-জিনাত শারমিন
ধরে নেওয়া যাক, তার নাম লিপি। খুব ছোটবেলায় তার বাবা মারা যায়। তখন থেকে লিপিদের বাসায় থাকত তার ছোট চাচা। তিনি লিপিকে নিয়মিত পর্নো ভিডিও দেখাতেন। লিপিকে দিয়ে নিজের যৌনাঙ্গ স্পর্শ করাত। কোনো দিন মাকে এ কথা বলতে পারেননি লিপি । লিপি এখন সব যৌন সম্পর্ককে ঘৃণা করেন। সিনেমায় যৌনদৃশ্য এলেও লিপি উঠে চলে যান। সেখান থেকে জীবনে আর বিয়েই না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন লিপি।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিকতম সমীক্ষা বলছে, ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশু ও তার বাবা–মা যৌন নির্যাতককে চেনে। নিজের ঘরেই শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। নিজের ঘর বা আত্মীয়রাই যদি শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারে, সে ক্ষেত্রে অভিভাবকের কী করণীয়? এ প্রশ্নের উত্তরে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের নির্বাহী পরিচালক রোকসানা সুলতানা বলেন, ‘আমরা ১৯৯৪ সাল থেকে একটা কথাই বলে আসছি, শিশু ও শিশুর অভিভাবকদের নীরবতার বলয় ভাঙতে হবে। ঘরে থাকা কোনো আত্মীয়, ভাই, দেবর—যে কেউ হতে পারে শিশুর যৌন নির্যাতক। ডাইনিং টেবিলে সবাই যখন একসঙ্গে খায়, তখন বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলাপ হতে পারে। তাতে সম্ভাব্য যৌন নির্যাতক সতর্ক হয়ে যাবে। এ রকম কিছু করার সাহস পাবে না। একটা শিশুও সব মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে জন্মায়। তাই শিশুকে কেবল স্নেহ নয়, সম্মানও করতে হবে। “চাইল্ড এমপাওয়ারমেন্টের” (শিশুর ক্ষমতায়ন) ওপর জোর দিতে হবে।’
এই উন্নয়নকর্মী আরও জানান, শিশুকে যেভাবে বোঝানো হয়, শিশু সেভাবেই বোঝে। সাধারণত, যৌন নির্যাতক শিশুকে বিষয়টিকে ‘খেলা’ হিসেবে উপস্থাপন করে। তাই শৈশবে শিশুর এমন স্পর্শ ভালোও লাগতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিশুকে ‘উইন্ডো মেথড’ পদ্ধতিতে একটা একটা করে ঘরের জানালা খোলার মতো করে একটু একটু করে তার যৌনাঙ্গ, সম্ভাব্য যৌন হয়রানি নিয়ে জানাতে হবে। শিশুর সঙ্গে যদি এমন কিছু ঘটে, সে যেন সঙ্গে সঙ্গে নির্ভরযোগ্য কেউ যেমন বাবা, মা, স্কুলের শিক্ষকদের জানায়। যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে পরিবারকে মুখ খুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভিকটিমের কোনো দায় নেই। সব লজ্জা, অপমান কেবল নির্যাতনকারীর।
অনেকেই বলেন, বলিউড তারকা আলিয়া ভাটের সেরা সিনেমা ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, ইমতিয়াজ আলী পরিচালিত হাইওয়ে। এই সিনেমায় আলিয়া ভাটের চরিত্রের নাম ভিরা ত্রিপাঠি। ছোটবেলায় তার চাচার মাধ্যমে যৌন নির্যাতনের শিকার হয় এই ভিরা। পরে অপহরণের শিকার হয়ে ফিরে এসে সে তার পরিবারের সামনে সেই চাচাকে চিৎকার করে তার কর্মকাণ্ডের কথা জানায়। ছোটবেলা থেকে বয়ে বেড়ানো ট্রমা থেকে মুক্ত হয়। এই সিনেমা মুক্তির পর ভারতের বহু নারী ও পুরুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের ছোটবেলায় আত্মীয়–পরিচিতদের মাধ্যমে হওয়া যৌন হয়রানির কথা প্রকাশ্যে আনেন। হুমায়ূন আহমেদের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস