লেখাঃ মোঃ আসাদুল্লাহ
দেশব্যাপী পালিত হলো শিশু অধিকার সপ্তাহ। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল :‘থাকবে শিশু সবার মাঝে ভালো, দেশ-সমাজ পরিবারে জ্বলবে আশার আলো’। প্রতিপাদ্যের মধেই নিহিত আছে শিশুর সার্বজনীন অধিকার, শিশু জাতি গঠনের ভিত্তি, আগামীদিনের কর্ণধার। বাংলাদেশের সংবিধানে শিশুসহ সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হলেও বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা, নাগরিক অসচেতনতা, অশিক্ষা, দারিদ্র্য, বৈষম্য, বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অনুপস্থিতিসহ নানাবিধ কারণে শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠা সময়সাপেক্ষ ও চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানাবিধ সনদ, কনভেনশন, নীতি ও আইন থাকার পরও শিশুর অধিকার বাস্তবায়ন আশানুরূপ হয়নি। শিশুদের মানবাধিকার এবং সকল শিশুর জন্য সে সব অধিকার অর্জন করতে হলে সব দেশের সরকারকে যে নিরিখগুলো অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে সেগুলো বিবৃত হয়েছে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে। সনদে বর্ণিত প্রতিটি অধিকার প্রত্যেক শিশুর মানবিক মর্যাদা ও সুষম বিকাশের জন্য অপরিহার্য।
শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেক শিশুর জন্য সংরক্ষণযোগ্য মানবাধিকারগুলোর রূপরেখা তুলে ধরে সনদে বর্ণিত দিকনির্দেশনামূলক নীতিমালার আলোকে সেগুলো বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের নিমিত্ত বিদ্যমান ১৯৭৪ সালের শিশু আইন রহিত করে প্রণয়ন করা হয়েছে:শিশু আইন ২০১৩। নারী ও শিশু নির্যাতনমূলক অপরাধসমূহ কঠোরভাবে দমনে প্রণীত হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ, ১৯৭৯ ও শিশু অধিকার সনদ, ১৯৮৯ এর স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসাবে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত নারী ও শিশুর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ, পারিবারিক সহিংসতা হতে নারী ও শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সমপর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে প্রণীত হয়েছে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০।
গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ও তাদের কল্যাণের নিমিত্ত প্রণীত হয়েছে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা ২০১৫। নীতিমালা অনুযায়ী গৃহকর্ম শ্রম হিসেবে স্বীকৃত এবং গৃহকর্মীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাবেন। সর্বনিম্ন ১৪ বছরের কাউকে গৃহকর্মী নিয়োগ দেয়া যাবে। গৃহকর্মীদের শ্রমঘণ্টা বেতন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন গৃহকর্মীরা। নীতিমালায় গৃহকর্মীদের বিশ্রামের পাশাপাশি বিনোদনের সময় দেওয়ারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গৃহকর্মীদের নির্যাতন করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ সনদে প্রতিবন্ধী শিশুদেরকে অন্যান্য সকল শিশুর সাথে সমতার ভিত্তিতে মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার ভোগ করার বিষয়সহ শিশুদের স্বার্থ বিবেচনায় প্রতিবন্ধী শিশুদের স্বার্থ সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শিশু নির্যাতন বন্ধ, বিশেষ করে কন্যা শিশুদের প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য ও নির্যাতন বন্ধ ও তাদের নিরাপত্তা বিধান করা অন্যতম লক্ষ্য।
দেশে শিশু অধিকার বিষয়ক নানাবিধ আইন, শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও শিশু অধিকার রক্ষায় সরকারের অঙ্গীকার থাকার পরও বাংলাদেশে শিশুরা বিভিন্নভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। লঙ্ঘিত হচ্ছে শিশু অধিকার। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল, পারিবারিক-সামাজিক বিরোধে সৃষ্ট সামগ্রিক পরিস্থিতি শিশুদের বেড়ে ওঠা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ঘরে বাইরে বিভিন্নভাবে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শিশু নির্যাতনের ধরনও পরিবর্তিত হয়েছে। একটি শিশু যখন তার নিজের ঘরেই বাবা-মায়ের কোলে নিরাপত্তা পাচ্ছে না তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের সুরক্ষার জন্য নতুন করে ভাবা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের শিশু অধিকার পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তনে সরকার, উন্নয়ন সংস্থা, মানবাধিকার কর্মীসহ নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বিদ্যমান থাকার পরেও শিশুদের সার্বিক অধিকার নিশ্চিতকরণে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতে বিনামূল্যে বই প্রদানসহ শিক্ষা বিষয়ক অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিশুদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষার্থে জাতীয় সকল উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন, পরিকল্পনা গ্রহণ, কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় শিশু নীতিমালা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু শিশুরা যাদের আমরা আগামীদিনের ভবিষ্যত্ বলি তারা তাদের অধিকার কতটুকু ভোগ করতে পারছে? আগামীদিনের ভবিষ্যত্ শিশুদের উন্নয়নে সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা বা বাস্তবায়ন কৌশল কতটুকু স্পষ্ট? নানাবিধ আইন থাকার পরেও কেন শিশুরা শারীরিক নির্যাতন, ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না? এসব বিষয় গভীরভাবে ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
শিশুদের দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টি, স্বাস্থ্য সেবা, নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করাসহ হতদরিদ্র ও ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসন, পর্যায়ক্রমে শিশু শ্রম নিরসন, শিশুদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যবহার বন্ধ করা ও তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে শিক্ষা ও বিনোদনের উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন। মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রতিটি শিশুর অধিকারকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক শিশুর অধিকার সংরক্ষণের মাধ্যমে একটি কর্মক্ষম ভবিষ্যত্ প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্র প্রস্তুতের দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সমাজের রয়েছে। সেটা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
n লেখক : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
Comments are closed.