ঞা নেই, মেহরাবও অনেক চেষ্টা করে আমাকে বেঁধে দিতে কোনো মেয়ের সাথে কিন্তু অনেক দেখলেও সাহস কুলোয় না ওর আমাকে বলতে, আসলে নিজ চোখে দেখেছেতো ও কিভাবে কি হয়ে গিয়েছিলো! নাহ মেহেরাব রুমে গেলো মিনিট দশেক হয়ে গেলো এখন রুমে যাওয়াই শ্রেয়, খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়লাম! বাসার নিচ থেকেই বাসে উঠলাম, পাশের দিকের সামনের সীটে দেখলাম একটা ছোট বাচ্চা হয়তো নার্সারি কিংবা কেজিতে পড়ে সে বাদাম খাচ্ছে আর তার মা তাকে খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছে, দৃশ্যটা দেখে কেমন যেনো হারিয়ে গেলাম অদৃশ্যে যদিও এমনটা হবার কথা না কারণ বছর ৪ যে হয়ে গেলো আমি বাদাম খাই না সবশেষ চারবছর আগেই বাদাম কিনতে গিয়েই যে আমি ১ম আঘাত পেয়েছিলাম! সেদিন যদি বাদাম কিনতে না যেতাম তবে মনে হয় এমন কিছু হতো না! সেই বাদাম গুলো এভাবে ছড়িয়ে পড়ে থাকতো না! পড়ে অবশ্য কয়েকদিন সেই বাদাম ওয়ালার খোজ করেছি সেই রাস্তার পাশে গিয়ে কিন্তু আর না পেয়েছি বাদাম ওয়ালার খোঁজ আর ২বছরের মধ্যে না পেয়েছিলাম তমার খোঁজ! যাই হোক এক ধোয়াসে অবস্থানে চলে গিয়েছিলাম ঠিক তখনই বাস কন্টাক্টারের ডাক মামা ভাড়াটা, ভাড়া বের করার সময়টাতে খেয়াল করলাম সামনের সীটের লোক বদল হয়ে গেছে, হয়তো বাচ্চাটা আর তার সাথে থাকা মহিলা উভয়েই আরো আগেই নেমে গেছেন!
এক বয়ষ্ক লোক বসেছেন সেখানে ওনাকে দেখতে পেছন থেকে অনেকটাই আমার মামার মতো, ছোট বেলায় বাবা মাকে হারিয়েছি তাদের চেহারাও স্মরণে নেই, ১৯ বছর পর্যন্ত মামার কাছে মানুষ হয়েছি তবে এই মামা সেই মামা নয় আসলে আমার একটাই চাচা ছিলেন আর তাকেই আমি মামা বলতাম তিনিও ওপারে চলে গেলেন ঘর সংসার বাধার আগেই! কি জানি বুঝিনা যে অপ্রাপ্তবয়স অবস্থাতেই আমায় ছেড়ে চলে যাওয়াটা সবার এমন রোগ কিন্তু আমি কেনো চাইলেও ওপারে যেতে পারিনা আমায় তো নেয় না, কই মেহরাবকে তো আমি আপন করিনি, ওই আমাকে আপন করেছে তাহলে ওর আপন মানুষ তানবিন কেনো চলে যায় না! নাহ বাস অফিসের সামনে এসে গেছে, এবার বাস থেকে নেমে একটু হাটার পথ অতিক্রম করলেই অফিস! আজ একটু দ্রুত গতিতে হাটার প্রয়াস চালাচ্ছি তাও মনে হচ্ছে ২/৩ মিনিটের রাস্তাটা ২/৩ কিলোমিটারের হয়ে গেছে বাস্তবেও অবশ্য দূরত্ব অনেক ক্ষেত্রেই বেড়ে গেছে! যাকজ্ঞে লিফট দিয়ে উঠে গেলাম ৪তলায়, বা দিকের প্রথম লাইনের তিন নাম্বার ডেক্সটা আমার, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়াররা এই প্রথম লাইনেই বসে! টাই টা হালকা লুজ করে বসলাম ইজি চেয়ারে পেছন দিকে হেলে! আজ যে কি হলো