স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে যাও। স্বপ্ন সেটা নয় যা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখো, স্বপ্ন হলো সেটাই যা তোমাকে ঘুমোতে দেয় না -এ পি জে আবদুল কালাম।
হঠাৎ করেই স্যার ক্লাসে প্রশ্ন করে বসলেন তোমরা কি কেউ এ পি জে আবদুল কালামের নাম শুনেছ? আমি এ পি জে আবদুল কালাম সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না তাই বাসায় এসেই বসে পড়লাম এ পি জে আবদুল কালাম সম্পর্কে জানতে।এ পি জে আবদুল কালাম এর জীবনী পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি।বিশ্বজয়ের স্বপ্ন,সেরা হবার স্বপ্ন,মানুষের কল্যানে নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দেয়ার স্বপ্ন।স্বপ্নই তো মানুষকে বড় হতে শেখায়।জীবনে সফলতার বীজ বুনতে হলে স্বপ্ন দেখতে হবে।স্বপ্ন ছাড়া সফলতার স্বাদকে কীভাবে আলিঙ্গন করা সম্ভব? স্বপ্ন দেখতে হবে হররোজ,দুর্জয়কে জয় করার স্বপ্ন,অজেয়কে আলিঙ্গন করবার স্বপ্ন।সেই স্বপ্নের পথে প্রাণান্ত প্রচেষ্টার মাধ্যমে সেই স্বপ্নকে করতে হবে সত্যি যেমনটা করেছিলেন এ পি জে আবদুল কালাম।
এ পি জে আবদুল কালামের জন্ম মাদ্রাজের দ্বীপশহর রামেশ্বরমে এক তামিল পরিবারে।তার বাবার নাম ছিল জইনুল আবেদিন এবং মায়ের নাম ছিল আশিয়াম্মা।যদিও তাদের ছিল না কোন প্রথাগত শিক্ষা তবুও ছিল হৃদয়ের সহজাত প্রজ্ঞা এবং একাগ্র উদারতা।পরিবেরর বাইরের লোকেদের খাবার যোগাতেন তারা প্রতিদিনই।
এ পি জে আবদুল কালাম জন্মেছিলেন মুসলিম পরিবারে।রামেশ্বরমের মস্ক স্ট্রিটে এক পাকা বাড়িতে ছিলো তাদের বসবাস যা ছিল বেশ বড়সড় আর ইট ও চুনাপাথরে গাঁথা।একদম ছিমছাম এবং সাদামাটা জীবনধারণে অভ্যস্ত ছিলেন তারা।প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার বাবা চলে যেতেন নারকেল্কুঞ্জে আর ফিরে আসতেন ডজনখানের নারকেল কাধে ঝুলিয়ে।
এ পি জে আবদুল কালাম খাবার খেতেন তার মায়ের সাথে রান্নাঘরের মেঝেতে বসে কলাপাতা বিছিয়ে তাতে ভাত এবং সুগন্ধী সম্বর(এক ধরনের তরকারি) দিয়ে।সাথে থাকত ঝাল আচার এবং নারকেলের চাটনি।মস্ক স্ট্রীট থেকে বের হয়ে প্রায়ই দ্বীপের বালুকাময় বেলাভূমির দিকে হেটে বেড়াতেন বন্ধু জালালুদ্দিনের সাথে। যদিও জালালুদ্দিন তার থেকে বয়সে অনেক বড় ছিলো জালালুদ্দিন আবদুল কালামকে আজাদ বলে ডাকতেন।জালালুদ্দিন ছিলেন দ্বীপের একমাত্র ব্যাক্তি যিনি ইংলিশ বলতে পারতেন।জালালুদ্দিন সবসময় আজাদকে বলতেন শিক্ষা দীক্ষার কথা,বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা,সাহিত্য ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে সফলতার কথা।পরিচিত সংকীর্ন জগতের বাইরের নতুন পৃথিবী সম্পর্কে সবদাই গল্প শোনাতেন আজাদকে।
