রুপকথার গল্পে অনেক রাজকন্যা থাকে অনেক অসম্ভব ঘটনা থাকে।আমরা তাই রুপকথার গল্প শুনতে ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের মাঝেও কখনো কখনো সত্যিকারের রুপকথার রাজকন্যারা হাজির হয়। হয়তো কেউ টের পায় আবার কেউ পায় না। কিন্তু যে রাজকন্যার দ্যুতি এতোই বেশি যে মেঘ যেমন সুর্যকে আড়াল করে রাখতে পারেনা তেমনি সেই রাজকন্যার দ্যুতিও কেউ আড়াল করে রাখতে পারেনি। উদ্ভাসিত হয়েছে পুর্ন চন্দ্রের মত। আমাদের এই রূপকথার গল্পের সত্যিকারের রাজকন্যা সুবাহ সাফায়েত সিজদা। বাবা মির্জা সাফায়েত জাহান পলাশ, আর মা নাফিসা আকতার। সিজদার জন্ম ২০১৩ সালের ১৫ই জুন।
যারা প্রতিদিন পৃথিবীতে কি ঘটছে না ঘটছে তা নিয়ে কিছুটা খোঁজ রাখেন তাদের অনেকেই সিজদার নামটি শুনেই ওকে চিনে ফেলার কথা। রাত দুপুরে রঙীন ডানা মেলে আকাশ থেকে নেমে আশা রাজকন্যাদের মতই সেও সবার মনের মধ্যে উড়ে এসে বসেছে। মিষ্টি করে কথা বলেছে যা শুনে সবাই মুগ্ধ।
সিজদার গল্পটা কেমন?
গল্পটা বেশ অন্যরকম। পৃথিবীতে যখন করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে ধারণ করছে। ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে এবং কোটি কোটি মানুষ গৃহবন্দী ঠিক সেরকম একটি সময়ে আমাদের এই রুপকথার রাজকন্যাটিও গৃহবন্দী। বাবার পাশে বসে টিভিতে চোখ বড় বড় করে দেখছে পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে তার খুটিনাটি। সাধারণত ছোটরা টিভি দেখার সময় নতুন কিছু দেখলে বাবাকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করে আর বাবা তার উত্তর দেন।কিন্তু এখানে ঘটছে তার উল্টো। বরং ছোট্ট মেয়েটিকে বাবা প্রশ্ন করছেন নানা বিষয়ে আর মেয়েটি মানে আমাদের ছোট্ট রাজকন্যাটি তা খুব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে উত্তর দিচ্ছেন। ভয়েজ চেঞ্জিং সফটওয়্যার দিয়ে ওর কন্ঠস্বরটা যদি পরিবর্তন করে দেওয়া হতো আর যদি ভিডিওতে ওকে দেখা না যেত তবে কেউ কল্পনাও করতে পারতো না যে এই সব কথা গুলো বলছে সাড়ে ছয় বছরের এক রাজকন্যা যার নাম সিজদা। ওর কথা শুনে ক্ষুদে অভিনয় শিল্পী দৃতি বললো “এতো দেখছি ছোট মানুষের শরীরে একজন সত্যিকারের প্রফেসর লুকিয়ে আছে!”
দৃতি বোধহয় কথাটা খুব একটা ভুল বলেনি। সমসাময়িক নানা বিষয়ে তার যে চিন্তা ভাবনা এবং তথ্যের ভান্ডার জমা আছে ছোট্ট মাথায় তা সত্যিই বিস্ময়কর। ছোট্ট একটি দেশ আমাদের। অগনিত শিশু কিশোর আমাদের চারদিকে। বয়সে ওর চেয়ে ঢের বেশি এমন অনেকের কাছে বেসিক বিষয়ে প্রশ্ন করলেও তার উত্তর তারা দিতে পারেনা সেখানে সিজদা পরিসংখ্যন দিয়ে দিচ্ছে। করোনা ভাইরাসে কবে কত জন আক্রান্ত হলো কতজন মারা গেলো কেন মারা গেলো কোন কিছুই বাদ যাচ্ছেনা।
কি বলছে সিজদা?
বাবা তাকে যে প্রশ্নই করুক না কেন তার কাছে খুব সুন্দর গোছানো উত্তর অবশ্যই আছে এবং সেই সব প্রশ্নই যুক্তিযুক্ত এবং সমাজ পরিবর্তনের দিক নির্দেশনা সম্বলিত। করোনা ভাইরাস কেন ছড়িয়ে পড়ছে? এ থেকে পরিত্রানের উপায় কি? আমাদের করনীয় কি? কে কোথায় আইন অমান্য করছে সব সব সে বলছে। এমনকি কিছুদিন আগে উল্টো পথে রিকশা চালিয়ে আসার কারণে সেই রিকশাকে বাঁচাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি উল্টে গিয়ে নিহত হওয়ার ঘটনাটাও তার চোখ এড়ায়নি এবং সে বলেছে রিকশাওয়ালা যদি নিয়ম মেনে চলতো আর উল্টো পথে না আসতো তবে এই দুর্ঘটনা ঘটতো না ফলে অনেক গুলো জীবন বেঁচে যেতো। আমরা মনে করি অভিনেতারাও ওর মত সুন্দর করে কথা গুলো বলতো না। সিজদা বলছে বড় বড় দেশগুলো যেহেতু এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ তো একটু আক্রান্ত হবেই। তবে বাকি সব দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো। কেন ভালো?কতটুকু ভালো? সে বিষয়েও বলতে পিছপা হয়নি।
কোন ক্লাসে পড়ে সিজদা?