বুঝতেছিনা যেদিকেই তাকাই যার দিকেই তাকাই কেনো যেনো কিছু একটা ধোয়াসার ন্যায় ভেসে উঠে! কি হলো আজ! এটা কি আমি! আচ্ছা আজ কি বিশেষ কোনোদিন! আজই কি সেইদিন! আজ সেইদিন বলেই কি মেহরাব গতকাল রাতে ক্যালেন্ডার এর পাতাটা ছিড়ে সেলফের বই গুলোর নিচে দিলো! এসি টা অন করে কম্পিউটার টা চালু করলাম হোম স্ক্রিন আসার সাথে সাথেই নজরে পরে গেলো আজকের তারিখ, হ্যাঁ আজই তো সেইদিন! ৪বছর আগে ঠিক আজকের এই কথা দিনেই তো নিচতলার বাসায় উঠেছিলাম! সারাদিন ঘরে আনা জিনিসপত্র গোছাবার শেষে সন্ধ্যের দিকে চা বানিয়ে চলে যাই বারান্দায়! বারান্দায় গিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে থেকে প্রায় অর্ধেকটা কাপ খালি করে ফেলেছি, বাকী নেই অবশ্যি আর শেষ করা হয়ে উঠেনি! অর্ধেক শেষ হবার পরে বা দিকে ঘাড় ঘুরাতেই দোতলার বারান্দায় চোখ পড়ে গেলো! আমার দৃষ্টি ওদিক যেতে না যেতেই সোডিয়াম বাতির মৃদু আলোয় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অপরূপা মুগ্ধকারী মেয়েটি চুল আউলিয়ে ঘুরে ঘরে ঢুকে গেলো! কিন্তু আমার ঘাড় মাথা কিছুই আর ঘুরলো না! স্টাচু হয়ে চায়ের কাপ হাতে ওদিকে চেয়েই রইলাম!
অনেকক্ষণ পর মেহেরাব এসে ডাক দিলে আমার স্মৃতি ফিরে! সেদিনের সেই মুহূর্ত আমি কোনো জন্মেই ভুলতে পারবো না! যাই হোক সেদিনের পর থেকে আমি যতবার বারান্দায় গেছি আমাকে দেখার সাথে সাথেই সে চলে গেছে! এই ‘সে’ ই ছিলো তমা! আমি ভাবতাম সে হয়তো আমায় খুবই অপছন্দ করতো বলে আমায় দেখে চলে যেতো কিন্তু তার যাওয়ার মুহূর্তের মুচকি হাসিটা অবশ্যি তার উল্টোটা প্রকাশ করতো! কম্পিউটার এর সামনে বসে এসব ভাবতে ভাবতে তৎ মুহূর্তে কফি নিয়ে আসলো স্টাফ বললো “স্যার আপনার কফি”! কফি দিয়ে যাওয়া থেকে আমার মনে পরে গেলো তার কিছুদিন পরের কথা! প্রায় ৭/৮ দিন আমি বারান্দায় যাই আর ও চলে যায় এভাবেই চলে! কিন্তু হঠাৎ একদিন মেহরাব বাড়িতে গেলে পরদিন সকালে দরজায় কড়া! কেয়ারটেকার এসেছে ভেবে দরজা খুলতে না খুলতেই দেখি আমার স্বপ্নের নীলাম্বর আমার সামনে দাঁড়িয়ে! বিন্দু মাত্র অবাক হবার পূর্বেই সে বললো ‘এই নাও কফি’ আমি হাতে নেবার পূর্বে যে প্রশ্ন করবো তার উত্তর সে আগেই যোগ করে দিলো, বললো ‘জানি মেহেরাব বাসায় নেই আর হ্যাঁ জিজ্ঞাসা করবে কিভাবে জানলাম, জেনেছি দারোয়ান এর কাছ থেকে যাই হোক নিজে তো চা কফি কিচ্ছুটি বানাতে পারো না সব মেহেরাব করে তাই নিয়ে আসলাম, ধরো’ এই বলে মাইক্রো সেকেন্ডও দেরী না করে চলে যেতে নিলো একটু গিয়ে ঘুরে আবার বললো ‘কাপটা রেখে দিয়ো সময় করে নিয়ে যাবো’ ব্যাস এই বলেই