আমি যখন অনেক ছোট। বয়স নয় কিংবা দশ, তখন এক বন্ধু আমাদের বলেছিল ওর পাশের বাসার মামা ওর সাথে খুব খারাপ কাজ করেছে। আমরা খুব অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, তোমাকে কি উনি মেরেছেন নাকি বকেছেন? এর উত্তরে ও যা বলল, তা শুনে আমরা সত্যিকথা বলতে তখন কিছুই বুঝতে পারিনি। ও বলল, বাসায় বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার সুযোগে মামা আমাকে দিয়ে শরীরের কী যেন একটা অঙ্গ ধরিয়েছিল। ও এই কথাটি তখন বাসার কাউকে বলতে পারেনি। শুধু আমাদের বলেছিল, যদিও ও এবং আমরা কেউই তখন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি ঐ লোকটি তাকে দিয়ে কি ধরিয়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে আমরা সবাই ওই লোকটিকে এড়িয়ে চলতে শুরু করি। পরে যখন সেই নোংরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম, ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠেছিল।
এরকম বাজে অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই হয়েছে, কিন্তু সমাজ, সংসার ও নিজের সম্মানের কথা বিবেচনা করে আমরা কেউ মুখ খুলি না । আর মুখ খুলি না বলে অপরাধ ও অপরাধীরা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে ।
শিশুরা, বিশেষ করে মেয়েশিশুরা বড়দের বাজে স্পর্শ ও আদর বুঝতে পারে, কিন্তু তারা অভিভাবকদের কাছে তা বলে না বা বলতে পারে না। পরিবারের ভেতরেই প্রথম একটি মেয়েশিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়। এমনকি তার এত কাছের ও বিশ্বাসের মানুষের দ্বারা সে অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ, স্পর্শ ও যৌন নিপীড়ণের শিকার হয় যে, সেই কথা সে কারো কাছে মুখ ফুটে বলতেও পারে না। এমনকী বন্ধুদের কাছেও বলতে সংকোচবোধ করে। সে নিজেই ঐ ব্যক্তিকে নানাভাবে এড়িয়ে চলতে চায়।
কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তি তার এত কাছের মানুষ যে, তাকে এড়িয়ে চলাও তার মত ছোট্ট মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় না। অপ্রিয় হলেও একথা সত্য যে, কোন কোন সময়, “রক্ষকই ভক্ষক” হয়ে ওঠে। তাছাড়া শিশুটির মা-বাবা বা অন্য অভিভাবকদের অসচেতনতা, উদাসীনতা ও অজ্ঞানতার কারণেও অপরাধীরা বারবার এ ধরণের অপরাধ করতে সাহস পায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুর মা বা তার অভিভাবকরা ধারণাই করতে পারেন না যে পরিবারের কোন সদস্যটি এরকম ঘৃণ্য কাজটি করছে।
আমার বয়স যখন ১৩/১৪ হঠাৎ জানতে পারলাম আমাদের নীচতলার ৪/৫ বছরের বাচ্চা মেয়েটিকে তাদের বাসার কাজের ছেলেটি ধর্ষণের চেষ্টা করেছিল। হঠাৎ সেখানে অন্য মানুষ চলে আসায় মেয়েটি রক্ষা পায় আর ছেলেটির শাস্তি হয়। এখন আমার মনে নেই ওর কী শাস্তি হয়েছিল! কিন্তু ঘটনাটি আমার মনে সাংঘাতিক রকম প্রভাব ফেলেছিল। কারো বাসায় কাজের জন্য বড় কোন ছেলে দেখলেই আমার অস্বস্তি হতো। অথচ সেসময় প্রায় সব বাসাতেই হেল্পিং স্টাফ হিসেবে ছেলেই রাখা হত। গৃহপরিচারিকা রাখার প্রচলন আরো পরে শুরু হয়েছিল।
আমি এখনও দেখি অনেকেই, এমনকি শহরের শিক্ষিত পরিবারের ছোট কন্যাশিশুটিকে ড্রাইভার, গার্ড বা বাসার হেল্পিং স্টাফের কোলে দিয়ে পাড়ার দোকানে পাঠানো হচ্ছে, বা স্কুলে পাঠানো হচ্ছে বা বাইরে বেড়াতে পাঠানো হচ্ছে। এরা যে সবাই মন্দ হবে তা নয়, কিন্তু আমাদের ছোট্ট শিশুটির নিরাপত্তার দিকটি আমাকেই ভাবতে হবে। বেচারাকে যদি কেউ একটুও আপত্তিকরভাবে আদর করে বা গায়ে হাত দেয়, ও কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতেও পারবে না। বুঝলেও বলতে পারবে না। একটু সচেতন হলেই কিন্তু অনেক বিপদ এড়ানো যায়।
এখানে প্রশ্নটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের নয়, আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তার প্রশ্ন । আহারে, স্কুলের মেয়েগুলোকে যখন দেখি ভ্যানগাড়িতে বাড়ি ফিরছে, তখন একদম শেষে যে মেয়েটি বাড়ি ফিরবে, তার কথা ভেবে বুকটা ভয়ে হুহু করে উঠে। হয়তো উপায় নাই বলে ওকে এই ব্যবস্থা দেয়া হয়েছে। এই অনিরাপদ সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা কোথায়? কীভাবে?
