spot_img
More
    Homeশিশু কিশোর নির্যাতনশিশু কিশোর কিশোরীরা নিরাপদে বেড়ে উঠছে তো?

    শিশু কিশোর কিশোরীরা নিরাপদে বেড়ে উঠছে তো?

    মনে করুন পৃথিবীর কোথাও যুদ্ধ নেই,কোথাও হানাহানি নেই। রোজ সকালে বড়রা অফিসে যাচ্ছে,কৃষক মাঠে যাচ্ছে, শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে। বিকেলে ফিরেও আসছে। কিন্তু এর মাঝেও যুদ্ধ চলছে মনের মধ্যে। আর মনের মধ্যে চলা যুদ্ধতো আর বাইরের কেউ দেখতে পায় না। ফলে সেই যুদ্ধটা জয় করা বা পরাজিত হওয়াটা কেবল সেই মানুষটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আর এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় আমাদের শিশু কিশোর কিশোরীরা। এই যুদ্ধের মোকাবেলাও করতে হয় শিশু কিশোর কিশোরীদের। এই যুদ্ধে তাদের ভয়ংকর শত্রু হিসেবে আবির্ভুত হয় বড়রা। আমার কথা শুনে অবাক হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা তেমনই। আপনাকে যদি প্রশ্ন করি আপনার শিশু সন্তান কি নিরাপদে বেড়ে উঠছে? আপনি হয়তো বলবেন অবশ্যই নিরাপদে বেড়ে উঠছে। তাকে আপনি আগলে রাখছেন,স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দিচ্ছেন,অসুখ যেন না হয় খেয়াল রাখছেন, ভালো স্কুলে পড়াচ্ছেন,ভালো শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে রেখেছেন,ভালো কাপড় কিনে দিচ্ছেন। কিন্তু এগুলোই যে নিরাপত্তার সবটুকু নয় সেটাওতো ভাবতে হবে। আর আমি আজ আপনাদের সেই সব বিষয়ে ধারণা দিতে চাই যে সব বিষয়ে আমাদের শিশু কিশোর কিশোরীরা নিরাপদ নয় বা নানা ভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

    শিশু কিশোর কিশোরীদের ক্ষতি কিন্তু শুধু রোগ ব্যাধীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং তারা মানুষের মাধ্যমেও ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। আর সবচেয়ে বড় ভয় সেখানেই। আমাদের সমাজে কমবেশি সবাই তাদের বাচ্চাদের অপরিচিত মানুষদের থেকে কীভাবে নিজেদের নিরাপদ রাখতে হয় এই শিক্ষা দেই। কিন্তু মনে রাখা দরকার বিপদ কিন্তু সবসময় অপরিচিতদের দ্বারা হয় না বরং পরিচিতদের মাধ্যমেও হয়ে থাকে। সেই যে প্রবাদ আছে ঘরের শত্রু বিভীষণ অনেকটা সেরকম। গবেষকদের গবেষণা পরিস্যংখান থেকে আমরা দেখতে পাই শতকরা ৭৫% শিশুই তার পরিচিত বা আত্মীয়দের দ্বারা নিপীড়িত হয়। মনে রাখা দরকার নিপীড়িত হওয়া মানে কিন্তু প্রহরিত হওয়া বা মাইর খাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। নিপীড়ন শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যৌন হয়রানি তার মধ্যে অন্যতম। এ বিষয়ে এমন কিছু তথ্য আছে যা জেনে রাখলে বুঝবেন আপনার সন্তানটি নিরাপদে বেড়ে উঠছে কিনা।

    কী করে বুঝবেন আপনার সন্তানটি নিরাপদ কি না? 