শেষ! কফির স্বাদ নিয়ে তেমন কিছু মনে নেই কেননা কফিতে চিনি দিয়েছিলো বেশি! সাধারনত চিনি দিয়ে কফি খাই না, চা এর বেলায় তা হয়! আর মেহেরাব এর মত কেউ বানাতে পারবে না এমন বিশ্বাস ছিলো বলে হয়তো ভালো হলেও ভাল্লাগেনি! যাকজ্ঞে তখন আমি ধরে নেই তমা আমাকে পছন্দই করে! কিন্তু করলেও কি হবে আমার সাথে তার কোনো যোগাযোগ তো নেই আর সে তেমন কোনো সুযোগও দেয়নি পেট চাপড়ে জমে থাকা কথাগুলো বলার!
এভাবে মাস খানেক চলে যায়! এর মধ্যে ৭/৮ বার চায়ের কাপটা ফেরত দেয়ার সাহস দেখাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি আর নিতেও আসেনি, এর উছিলায় হয়তো একটু কথা হতো! তখন মাথায় শুধু এটাই ঘুরতো দেখা হবেনা কথা হবেনা তবে কেন কফি দিয়ে যাওয়া! এ ভেবে রাতে ঘুম না আসা নিত্যদিনের অভ্যেস হয়ে গেছিলো! তারপরে তমা’রা স্বপরিবারে কোথায় যেনো যায় ৩মাস পড়ে ফেরে! হয়তো বেড়াতে গিয়েছিলো,হয়তো না সত্যিই গিয়েছিলো, এরকম কনফিডেন্ট হয়ে বলছি কারন ওদের সাথে ওর প্রায় সমবয়সি এক মেয়ে ওদের বাসায় আসে! মেয়েটি ওর খালাত বোন, এটা অবশ্য জানতে গিয়ে বেশ উপকারই হয়েছিলো! একদিন আমি বাইরে যেতে নেই আর ওর সেই বোন তখন উপর যেতে নিচ্ছিলো সে মুহূর্তে মুখোমুখি হয়ে গেলে সে এক অপ্রীতিকর হাসি দেয় ঠিক তখনই আমি ওর পরিচয় জিজ্ঞাসা করি আর এভাবেই জানতে পারি ও কে! আরো একটা তথ্য পেয়ে যাই সেদিন আর তা হলো তমা’র কন্ট্রাক্ট নাম্বার! তারপরে নতুন একটা অধ্যায়ে চলে যাই! কফি খাওয়া শেষ, ১ঘন্টা হয়ে গেলো অফিসে বসে আছি কম্পিউটার ওপেন করে কোনো কাজের কাজই হচ্ছেনা! মনে হয়না আজ অফিসে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত থাকতে পারবো বলে! ভাবছি আজ ছুটি নিয়ে নেই, যা ভাবলাম তাই করে ফেললাম দুপুরে লাঞ্চ করেই ছুটি নিয়ে নিলাম! লাঞ্চ করার সময় মনে পড়লো তমা’র সাথে যেদিন আমার ফোনালাপ শুরু হয় তার প্রায় ২ সপ্তাহ পর একদিন ও নিজের হাতে বিরিয়ানী রেধে দিয়ে যায়! বিরিয়ানী ছোট বেলা থেকেই বেশ পছন্দের আর ঐ দিনেরটা ছিলো সেরা! সেদিন খাওয়ার সময় মনে হতে লাগলো ইসস তমা যদি খাইয়ে দিয়ে যেতো! প্রতিদিনকার ন্যায় সেদিনও রাত ১১টায় কল দিয়ে কথা বলার সময় বললাম ‘নিজ হাতে রাঁধলে আর নিজ হাতে খাইয়ে দিলে না!’ এটা শোনার পর সে ফোন কেটে দিলো! কয়েকবার কল দিলাম ধরলো না! কি হলো কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি! প্রায় এক মাস তার সাথে আর কথা হয়নি একদিন বারান্দায়ও আসেনি! একটা বিষয় অবশ্যি ছিলো বটে তখন অবধিও কিন্তু আমি তাকে কিংবা সে আমাকে ভালোবাসি বলে উঠিনি!
ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ না হলে হয়তো কাউকে খাইয়ে দেয়ার কথা বলা যায় না, তাই হয়তো যোগাযোগ করেনি এ ভেবেই এক মাস চলে যায়! যাই হোক লাঞ্চ শেষ হয়ে যেতে না যেতেই বেরিয়ে যায় বাসায় যাবো বলে, বেরিয়ে আবার সেই সকালের ন্যায় বাসে উঠি! এমন একটা সময় বাসায় ফিরছি যে এ সময়ে চোখে ঘুম পেয়েই থাকে সবার! আমার ছিটের পাশে এক মোটামুটি বয়সের বাচ্চা বসেছে, হয়তো ৭ম কিংবা ৮ম শ্রেনীতে পড়বে, ছেলেটি একটু পর পরই ঘুমিয়ে পড়ছিলো আর হেলে যাচ্ছিলো আমার দিকে! তখন আমার মনে পড়ছিলো একদিন এইভাবে হেলান দেয়া হয়েছিলো! সেটা ছিলো এক অন্যরকম হেলান দেবার সুযোগ! তমা’র সাথে মাস খানেক কথা হচ্ছিলো না, ঠিক আমার জন্মদিনের আগের রাতে ১১টায় সে ফোন দিয়ে কোনো কিছু না বলে শুধু বললো কাল দুপুর ২টায় বাড়ির ছাদে যেতে আর ঐ সময়েই যেতে কেননা তখন কেউ ছাদে থাকেনা, এইটুকু বলেই কেটে দিলো! আমি হ্যাঁ কিংবা না বলার সময় টুকু পাইনি! কাল যে আমার জন্মদিন ছিলো তাও আমার মনে ছিলোনা! মনে না থাকার দুটো কারণ ছিলো অবশ্য তা হলো এক মেহেরাব বাসায় ছিলো না আর দুই হলো তমা কেন দেখা করতে বললো! ২য় টা ভাবতে ভাবতেই সে রাত চলে যায় তাই মনে পরেনি জন্মদিনের কথা! পরদিন ঠিক সময়ে ছাদে গিয়ে দেখি তমা দাঁড়িয়ে আছে এক হাতে একটা পাখি আর অন্য হাত হাত দিয়ে পাখিটায় হাত বুলাচ্ছে! পাখিটাকে দেখেই বুঝে যাই এটা সেই পাখিটা যেটা ওদের বারান্দায় ও পুষতো! ও আমায় ডাক দিয়ে বললো পাখিটাকে ধরো, আমি ধরলাম তারপরে বললো এবার ছেড়ে দাও, আমি আমতা আমতা করে পাখিটাকে ছেড়ে দেই, ছেড়ে দেবার মুহূর্তেই সে জোড়ে জোড়ে বলছিলো ‘শুভ জন্মদিন তানবিন, শুভ জন্মদিন, শুভ হোক তোমার পথচলা’ আমিতো পুরো অবাক! ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম শুধু আর ও পাখিটাকে উড়তে দেখছে আর আমার দিকে না তাকিয়ে বলছে গিফটটা কেমন হলো! আমি কিছু না বলে ওর হাতটা ধরে ছাদের ডান দিকের ছিটে বসি, বসে ওর কাধে হেলান দিয়ে বলি ‘উপহারটে কিভাবে উড়ছে দেখছো?’ সে বললো আমি এ দিনটার অপেক্ষাতেই পাখিটাকে রেখেছিলাম! আমি সেদিন বেশ চমকিতো হই! হেলান দেয়া অবস্থাতেই জিজ্ঞাসা করি ‘তুমি কিভাবে জানলে আজ আমার জন্মদিন’! তমা কিছুই বললো না, কিছু না বলেই সাথে সাথে উঠে গেলো আর ছাদ থেকে নেমে বাসায় চলে গেলো! আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি!
