তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে ঘরে বসে দেখা পুরো পৃথিবী।এছাড়া জানার জন্য এবং বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রযুক্তির জুড়ি নেই। প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে নেমে আসতে পারে নানা বিপত্তি। খুব সহজে আপনার সন্তান জড়িয়ে পড়তে পারে বিভিন্ন নেশা জাতীয় জিনিসে।এছাড়া ঘর থেকে বের হওয়ার পরে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে মিশছে, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাচ্ছে। সব বিষয়গুলো আপনাকে যত্নসহকারে দেখতে হবে।
বর্তমানে বেশিরভাগ অভিভাবক দুজনই চাকরীজীবী হওয়ায় সন্তানের যত্ন নেয়া তাদের পক্ষে কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সন্তানকে নিরাপদে রাখতে খোঁজ আপনাকে নিতেই হবে।কারণ আপনার অসাবধনাতার কারণেই আপনার সন্তান মাদকাসক্ত হয়ে পড়তে পারে। যার কারণে আপনার পরিবারে নেমে আসতে পারে ভয়াবহ পরিণতি।
যেভাবে বুঝবেন সন্তান মাদকাসক্ত-
* সামান্য ব্যাপারেই রাগ করা, বিরক্ত হতে থাকা
* মিথ্যা কথা বলা, অতিরিক্ত সতর্ক থাকা
* একা একা থাকা, অধিক রাত জেগে থাকা
* কথা দিয়ে কথা না রাখা, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া বিচার-বিবেচনা বিচক্ষণতা ক্ষমতা কমে যাওয়া
* মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করা বা না বলে তা বিক্রি করে দেয়া
* প্রতিদিন নির্দিষ্ট বা অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকা
* অদ্ভুত অদ্ভুত ধরনের বন্ধু-বান্ধবের আনাগোনা বেড়ে যাওয়া
* পোশাক-পরিচ্ছদের রুচির বড় রকমের পরিবর্তন হওয়া
* আসক্ত বন্ধুদের বা অসম লিঙ্গ ও বয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা করা বা বন্ধুত্ব করা
* পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়া, স্কুল/ কলেজ পালানোর অভ্যাস হওয়া
* রিডিং রোমের দরজা লাগিয়ে বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে পড়ার কথা বলে আড্ডাবাজি করা
* নিজেকে আড়ালে রাখা বা হঠাৎ অতিরিক্ত আধুনিকভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা
* স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাওয়া, চেহারা সুরতও নষ্ট হয়ে যাওয়া, অপরিচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া
* প্রতিদিনই বিভিন্ন বায়নায় হাত খরচ বেড়ে যাওয়া
* ক্ষুধা নষ্ট হয়ে যাওয়া বা একটা বিশেষ খাবার (মাংস, চানাচুর, কোল ড্রিংক) অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া।
* ধর্মীয় আচার আচরণ বা সোশ্যাল নর্মসকে অবজ্ঞা করা বা ইত্যাদি বিষয়ে অদ্ভুত যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করা বা ঠাট্টা তামাশা করা।
তবে সন্তানের যে কোন মাদকাসক্তি সাধারণত ধুমপান দিয়ে শুরু হয়, তাই মা-বাবা কেউ ধুমপায়ী হলে অবশ্যই নিজে আগে ধুমপান ত্যাগ করবেন আর তা না পারলে অবশ্যই নিজ বাসাবাড়িতে সন্তানের সামনে ধুমপান করবেন না।
পরিবারের মাদকাসক্ত লুকানো বা লজ্জার বিষয় নয়, হত্যা, আত্মহত্যা, গুপ্তহত্যা, ইত্যাদি যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা, দুর্ঘটনা এড়াতে জরুরি ভিত্তিতে ব্রেইন, মানসিক ও ড্রাগ এডিকশন স্পেশালিস্ট চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন। চিকিৎসায় ড্রাগ এডিকশন বা মাদকাসক্তি সম্পূর্ণ নিরাময় হয়।
মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে আগে জানতে হবে মাদকাসক্তি কী? নেশায় জড়িয়ে পড়া বা মাদকাসক্তি একটি ব্যাধি। সাধারণত চিকিৎসাবিদ্যায় মাদকাসক্তিকে বলা হয়, ক্রনিক রিলাক্সিং ব্রেইন ডিজিজ বা বারবার হতে পারে এমন স্নায়ুবিক রোগ।
