বয়ঃসন্ধিকাল এমন একটা সময় যখন একজন শিশু কিশোর বা কিশোরীতে পরিনত হয়। সাধারনত ৯ থেকে ১৬ বছরকালকে বয়ঃসন্ধিকাল বলা হয়। সময়কাল ৯ থেকে ১২ বছর এটাকে বয়ঃসন্ধিকালীন প্রাথমিক পর্যায় এবং পরবর্তী সময়কালকে দ্বিতীয় পর্যায় বলা হয়।
তবে বয়ঃসন্ধিকালীন প্রাথমিক কালকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ও বলা হয়ে থাকে। এই সময়ে শুধু শারিরিক নয়; মানসিক বিরাট পরিবর্তন ঘটে । এই সময়ের পরিবর্তনের সাথে ঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারলেই একটি শিশু তার জীবনের পরবর্তী ধাপের জটিলতা থেকে নিজেকে সচেতনভাবে বাঁচিয়ে নেয়া শিখে যায়। এই সময় একজন শিশুর সবচাইতে বেশী প্রয়োজন তার বাবা মায়ের স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা; মূলত তাদের সহযোগিতায় শিশুটি বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যাগুলি সুন্দরভাবে কাটিয়ে উঠতে পারে।
সাধারনত এই সময়ে একজন কিশোর বা কিশোরীর যে সব শারীরিক পরিবর্তন হয় তা তার মানসিকতায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বুঝতে পারে তার শারীরিক পরিবর্তনের জন্য তার পোশাক পরিচ্ছদে পরিবর্তন আনতে হয়। তার অনেক কিছু করা থেকে বিরত থাকতে হয়। সামাজিক অনেক নিয়মকানুনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
সে চারপাশের লোকজনকে তার প্রতি অতি আগ্রহী হতে দেখবে। মেয়েদের সবচাইতে বড় যে পরিবর্তন প্রতি মাসে মাসিক বা ঋতু পরিবর্তন হতে শুরু করে। প্রথম প্রথম এটা বেশ কষ্টকর অনুভূতি মানিয়ে নেয়া। সবচাইতে জরুরী এই বয়সী কিশোরীকে পরিচ্ছন্নতা বিষয়টি শিক্ষা দেয়া। আমরা অনেকেই লজ্জাকর বা লুকিয়ে রাখার বিষয় ভেবে তাদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করি না। অথচ এই সময়ে বাবা মার তার সন্তানের সাথে বেশি থাকা উচিত। সব বিষয়ে খোলামেলা কথা বলা উচিত। আমি যখন এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলাম আমি ছিলাম ভয়ে তটস্থ এবং বিষয়টি নিয়ে কারো সাথে আলোচনার সুযোগ পাইনি। মা বুঝতে পেরেও এটা খুব লজ্জা এবং গোপন বিষয় বুঝিয়ে ছিলেন।বর্তমানে এমনটি কারো সাথে হোক তা কখনোই কাম্য নয়।
আমরা সন্তানের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলি তবে এই বিষয়টা যে ভীতিকর কিছু নয় তা বুঝানো দরকার পাশাপাশি মিনিস্ট্রুয়াল হাইজিন বিষয়টা রয়েছে। যেমন পরিচ্ছন্ন থাকা। নিয়মিত গোছল করা এবং ৬ ঘণ্টা পরপর প্যাড পরিবর্তন করা অনেকের ক্ষেত্রে আরও কম সময়ের মধ্যেই এটা করতে হয়। ব্যাবহার করা প্যাডটি কিভাবে কোথায় ফেলতে হবে তাও বলে দিতে হবে। এই সময় বেশী পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা উচিত।
এবার বলি মুখের স্কিনের কথা। অনেকেরই এই সময় মুখে ব্রণ দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে তাদের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনা জরুরী । তৈলাক্ত খাবার পরিহার এবং পরিচ্ছন্নতাই একমাত্র করনীয় কারন এটা বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমে যেতে থাকে। কিশোরদের মুখে হালকা গোঁফের রেখা দেখা দেয়। তাদের গলার স্বরের পরিবর্তন হয় যে বিষয়টা তাদের মানসিকতায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। অনেকেই বাইরের লোকজনের সামনে যেতে লজ্জাবোধ করে।
এই সময় নতুন পোশাকে নিজেকে তারা সাজাতে চায়। নিত্য নতুনত্ব আনতে চায় তার সাজ পোষাকে। নতুন জিনিষের স্বাদ নিতে চায়। অনেকের কিন্তু নেশা জাতীয় বিভিন্ন জিনিষের প্রতি এই সময়ে আকর্ষণ তৈরি হয় অনেকে বন্ধুদের সাথে টেস্টও করে ফেলে। তাই বাবা মাকে খুব সচেতন হতে হবে। পারিপার্শ্বিক ভাল মন্দের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আপনার সন্তান কেমন বন্ধুর সাথে মিশছে তার খেয়াল রাখতে হবে। এই বয়সী অনেকেই আবার সামাজিকতা বিষয়টা বেশী বুঝতে পারে না। অনেকেই বন্ধু বানাতে বার্থ হয়। তাই বাবা মা তার সমবয়সী বন্ধুদের বাসায় ডাকতে পারেন এতে তারা সমবয়সীদের সাথে মেশার সুযোগ পাবে। এই বয়সীরা কারো সুপারভিশন ছাড়া দীর্ঘ সময় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবে এটাও কিন্তু কাম্য নয়।