এতোক্ষনে পাখিটাও আমার দৃষ্টি থেকে বহুদূরে চলে গেছে! সে তার স্বাধীনতা আমার উপহার হিসেবে রেখে গেলো! তবে আমার কাছে আজো এটাই অজানা রয়ে গেলো যে সে কিভাবে আমার জন্মদিন জানলো, এখন তো আর এই অজানা জিনিসটাকে জানতে পারবো না, জানার উপায় না রেখেই তো সে দূরে চলে গেলো! যাকজ্ঞে বাস বাসার কাছে এসে গেছে ভাড়াটা দিয়ে নেমে গেলাম! দু মিনিট হাটলেই বাসা! তারপরে হেটে উঠবো ৬তলা অবধি! যাই হোক বাসায় যাওয়ার রাস্তা অতিক্রম করবার সময় খেয়াল করলাম ওপাশে একটা ছেলে আর মেয়ে বসে বাদাম খাচ্ছে! আর এটা দেখার পর হাটার শক্তি হারিয়ে তখনই হারিয়ে গেলাম পুরোনো স্মৃতিতে! আমার জন্মদিনের ৩দিন পর ১৯শে শ্রাবণ সে আমাকে দেখা করতে বলে! ওটাই ছিলো আমাদের প্রথম এবং শেষ বাইরে কোথাও দেখা করা! তমার কথা মত ওর বলা যায়গাতেই দেখা করতে গেলাম! গিয়ে দেখি ওর হাতে একটা গোলাপ! মনে মনে নিশ্চিতই হয়ে গিয়েছিলাম আজ ও আমাকে নিশ্চয়ই ওর হবার কথা বলবে! দেখা হবার পর বললো ‘ঐদিন জিজ্ঞাসা করেছিলে না যে তোমার জন্মদিন কিভাবে জানলাম আসলে ওটা বলার জন্যই ডেকেছি, আচ্ছা দেখো ঐদিকে বাদাম বিক্রি করছে, আমার না বাদাম বেশ ভালো লাগে, তুমি কি বাদাম কিনে আনবে?’ আমার হ্যাঁ সূচক সম্মতি বুঝতে পেরে সে বললো ‘তুমি নিয়ে আসো আর আমি এখানে দাড়াই!’ সে দাঁড়িয়ে থাকলেই হয়তো ভালো হতো, তাহলে আমার জীবনের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়টা পার করতে হতো না! আমি ওপারে যাই বাদাম কিনি আর ওকে ডাক দিয়ে বলি ‘এপারে এসো’ আর এই এপারে আসো বলাটাই আমার জন্য সবচেয়ে ভুল ছিলো এপারে আসতে বলে ওকে জীবনের তরে ওপারে পাঠিয়ে দিয়েছি ভেবে আমি নিলজ্জ! আমি ডাকার সাথে সাথে এক মুহূর্ত দেরী না করে ডান বামে না তাকিয়ে এপাশে আসতে নেয় তমা! আর এটাই ছিলো ওর জীবনকে অন্তিম পথে নিয়ে যাবার প্রথমাংশ যার জন্য আমি দায়ী বলে নিজেকে জীবন্ত লাশ বলে মনে হয়! ও যখন আসতে নেয় ঠিক তখনই বাম পাশ থেকে একটা প্রাইভেটকার এসে ধাক্কা দিলে পড়ে যায়, গতিতে চলমান থাকায় গাড়িটা ওর পায়ের উপর দিয়ে উঠে যায় আর এমন দৃশ্য দেখার সাথে সাথেই আমি জোরে চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই! সেদিন আর কি হয়েছিলো তা আমি জানি না! যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমি বাসায়! মেহেরাব বললো