প্রথম শ্রেণী এখনো শেষ করেনি। আগামী বছর সব ঠিক থাকলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠবে। তবে অনেকের মতে সিজদার যে মেধা ও পরিপক্ক্বতা তাতে তাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর বদলে চতুর্থ শ্রেনীতে দিলেও অসুবিধা নেই। সিজদা এটা শুনে নিশ্চই বলবে বাহরে আমাকে একবারে চতুর্থ শ্রেণীতে উঠিয়ে দিলে বাকি দুই ক্লাসের পড়াগুলোতো আমার অজানাই থেকে যাবে। আমি তা হতে দেবো না।
সিজদা সম্পর্কে সাধারণের মতামত কি?
এক বাক্যে সবাই স্বীকার করছে উপস্থিত বুদ্ধি আর সমাজ সম্পর্কে ওর মত ধারনা বড়দেরও নেই। ও যেমন করে ভাবে যেমন করে কথা বলে যেমন করে সচেতনতা অবলম্বনের বিষয়ে বলে তা সত্যিই মুগ্ধকর।
সিজদার পথচলা শুরু কিভাবে?
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে হঠাৎই একদিন ফেসবুকে ভেসে আসে একটি ছোট্ট মেয়ের মিষ্টি কন্ঠস্বর। বাবার সাথে তার কথা হচ্ছে। সে ঘুরে বেড়াচ্ছে খেলছে আর কথা বলছে।অনেকেই ভিডিও না দেখে স্কিপ করে গেছে কিন্তু অনেকে ভিডিও দেখেছে। আর যারাই দেখেছে তারাই ছোট্ট রাজকন্যার প্রতি মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছে। আর এভাবেই একের পর এক মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়েছে ওর ভিডিও গুলো। প্রতিনিয়ত ভিউয়ার বাড়ছে। বাবার আইডি থেকে শেয়ার হওয়ায় বাবার আইডিতে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। প্রতিনিয়ত মানুষ জানতে চাইছে সিজদা নতুন ভিডিও কবে দিবে। কবে আবার কথা বলবে? শুরুর দিকে সিজদার বাবার আইডিতে ফলোয়ার ছিলো তিন হাজার মত। সপ্তাহের ব্যবধানে সেটি ত্রিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। সবাই সিজদার মুগ্ধ দর্শক ও শ্রোতা।
কোথায় থাকে সিজদা?
আমরা যদি বলি সিজদা তুমি কোথায় থাকো? সে অনায়াসে বলতে পারবে তোমাদের মনের মধ্যে থাকি,হৃদয়ের মধ্যে থাকি। সিজদাতো আসলে এখন সেরকমই হয়ে গেছে। ভালোবেসে সবাই ওকে বুকের মধ্যেই রেখেছে। তবে সিজদা এমন করে বলেনি। সে বলেছে সে থাকে রাজধানী ঢাকার ইন্দিরা রোডে।
লকডাউনে কিভাবে ওর সময় কাটে?
পৃথিবীটাই থমকে গেছে। বাংলাদেশও তার মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থায় অধিকাংশ শিশুই ঘর থেকে বের হতে পারছে না। সিজদা ঘরে বসে বসে টিভি দেখে, বই পড়ে, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে, খেলাধুলা আর নাটক দেখে বাসায় সে সময় কাটাচ্ছে।
যে কথাটি নীতিনির্ধারকদের ভাবার কথা সেটি ভাবছে সিজদা
আমরা দেখতে পাচ্ছি চারদিকে নকলে ছয়লাব হয়ে গেছে। জীবনের নিরাপত্তার জন্য যে সব সামগ্রি সেসবও নকল হচ্ছে। আর যারা আমাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত সেই সব মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে নকল দ্রব্যাদি দিয়ে। সিজদা খুব আক্ষেপ করে বলেছে নকল মাস্ক, নকল গ্লাভস যে দেয়া হচ্ছে, সেটি ঠিক না। কারণ এটি যাদের কাছে যাচ্ছে, তারা এখন আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রোগীদের সরাসরি চিকিৎসা দিচ্ছেন ডাক্তাররা। তাদের কাছে নকল জিনিস আসল বলে বিক্রি করা হলে, তারা বিপদে পড়ে যাবেন।
বড়দের জন্য শিক্ষা
রুপকথার রাজ্য থেকে উড়ে আসা ছোট্ট রাজকন্যাটি আমাদের শিখিয়েছে কেন করে সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে ভাবতে হয় কেমন করে সচেতন হতে হয়,কেমন করে বিপদে অন্যের পাশে থাকতে হয়। কিন্তু আমরা কি ওর মত করে ভাবতে পারি? কখনো চেষ্টা করেছি? যদি সিজদার মত ভাবতে পারতাম,চিন্তা করতাম এগিয়ে আসতাম তবে সমাজটা আরো সুন্দর হতো। আমরা যেমন সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখি সেটি নির্মান করা তখন খুব সহজ হতো। সিজদার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।
লেখকঃ জাজাফী (লেখকের ফেসবুক আইডি)
আরও পড়ুনঃ
Comments are closed.