    (১) একটা ব্যাপার অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, নির্যাতনকারীর কাছে শিশুটি ছেলে নাকি মেয়ে তা ব্যাপার নয়। নিপীড়নকারী হল কিছু বিকৃত রুচির লোক যারা ছোটদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ইংরেজিতে এদের বলে পেডোফাইল (Pedophile), এবং এই বিকৃতিকে বলে পেডোফিলিয়া। নিপীড়িত শিশুদের মধ্যে ২৫%-ই ছেলে। সুতরাং নিচের সব রুলস শুধু মেয়েদের বেলায় প্রযোজ্য আর আপনার ছেলে শিশুটি সেইফ, এমন কখনোই ভাবতে যাবেন না। আত্মরক্ষার কৌশল জানা ছেলে-মেয়ে, ছোট-বড় সবারই জানা জরুরি।

    (২) প্রথমেই শিশুকে শিখান বাবা-মা, ভাইবোন ছাড়া অন্য যে কারো কাছ থেকে কতটুকু দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। শিশুকে তার ব্যক্তিগত শারীরিক সীমা সম্পর্কে শিক্ষা দিন। তার শরীরের সেইফজোন আর আন-সেইফজোন সম্পর্কে ধারণা দিন। তাকে বোঝান যে ঠিক কতটুকু কাছে সে কাউকে আসতে দেবে আর কতটুকু কাছে আসলে আপত্তি প্রকাশ করতে হবে।

    (৩) মনে রাখবেন, বেশিরভাগ সময় শিশু আপনারই কোন আত্মীয় অথবা পরিচিত মানুষ যাকে আপনি বিশ্বাস করেন, তার দ্বারা নিপীড়িত হয়। তাই আপন পরিবারের সদস্য ছাড়া অন্য কারো কাছে শিশুকে দিবেন না। কেউ আপনার শিশুর প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দিচ্ছে কিনা লক্ষ্য রাখুন; বেশি করে আদর করা অথবা শিশুকে খুশি করার জন্য তার প্রিয় উপহার অথবা চকলেট দিয়ে তাকে কোলে নেয়ার চেষ্টা করছে কিনা খেয়াল রাখুন। শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সবার আগে আপনাকেই মনযোগী ও সাবধান হতে হবে।

    (৪) কোন আত্মীয় বা পরিচিত কারো সাথে কখনোই শিশুকে একা কোথাও যেতে দিবেন না। তাকে কারো কাছে রেখে কোথাও যাবেন না। বাসায় একা রেখে না যাওয়ার চেষ্টা করবেন, আর গেলেও তাকে শিখিয়ে দেবেন বাবা-মা ছাড়া আর কেউ আসলে কোন অবস্থাতেই যেন দরজা না খুলে। কেননা, এসব ঘটনা বেশিরভাগ সময় আপনি যাদের বিশ্বাস করছেন তাদের দ্বারাই হয়ে থাকে।

    (৫) আপনার শিশুর আচরণের দিকেও মনোযোগ দিন। কোন আত্মীয়র প্রতি শিশুর বিরূপ মনোভাব দেখলে সাবধান হয়ে যান এবং এর কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন। হয়ত তার কাছে যেতে আপনার শিশুটি অস্বস্তিবোধ করছে, কিংবা তাকে দেখে ভয় পাচ্ছে অথবা কাঁদছে; এমন ক্ষেত্রে কখনই তাকে জোর করবেন না বরং সুন্দরভাবে কথা বলে কারণ জানার চেষ্টা করুন।

    (৬) শিশুকে শিক্ষা দিন কীভাবে এবং কোথায় স্পর্শ করা অগ্রহণযোগ্য। অপরিচিত হোক বা খুব কাছের কেউ, কোন অবস্থাতেই যেন কেউ অস্বস্তিকরভাবে তাকে টাচ না করে এবং এমন কিছু হলে যেন আপনাকে জানায়।

    (৭) স্কুল থেকে আনা নেওয়া করার জন্য যত বছরের পুরনো ড্রাইভারই হোক, তাদের দায়িত্ব দেবেন না কিংবা জরুরী প্রয়োজনে দিলেও বাসায় আসার পর শিশুর কাছ থেকে পরোক্ষভাবে জেনে নিশ্চিন্ত হয়ে নিন।

    (৮) শিশু যদি কারো ব্যাপারে আপনার কাছে শেয়ার করে, তাকে সাহস আর আশ্বাস দিন। আপনার অনেক কাছের কারোর ব্যাপারে হলেও শিশুকে অবিশ্বাস করবেন না, তাকে লোকলজ্জার ভয়ে চুপ থাকতে বলবেন না বরং অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিন। চুপ থাকা কোন সমাধান না, ছোটবেলার খুব ছোট ছোট বাজে অভিজ্ঞতার স্মৃতি সারাজীবন তাদের ট্রমা হিসেবে বয়ে বেরাতে হয়।