একটু আগে নাকি আমাকে হাসপাতাল থেকে আমা হয়েছে! এতোটাই আঘাত পেয়েছিলাম যে প্রায় ২০ ঘন্টা পর আমার জ্ঞান ফিরে! আমি উঠে সাথে সাথে কিছু মনে করতে পারছিলাম না, মিনিট পাঁচেক পরে মনে পড়লে একটু উত্তেজিত হয়ে পড়ি! মেহরাবের কাছে জানতে চাইলে মেহরাব বললো ‘তমা এখন হাসপাতালে ভর্তি, এ যাত্রায় বেঁচে গেছে’। আমার শরীর এতোটাই খারাপ ছিলো যে ৩দিনের মধ্যে উঠতে পারিনি! প্রায় ৭/৮ দিন পর ঘর থেকে বের হয়েছি! তমার খোজ নিতে সাহস করে ওদের ঘরের সামনে যাই গিয়ে দেখি তালা মারা, ভেবেছিলাম এখনো হয়তো হাসপাতাল থেকে ফেরেনি কিন্তু মনের সংকোচ রয়েই গেছিলো! দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করতেই মাথায় বজ্রপাত পড়লো, জানতে পারলাম তমা’রা এ বাসা থেকে চলে গেছে! আমি সাথে সাথে রুমে গিয়ে ওর নাম্বারে কল দিলাম দেখি সুইচড অফ!
তারপর থেকে যতদিন কল দিয়েছি এটাই শুনেছি! এখন তো আর কল দিলেও লাভ হবেনা জানি! ধরবার মানুষটা যে নেই! আমি তারপরে অনেক চেস্টা করেছি ওদের ঠিকানা বের করবার কিন্তু পারিনি! মেহেরাবও কোনো খোজ দিতে পারলো না! ও যে পঙ্গু হয়ে গেছে, হুইল চেয়ারে চলাফেরা করে বলে আমার সামনে আসতে সাহস পায়নি তাই বাসা বসলে চলে গেছে তা হয়তো কোনোদিন জানতে পারতাম না ও যদি এভাবে না চলে যেতো! যাই হোক ওদের বাদাম খাওয়া শেষ আমি স্টাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আগের কথা ভেবেই যাচ্ছি! এ ভেবে লজ্জা লাগলো যে আজকে সারাদিনের সব ভাবনা ঠিক থাকলেও এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকাটা মোটেও ঠিক হয়নি, বাসায় চলে গেলাম! ৬টা তালা সিড়ি বেয়ে উঠতে একটু কষ্টই হয়েছে বটে! চাবি দিয়ে রুম খুলে ভিতরে ঢুকলাম! মেহরাব বিকালে আসবে বাসায়! ওর আসতে আরো ঘন্টাখানেক বাকী! কি করবো কোনো কাজ না পেয়ে মেহেরাবের টেবিলের উপর থেকে পেপারটা নিয়ে পড়া শুরু করে দিলাম! আগে আমিই পেপার রাখতাম প্রতিদিন পড়তাম কিন্তু বছরখানেক ধরে অভ্যাসটা বদলে দিছি! মেহেরাব পড়ুক বা নাইবা পড়ুক আগের ধারাবাহিকতায় পেপার ঠিকই রাখে! যাই হোক পেপার পড়তে গিয়ে দেখি চোক ধাধানো আর্টিকেলের দিকে, দেখলাম চায়নাতে প্লাস্টিকের ডিম আবিষ্কার হয়েছে, দিনাজপুরে বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন হয়েছে, রোনালদোর ডাবল হ্যাট্রিক, ক্যান্সার কোষের