মাদকাসক্তি প্রতিরোধে সবার আগে মাদকের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার রোধ করতে হবে। এরপর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তিকে মাদক থেকে দূরে রাখতে পরিবারের ভূমিকাই মূখ্য। কারণ, পরিবারই একটি শিশুর প্রথম প্রতিষ্ঠান, এরপর আসে সমাজ ও রাষ্ট্র।
১. পরিবারের প্রতি প্রথম পরামর্শ, আপনার সন্তানকে বুঝতে শিখুন। অহেতুক সন্তানদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করবেন না। সন্তানের ভালো লাগা, মন্দ লাগাকে গুরুত্ব দিন।
২. সন্তানের সাথে কোয়ালিটি টাইম কাটান। এমনভাবে সন্তানকে সময় দিবেন যেন সে সেটি উপভোগ করে, ভালোবাসে ও বারবার আপনার সাথে সময় কাটানোর জন্য অপেক্ষায় থাকে।
৩. সন্তানের পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথেও সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
৪. একসাথে ঘরে তৈরি খাবার খান, খেলুন ও বাইরে ঘুরতে যান। এভাবে সময় কাটালে শিশু-কিশোরদের সাথে আপনাদের সম্পর্কও ভালো হবে এবং সে আড়ালে গিয়ে নেশা করবে না বা সারা দিন ইন্টারনেটে সময় কাটাবে না। এখন কিন্তু ইন্টারনেটও আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে।
৫. দাম্পত্য কলহ থাকলে সেটিকে এড়িয়ে চলুন। অন্তত শিশুর সামনে এ কলহ প্রকাশ করবেন না।
৬. সন্তানকে অহেতুক সন্দেহ করবেন না। সন্দেহ হলে খোলাখুলি আলাপ করুন। সন্তানকে কটাক্ষ করবেন না বা অন্য কারও সাথে তুলনা করবেন না। অনেক মা-বাবা সন্তানকে তার সহপাঠী বা প্রতিবেশীদের সাথে তুলনা করে কটাক্ষ করে, যা শিশুর জন্য কষ্টদায়ক এবং মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
৭. শিশুর বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করুন। সম্ভব হলে সন্তানের সাথে মাদকের অপব্যবহার ও ক্ষতি নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করুন। কারণ, এখন ইন্টারনেটের সুবাদে ১২-১৩ বয়সীরা মাদক সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে। কিন্তু মাদকের বিষয়ে তার আগেই ধারণা থাকলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।
৮. সন্তানের ওপর গোপনে নজরদারি করবেন না। ছেলে বা মেয়ে বড় হলে তার মধ্যে সেলফ আইডেন্টিটি তৈরি হয় এবং সে কিছু ক্ষেত্রে প্রাইভেসি প্রত্যাশা করে। সন্তানকে অযথা দোষারোপ না করে যুক্তি দিয়ে বুঝাতে হবে। শৈশব থেকেই নৈতিক শিক্ষা দিন, ভালো-মন্দ বিষয়ে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিন।
৯. আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বন্ধু। কিশোর বয়সে বাবা-মায়ের চেয়েও বন্ধুদের কথা বা পরামর্শ বেশি আকর্ষণীয় হয়। এজন্য সন্তান কাদের সাথে বন্ধুত্ব করছে, সময় কাটাচ্ছে তা নিয়ে তার সাথে খোলাখুলি আলাপ করুন এবং বন্ধু নির্বাচনে পরামর্শ দিন।
১০. ছেলেমেয়েরা বাইরে আড্ডা, হোটেলে-রেস্টুরেন্টে কিছু খেতে চাইতে পারে, তাতে বাধা না দিয়ে বরং পরিবারে এসব আয়োজন করার চেষ্টা করুন। যেমন, বাসায় বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার একসাথে বসে খাওয়া, বিকেল বা সন্ধ্যায় সবাই একসাথে বসে গল্প-গুজব করা, ছুটির দিনে বাইরে ঘুরতে যাওয়া বা একসাথে বসে বিভিন্ন ইনডোর গেম খেলা।
১১. হাতখরচের টাকা এই বয়সে একটু লাগে কিন্তু সেটি পরিমিত পরিমাণে দেয়া উচিত। মাত্রাতিরিক্ত হাতখরচের টাকা পেলে সেটি অনেক সময় ছেলেমেয়েকে মাদকের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
১২. নিজে মাদকাসক্ত হয়ে সন্তানকে মাদক থেকে দূরে রাখার চিন্তা যৌক্তিক না। পরিবারে নৈতিকতার চর্চা বজায় রাখুন। পরিবার থেকে নৈতিকতার শিক্ষা পেলে সেটি সারা জীবন কাজে লাগবে। আর পরিবারে অনৈতিকতার চর্চা হলে সেই শিশু কখনোই নৈতিকতা শিখতে পারবে না এবং মাদকাসক্ত ছাড়াও নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়তে পারে।