নন্দিত নরকের একটি চরিত্র রাবেয়া। নিম্নবিত্ত পরিবারের বড় মেয়ে রাবেয়া বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। সে বাসার ‘লজিং মাস্টার’, তার বাবার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধুর মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার হয়। গর্ভপাত করাতে গিয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায়। এ তো গেল উপন্যাসের কথা। সমীক্ষা জানাচ্ছে, বিশেষ শিশুদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। আর একবার যিনি ছোটবেলায় যৌন হয়রানির শিকার হন, বারবার তার সঙ্গে এ ঘটনা ঘটতেই থাকে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান, হয়রানির শিকার শিশুরা পরবর্তী জীবনে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগেন। কেউ কেউ যৌন নিপীড়কও হয়ে ওঠে।
কেবল মেয়েশিশুই যে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, তা–ই নয়; আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে পুরুষ শিশুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা। আবার যৌন নির্যাতক মানেই যে পুরুষ, তা–ও নয়; নারীও হতে পারেন যৌন নির্যাতক। এমন একাধিক রেকর্ড আছে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের কাছে। নিজের একটা অভিজ্ঞতা ভাগ করলেন পেশাদার কাউন্সিলর ফারজানা রশিদ চৌধুরী। তাঁর বয়ানেই শুনতে পাই:
‘ছোট ছেলেকে নিয়ে আমার কাছে একদিন একজন মা এলেন। সিঙ্গেল মাদার। সে নাকি স্কুলে যেতে চায় না। পড়াশোনায় কোনো মন নেই। বন্ধুদের সঙ্গেও কথা বলে না। কিন্তু আগে খুব অ্যাটেন্টিভ ছিল। সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। বাচ্চার সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাইলাম। মা একটু অসন্তুষ্ট হলেন। এ কথা, সে কথার পর বাচ্চা জানাল, মা অফিসে চলে গেলে মামা তাকে নানাভাবে যৌন নির্যাতন করে। এ কথা জানানোমাত্র রেগে গেলেন মা। ছেলেকে নিয়ে উঠে চলে গেলেন। আর কখনো আমার চেম্বারে আসবেন না, এও বলে গেলেন। কিছুদিন পর ছেলেকে নিয়ে আবার এলেন ওই মা। সন্দেহ হওয়ায় ভাইকে না জানিয়ে বাসায় সিসি ক্যামেরা বসিয়েছিলেন তিনি। নিজে চোখে দেখেছেন ভাইয়ের কাণ্ড। আমি ফ্যামিলি কাউন্সেলিং করাই। মা তাঁর ভাইকে বাসা থেকে বের করে দেন। ধীরে ধীরে কাউন্সেলিং সেবা নিয়ে ছেলেটি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছিল।’
অভিভাবক ও পরিবারের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে কীভাবে শিশুকে নিরাপদ রাখা যায়। এরপরও যদি যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটে, তাহলে সবার আগে নীরবতা ভাঙুন। নির্যাতককে বাড়ি থেকে বের করুন। শিশুকে সাহস দিন। জানান যে আপনি তার পাশে আছেন। আইনি সহায়তা নিতে ৯৯৯–এ ফোন করতে পারেন। স্থানীয় পুলিশকেও জানাতে পারেন। শিশুকে প্রয়োজনে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করান। কমিউনিটি ক্লিনিকেও নিতে পারেন। শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পেশাদার কাউন্সেলিং। প্রাথমিক সবকিছু সেরে শিশুকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারেন। যাতে সহজেই সে ট্রমা থেকে বের হয়ে আবার ফেলে আসা জীবনে ফিরতে পারে।