সহজ দমন হচ্ছে বাংলাদেশে! লাস্ট লাইন টা দেখে খুবই কাতর হয়ে পড়লাম! মনের আন্দাজে চোখের কোণে পানি জমে গেলো! ঐসব ঘটনার প্রায় ২বছর পর একটা আননোন নাম্বার থেকে আমার ফোনে কল আসে! কল ধরতে না ধরতেই ওপাশ থেকে এক ভদ্র মহিলা বললো ‘হেলো বাবা আমি তমার মা, তমা খুব অসুস্থ, মনে হয়না আর বাঁচবে বলে, লাইফ সাপোর্টে আছে তুমি একটু এসে দেখে যাও’ এই বলে সে হাসপাতালের ঠিকানা বলে দিলো! আমি যেতে বড্ড দেরী করে ফেলি! আমি যাবার মিনিট পাঁচেক আগেই তমা সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে! গিয়ে দেখি ওকে রিজার্ভে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! তমার মা এতোটাই শোক পেয়েছেন যে তার চোখ দিয়ে এখন আর বিন্দুমাত্র জল বেরোচ্ছে না হয়তো কাঁদার শক্তিও সে হারিয়ে ফেলেছে! তারপরেও কষ্ট করে সে বললো ‘আমি তোমাদের সব কথাই জানি, প্রথমদিনের দেখা হতে শুরু করে সবই তমা আমাকে বলেছে! ও ওর পা হারিয়েছে এটা তুমি দেখলে সহ্য করতে পারবে না বলে ও আমাকে ওর দিব্যি দিয়ে বলেছে যেনো তুমি কোনোভাবেই ওর সাথে দেখা করতে না পারো, তাই চলে যাওয়া, তাই যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া, ও প্রতিদিন তোমার কথা বলতো আমায়, এই দু বছর প্রতিদিন ও কিছু না কিছু লিখেছে ওর ডায়রিতে, ওটা যে ও কোথায় রাখতো তা ও ছাড়া কেউ জানে না! গতবছরের শেষ ওর পায়ের এক সাইডের ইনফেকশন থেকে ক্যান্সার হয় আর ক্যান্সার ধরা পরার ৬ মাসও টিকে থাকতে পারলো না চলে গেলো, তোমায় খুবই ভালোবাসত, মা আর মেয়ে আমরা বন্ধুর মতো ছিলাম তো তাই আমি সবই বুঝি, ও বেশ চুপটি করে থাকা মেয়ে তো তাই কিছুই বলতে পারেনি তোমায়, ভালো থেকো বাবা, এখন যাও!’ তখন আর কোনো কিছু বলার ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম না! সাহস হলোনা আর আন্টির সামনে থাকার! বেরিয়ে চলে আসলাম! কাঁদতে কাঁদতে জামা-কাপড় ভিজে গিয়েছিলো! এখন অবশ্য আর কাঁদি না, এখন আর কান্না পায় না, শুধু মনে মনে কিছু কথা ভাবি যার উত্তর আজো পাই না! প্রশ্ন গুলো আমার মাথায় প্রতিদিন আঘাত করে, ‘তুমি কবে চায়ের কাপটা ফেরত নিবে? তুমি কিভাবে আমার জন্মদিন জানলে? তুমি কার জন্য গোলাপ এনেছিলে?’
আমার ভালবাসা অসমাপ্ত রেখে, তোমায় ভালোবাসি বলার সুযোগ না দিয়ে উপহারের পাখির ন্যায় কেন আমায় ছেড়ে উড়ে গেলে!