স্বপ্ন মানুষের জীবনে এক ঐশ্বরিক শক্তির সঞ্চার করে ।তাইতো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের অবসান ঘটবার পর পরই আবদুল কালাম তার বাবার কাছে জেলা সদরে গিয়ে সেখানে থেকে পড়াশোনা করার অনুমতি চাইল ।জবাবে তার বাবা বললেন ,”আবদুল আমি জানি বড় হবার জন্যে তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে।সমুদ্রের চিলকে কী একাকী উড়ে যেতে হয় না?তোমার স্মৃতি যাকে জড়িয়ে আছে সেই জায়গার মায়া ছেড়ে তোমার সব চাইতে বড় যে আকাঙ্ক্ষা, তার জায়গায় তোমাকে যেতেই হবে”।শোয়ার্জ হাইস্কুলে ভর্তি হবার পর থেকেই বাড়ীতে আসার জন্যে মন টা কেদে উঠলেও নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেয়ার এবং স্বপ্নজয়ের প্রতিজ্ঞায় সকলের সাথে মিলেমিশে থাকা ,একসাথে পরিবারের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো এবং মায়ের হাতের সুস্বাদু পিঠা “পোলির” স্বাদকে ভুলে থাকাটা অনেক কষ্টকর ছিলো কালামের জন্যে তাইতো সময় পেলেই চলে যেতো তার নিজ বাসভূম রামেশ্বরম।
শোয়ার্জ হাই স্কুলের পর ১৯৫০ সালে সেন্ট জোসেফ কলেজে হাজির হয় আবদুল কালাম। দুই শিক্ষক অধ্যাপক চিন্নাদুরাই এবং অধ্যাপক কৃষ্ণমূর্তি অপারমানবিক পদর্থবিদ্যার যে দীক্ষা কালামকে দেন তাতে পদার্থবিজ্ঞানের উপর কালামের চিন্তনশক্তির ব্যাপক বিস্তার লাভ করে।সেন্ট জোসেফে বি এ অনার্স ডিগ্রি লাভ করবার পর কালামের উপলব্ধি হয় যে পদার্থবিদ্যা তার বিষয় নয়।তার স্বপ্ন ইঞ্জিনিয়ারিং। যদিও অনেক দেরি হয়ে গেছে কিন্তু আবদুল কালাম ভাবলেন দেরিতে হলেও ,একদম না করবার চেয়ে দেরিতে করাই ভালো।
মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি ছিল দক্ষিন ভারতের প্রযুক্তিবিদ্যার জন্যে শ্রেষ্ঠ ।ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও যে টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়া লাগত তা যোগাড় করা ছিলো আবদুল কালামের জন্য দুরুহ ব্যাপার।তাই এক হাজার টাকা জোগাড় করতে সোনার চুড়ি আর গলার হার বন্ধক রাখতে হয় কালামের বোনকে।কালামের সামর্থ্যের উপর দৃঢ় আস্থা ছিলো তার পরিবারের সবার।
এম আই টি তে অধ্যাপক স্প্যান্ডার,কে এ ভি পান্ডালাই এবং নরসিংহ রাইয়ের উপর ভিত্তি করে নিজের প্রতিভার উজ্জ্বল্য এবং নিরলস উদ্যমের সাহায্যে আবদুল কালাম এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ তার মেধাকে আরো শানিত করতে পেরেছিলেন।নিজের দেখা স্বপ্নকে সত্যি করবার ক্ষমতা আব্দুল কালামের জীবনে অনন্য গতিশীলতার সঞ্চার করেছিলেন।
স্বপ্ন দেখার সাথে সাথে স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্পও রয়েছে আবদুল কালামের জীবনে।দেরাদুনে স্বপ্নের বিমান বাহিনীর পরীক্ষায় তার স্থান হয় নবম যেখানে পচিশ জনের মধ্যে প্রার্থী নেয়া হবে মাত্র আটজন।স্বপ্ন ভাঙার ব্যাথা থাকলেও নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে আবার ঘুরে দাড়িয়েছিলেন কালাম যোগ দিয়েছিলন সায়েন্টিফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে প্রতিরক্ষা দপ্তরে।সেখানেই তার সফলতার শুরু।