এরকম বিভিন্ন ঘটনার কথা জানার পর আমি যখন কন্যা সন্তানের মা হলাম, তখন আমি মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে সবসময় উদ্বিগ্ন থাকতাম। ও একটু বড় হওয়ার পর থেকেই ওকে সচেতন করার চেষ্টা করেছি মানুষের অনভিপ্রেত স্পর্শ বিষয়ে। বারবার বলেছি, কেউ যদি ওকে কোন বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে টাচ করে ও যেন আমাদের বলে দেয় এবং নিজে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। সেই অপরাধী ওর যত কাছের মানুষই হোক না কেন, ও যেন বিষয়টি আমাদের জানায়। কাউকে একবিন্দুও ছাড় দেয়া হবে না। আর কেউ যদি কোনকিছুর দেয়ার বা খাওয়ানোর প্রলোভন দিয়ে একা ঘরে নিয়ে যেতে চায়, ও যেন কিছুতেই না যায় ।
কে ভাল আর কে মন্দ তাতো অনেকসময় খালি চোখে দেখা যায় না, মাঝেমাঝে বোঝাও যায় না। কাজেই বাচ্চাটিকে ঠিক কার সম্পর্কে কী বলবো, তা বোঝা কঠিন হয়ে যায়। বাইরের বিপদ থেকে বা কারো সম্পর্কে আপনি বাচ্চাটিকে সাবধান করতে পারেন, তাকে পাহারা দিয়ে রাখতে পারেন, কিন্তু পরিবারের ভেতরের সদস্যটির ব্যাপারে আপনি তাকে কী ও কতটা বলতে পারেন? কিভাবে সাবধান করতে পারেন? বিপত্তিটা কিন্তু এখানেই।
অথচ একটি মেয়েশিশু তার পরিবারের ভেতরেই প্রথম আপত্তিকর স্পর্শ, আচরণ, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। শুধু মেয়েশিশু নয়, ছেলে শিশুও এর ভিকটিম হতে পারে এবং হয় পরিবারের বড় নারী ও পুরুষ সদস্যদের দ্বারা। তাই তাকে বোঝাতে হবে, বলতে হবে সে যদি পরিচিত বা অপরিচিত কারো দ্বারা অনাকাংখিত ব্যবহারের মুখে পড়ে, তাহলে যেন সে চুপ করে না থাকে, লজ্জা না পায়। অনেকসময়ই বাচ্চাটি নিজেই ঠেকানোর চেষ্টা করে, বা বাইরের বা পরিবারের কোন কোন মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে, তখন বুঝে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে, সে কেন এমনটা করছে। তার মতামতের, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথাটিকে মাথায় নিতে হবে।
আর চুপ করে থাকা নয়। আমাদের মুখ খুলতে হবে, রুখে দাঁড়াতে হবে। সমাজে বাবা-মা-অভিভাবকদের সচেতনতার মাত্রা বাড়াতে হবে। শিশুকে বোঝাতে হবে এসব ক্ষেত্রে লজ্জা ওর নয়, যে বড় মানুষটি তার সাথে এই মন্দ আচরণ করছে, তার। শাস্তি পাবে সে। পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে এই জঘন্য অপরাধ ও অপরাধীকে ছাড় দেয়া নয়। ঘর থেকে শুরু করতে হবে। বাইরের অপরাধীও তখন আর পার পাবে না ।
‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নারীর প্রতি সহিংসতা ইস্যুটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এরকম এত অসংখ্য ঘটনার কথা জেনেছে যে তা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। এমন ঘটনার কথা শুনেছে যে যা প্রকাশ করব কীভাবে, তা ভেবেও উপায় বের করতে পারি না। আমি পরের ইস্যুটিতে সেসব কথাই তুলে ধরতে চাই।
(লেখাটি চ্যানেল আই অনলাইন থেকে সংগ্রহীত)
আরও পড়ুনঃ
Comments are closed.