তাদের নিত্য নতুন হাল ফ্যাশন এবং গ্রুপ বা ব্যান্ডের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা তৈরি হয়। তাই খারাপ বাড়াবাড়ি কিছু হলে দরকার উপযুক্ত কাউন্সেলিং। আমার মেয়ের এবং তার সব বন্ধুদের কথাই যদি বলি ওরা সবাই কোরিয়ান ব্যান্ড বি টি এস এর ভক্ত। তাদের এই ভাষায় গান গাইতে চেষ্টা বা তাদের মত সাজার চেষ্টাও দেখেছি। আমি যদি সরাসরি বিরোধিতা করি তবে তারা মানবে না। তাই অন্যভাবে বুঝাতে হবে। তবে একটা দেশের মিউজিকের প্রতি অনুরক্ত হলে ক্ষতি কিন্তু নাই। সেখান থেকে ভাল বিষয়টা যাতে তারা নিতে পারে তা দেখতে হবে। প্রথমেই আমি নিজেও তাদের একজন গুণগ্রাহী বুঝাই তারপর এভাবে বলি না………… যেমন ব্যান্ড দলটি তার নিজের ভাষায় গান করছে অন্য ভাষায় নয়। তারা তাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরছে । আর পৃথিবীতে এমন নজির নাই যে অন্য ভাষায় কিছু করে কেউ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এরপর সঙ্গে সঙ্গেই পরিবর্তনটা দেখতে পেলাম। তারা তখন বলল ঠিক বলেছেন আনটি ;তাহলে আমরা আমাদের ভাষায় নতুন কিছু করতে পারি সম্পূর্ণ নতুন ঢঙ্গে ।
এই বয়সে আরেকটি বিষয় হলো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। তারা এই সময় অন্যদের কাছ থেকে আবেগঘন কথা শুনে বা টেক্সস্ট বা চিঠি পেয়ে থাকে ।
আমি আমার এক বান্ধবীকে বেশ হাসতে হাসতে ঘটনা বলতে শুনলাম যেমন তার ভাষ্য ……আমি আর আমার মেয়ে খুব সাচ্ছন্দে মিশি,কথা বলি তাই আমরা একে অপরের বন্ধুর মত। সে বলল আমার মেয়েকে তার স্কুলের উপরের ক্লাশের এক ছেলে বলেছে ‘ I like you very much’ জানিস আমার মেয়ে উত্তর দিয়েছে I like myself too. তাহলেই দেখেন পরিস্থিতিটি কি সুন্দর ভাবে সে সামাল দিয়েছে। বন্ধুর মত সন্তানের সাথে মিশেছে বলেই সন্তান যেমন অকপটে বলতে পেরেছে আবার আপনিও তখন বাড়তি দুইটি বিষয় বলতে পারেন। যেমন এখন শুধুই পড়াশুনার সময় তুমি যদি এই বিষয়ে সময় নষ্ট কর তবে তোমার সময়ই নষ্ট করবে আর কিছু কিন্তু নয়। এই বয়সের সম্পর্ক পরিণতি পায় না কারন তুমি জানো না তুমি আসলে কেমন চাও। এটা বুঝতে হলে আরও কিছুটা বড় হতে হবে।
এই বয়সীরা আয়োজন করে পরামর্শ বা বানী দিতে বসলে তা ভালভাবে নিবে না। বরং ঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করুন । তারপর তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী তাকে বুঝান।
কোন কারণ ছাড়াই মন খারাপ হয়ে যাওয়া বা অকারনে আপনার সাথে আপনার এই বয়সী সন্তান খারাপ আচরণ করতে পারে। তার উপর রেগে চড়াও না হয়ে অপেক্ষা করুন একটু অন্যভাবে বলুন দেখবেন ঠিক বুঝে যাবে।
শারীরিক পরিবর্তনের ফলে সে কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে এবং আত্মীয় স্বজনদের কেউ কেউ তাকে কিভাবে ব্যবহার করতে চাইতে পারে তা জানাতে হবে। প্রয়োজনে সেইফ এবং আনসেইফ স্পর্শ এবং তার স্পর্শকাতর অঙ্গটি চিনিয়ে দিতে হবে। তবেই সে বুঝবে কিভাবে চলতে হবে। একটা মজার কথা মনে পড়ে গেল একবার আমি আমার দুই কন্যাকে এই স্পর্শ বিষয়টা বুঝাচ্ছি আমার ৬ বছরের ছোট কন্যাটি বলল মা যদি কেউ এমন পচা আচরন করতে চায় আমি কি সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটা kick করবো ?
তাই সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কোন বিকল্প নাই। আমি যদি বন্ধুর মত মিশি তবেই সে আমাকে সব কথা বলবে। আমি তাকে ঠিক সময়ে গাইড করতে পারবো ।