    (৯) আপনার ছেলে-মেয়ে যদি অ্যাবিউজড হয়, তাহলে তাকে দোষারোপ করতে যাবেন না। মনে রাখবেন, মানসিক বিকারগ্রস্ত লোকের কাছে নির্যাতন করার জন্য কোন কারণ বা লজিক লাগে না। ভিকটিম ব্লেমিং না করে অপরাধীর বিরুদ্ধে অবস্থান করুন। বাংলাদেশে এখন চিলড্রেন এন্ড উইমেন অ্যাবিউজ (নারী ও শিশু নির্যাতন) আইন বেশ কঠোর। তাই, উপযুক্ত আইনের আশ্রয় নিন।

    বিপদের মুখোমুখি হলে কী করবে?

    (১) বাবা-মার নাম করে স্কুল থেকে কিডন্যাপাররা শিশুদের নিয়ে যেতে পারে এমন ভয় মোটামুটি সব শিশুকেই দেখানো হয়। কিন্তু সত্যি সত্যি এমন পরিস্থিতিতে পরলে কি করতে হবে তা শেখানো হয় না। ১টা কোড ওয়ার্ড ঠিক করুন। এমন ১টা শব্দ যা শুধু শিশু এবং তার মা-বাবা জানবে। খুব অদ্ভুত কোন শব্দ না আবার একদম সাধারণ কোন লাইন ও যেন না হয়। আপনি স্কুলে অন্য কাউকে পাঠালে শিশুকে বলুন নিশ্চিত হয়ে নিতে ঐ শব্দ ব্যবহার করে যে গিয়েছে তাকে আপনিই পাঠিয়েছেন কিনা। কিন্তু পারতপক্ষে এরকম কাউকে না পাঠানোই বেটার যাকে আপনার শিশু ভালোভাবে চিনে না।

    (২) শিশুকে অপরিচিত কারো হাত থেকে খাবার নিতে নিষেধ করবেন। এমন কি রাস্তা থেকে খাবার কিনে খাওয়ার ব্যাপারেও সাবধান করুন। কিছুদিন আগে ভারতে এমন নিউজ হয়েছিল যেখানে দেখায় কীভাবে কিডন্যাপারদের একটি চক্র রাস্তার ঝালমুড়ি, ফুচকাওয়ালাদের সাথে মিলে খাবারে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয়।

    (৩) আপনার মেয়েটি রাস্তায় একা চলার পথে তাকে যদি কেউ ফলো করে তাহলে তাকে বলুন যেন যতোটা সম্ভব জোরে চিৎকার করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। আর যদি কোন গাড়ি পিছনে আসতে থাকে তাহলে যেন সে গাড়ির উলটো দিকে দৌড়াতে শুরু করে, তাহলে গাড়ি ঘুরিয়ে আসার ফাঁকে সে অনেকটা দূর যেতে পারবে।

    (৪) হঠাৎ যদি কোন গাড়ি পাশে এসে থামিয়ে তাকে ভিতরে নেয়ার চেষ্টা করে, তাহলে যতোটা সম্ভব জোরে হাত-পা ছুঁড়তে হবে, কোনভাবেই যেন গাড়ির ভিতরে ঢুকাতে না পারে।

    (৫) একটু বয়স হলেই আপনার ছেলে এবং মেয়েকে বেসিক আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দিন। এখন শহরের বিভিন্ন জায়গায় মার্শাল আর্ট, কারাতে, জুডো, তায়কোয়ান্দ, ক্রাভ-মাগা ইত্যাদি শেখানোর একডেমি আছে। এগুলো শিখে রাখা ছেলে-মেয়ে সবার জন্যই সমান ইম্পরট্যান্ট। যেকোনো ইমারজেন্সি সিচুয়েশনে নিজেকে বাঁচাতে কী কী করতে হবে তা জানা থাকলে আপনি অনেকটাই নিশ্চিন্তে তাদের বের হতে দিতে পারবেন।

    আপনার সন্তানটি নিরাপদে বেড়ে উঠছে কিনা তা এখন আশা করি বুঝতে পেরেছেন। আপনার সন্তানটি নিরাপদে বেড়ে এই কামনা রইলো, ভালো থাকবেন।

    লেখকঃ মোঃ জাহিদুল ইসলাম

    RELATED ARTICLES

    Most Popular