একে একে নকশা করতে থাকেন সুপারসনিক টার্গেট বিমানের,হোভারক্রাফট,এয়ারক্রাফট ,রকেটসহায়ক উড়ান ব্যাবস্থা (RATO) ,সাউন্ডিং রকেট সহ আরো অনেক কিছুর।কিন্ত স্বপ্ন ভাঙার গল্পের শেষ কি এখানেই হয়? বছরের পর বছর ধরে যে প্রকল্পে আবদুল কালাম কাজ করেছেন,যেখানে কাজ করতে করতে বেশিরভাগ দিন ই চোখ তুলে দেখেছেন যে ল্যাবরেটরি খালি হয়ে গেছে অথবা কাজে ডুবে থাকার ফলে কখন যে লাঞ্চের সময় চলে গেছে টেরই পান নি, সেই ভারতের প্রথম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ যান (SLV) এর প্রথম উড়ান এর দিন ১৯৭১ এর ১০ ই আগস্ট ৩১৭মিনিটের মাথায় উড়ান বাতিল হয়ে যায় আর সেটি আছড়ে পড়ে সমুদ্রে।স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় তাড়িত হলেও পূর্নউদ্যামে কাজ শুরু করে।তিনি জানতেন বিজ্ঞান চর্চায় যেমন আছে আনন্দ তেমনি আছে দুঃখ ,কষ্ট এবং আশাভঙ্গের বেদনা।
ভবিষ্যৎ সৃষ্টির আশায় নতুন করে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ শেষ করেন এস এল ভি ৩ এর।উৎক্ষেপণের আগের দিন খবরের কাগজে নানান ব্যাঙ্গ,আগের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়া খবর আর আবার ত্রুটি দেখা দিলে এর ভয়াবহ পরিনাম, এসব খবরের উপর তেমন কর্নপাত করলেন না তিনি।তাইতো ১৯৮০ সালের ৮ই জুলাই আবার ভারতের প্রথম উৎক্ষেপণ যান ভূমি ত্যাগ করল।কিছুক্ষনের মধ্যেই এ পি জে আবদুল কালাম তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন শব্দগুলো উচ্চারন করে জানিয়ে দিলেন তারা সফল হয়েছেন।একটি সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আর ভারত হয়ে গেলো সেই স্বল্প সখ্যক জাতির অন্তর্ভুক্ত যারা উপগ্রহ উৎক্ষেপণ ক্ষমতার অধিকারী।এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়া।একে একে ব্যালস্টিক মিসাইল এবং মহাকাশযানবাহী রকেট উন্নয়নের জন্যে তাকে উপাধি দেয়া হয় ভারতের ক্ষেপনাস্ত্রমানব।ভারতরত্ন,পদ্মভূষণ,পদ্মবিভূষণ,ইত্যাদি পুরস্কার এর পাশাপাশি তিনি হয়েছিলেন ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের একাদশ রাষ্ট্রপতি।
যেখানেই থাকে স্বপ্নজয়ের উল্লাস সেখানেই থাকে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা।স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করবার পথটা মসৃণ নয়।এই পথে আসবে বাধা বিঘ্ন।সেই বাধা বিঘ্নকে অতিক্রম করেই দুর্বার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হবে।স্বপ্ন দেখতে হবে আকাশ জয়ের ।থেমে গেলে চলবে না।আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আবার দুরন্ত গতিতে ছুটে যেতে হবে অজয়কে জয় করবার আশায় যেমনটা ছুটে গিয়েছিলেন এ পি জে আবদুল কালাম।সফলতা আর ব্যার্থতা পাশাপাশি বিদ্যমান। কঠিন সময়ে সমস্যার কাছে পরাজিত হলে চলবেনা। পরিশ্রম এবং সফলতা দিয়ে সেই কঠিন সময়কে জয় করে তবেই সফলতার দ্বারপ্রান্তে পদার্পন করা সম্ভব।
লেখকঃ কামরান আহমেন ইশান
আরও পড়তে পারো