আফসোস করে বলতে হচ্ছে লৌহ নির্মিত পোশাকও আমাদের কন্যাশিশুটি নিরাপদ নয়,এ ক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কী?সেটাই ভেবে দেখার সময় এসেছে।কদিন আগেও আমরা দাদা দাদীর মুখে রুপকথার গল্পের দৈত্য দানো ডায়নি,শয়তানের গল্প শুনেছি।আমাদের জীবদ্দশায় সত্যি সত্যিই সেই সব নরপিশাচদের দেখতে পাবো তা কখনো কি কেউ কল্পনা করেছি?গল্পের ডায়নি,দৈত্যদানো সবই মিথ্যা কিন্তু সেই মিথ্যা চরিত্র গুলো এখন সমাজে জন্ম নিয়েছে যাদের হিংস্র থাবায় প্রতিনিয়ত আমরা হারাচ্ছি প্রিয়জনদের।তেমনই অগণিত ঘটনার মধ্য থেকে একটি ঘটনার কথা লিখতে বসেছি।দিল্লিতে মাত্র আটমাস বয়সী এক শিশুর কথা।
সবে মাত্র বাবা মায়ের হাতের আঙ্গুল ধরে হাটতে শিখছে আটমাস বয়সী কন্যা শিশুটি।ঠিক সেই মুহুর্তে তার জীবনে হায়েনাদের হিংস্র থাবা এসে সব এলোমেলো করে দিয়েছে।ধরণী দ্বিধা হও বলা লাগছেনা বরং ধরনী এমনিতেই দ্বিধা হয়ে আছে। এশিয়ার বৃহত্তম দেশ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত।বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ বলেও পরিচিত।তারা ক্রিকেটে যেমন এগিয়েছে তেমনি এগিয়েছে চলচ্চিত্রে।বলিউড থেকে শুরু করে দক্ষিণের সিনেমা এখন বিশ্বব্যাপী সমাদ্রিত।কিন্তু তারা কমাতে পারেনি শিশু কিশোর কিশোরী নিযার্তন। দিল্লির একটি হাসপাতালে এখন মৃত্যুর সাথে লড়ছে এক কন্যা শিশু যার বয়স মাত্র আট মাস।এক বছর দু বছর নয় মাত্র আটমাস বয়সী যে শিশুটি দিল্লির হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি আছে তার কী অপরাধ ছিল?এ সমাজ বলে নারীদের পোষাকের কারণে তারা ধর্ষণের শিকার হয় কিন্তু এই আটমাস বয়সী শিশুটিরওকি পোষাক নিয়ে কথা তোলার কোন সুযোগ আছে? হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউটিনের বাতাস ক্রমাগতভাবে ভারী হয়ে উঠছে শিশুটির নিদারুণ কান্নায় আর মানুষের হাহুতাশ আর ক্ষোভে।
যে ছোট্ট শিশুটির শরীরে বাবা মা পরিবার কখনো একটু আচড়ও পড়তে দেয়নি সেই ছোট্ট কোমল শরীরটাকে নিয়ে হিংস্র হায়েনারা যেটা করেছে তা কোন ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য আমাদের নেই।তিন ঘন্টার অধিক সময় ধরে অপারেশান করা হয়েছে বাচ্চাটিকে।এইতো কিছুদিন আগে পাকিস্তানের জয়নাব মানে সাত বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের পর নির্মম ভাবে হত্যা করেছে নরপিশাচেরা।সেটা নিয়ে সারা বিশ্বে অনেক আন্দোলন হয়েছে।আফসোস আমরা এমন একটি পৃথিবীতে আছি যেখানে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আমাদের শিশু কিশোর কিশোরীরা নিরাপদ আছে বলে ধরে নেওয়া যাবে।সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন “পৃথিবীটাকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে” তিনি আরও বলেছিলেন “এসেছে নতুন শিশু,তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান” কিন্তু আমরা এতোটাই হিংস্র হয়ে গেছি যে শিশুদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের পরিবর্তে আমরা হয়ে উঠছি ঘাতক,হিংস্র হায়েনা।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি বলে আমরা যখন জাতীয় সঙ্গীত গাই তখন আমাদের হৃদয়ে দেশের প্রতি ভালোবাসা উথলে ওঠে।কিন্তু সেই সোনার বাংলাকে আমরাই প্রতিনিয়ত নষ্ট করে ফেলছি।বিশ্বের অন্যান্য দেশের নরপিশাচদের মতই এদেশেও নরপিশাচের জন্ম হয়েছে।প্রতিনিয়ত বাড়ছে খুন ধর্ষণ,ইভটিজিং আর নানা উপায়ে যৌন হয়রানি। কদিন আগের ঘটনা এক ষাট বছর বয়সী ধর্ষণ করেছে পাঁচ বছর বয়সী এক কন্যা শিশুকে।ঘটনা ঢাকার কদমতলীতে।মেয়েটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে।আমরা জানিনা আমাদের প্রতিটি নিঃশ্বাস ফেলার অবসরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঠিক কতজন শিশু কিশোর কিশোরী নিযার্তনের শিকার হচ্ছে,ধর্ষিত হচ্ছে।এই আকাশ বাতাস সেই সব শিশু কিশোর কিশোরীর আর্তচিৎকারে প্রকম্পিত হচ্ছে কিন্তু আমরা মানুষ হয়ে তা উপলব্ধি করতে পারছিনা।আমরা সম্মিলিত ভাবেও পারছিনা শিশু কিশোর কিশোরীদের জন্য নিরাপদ আবাস গড়তে।
ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে দেশটিতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১ হাজার শিশু। শুধু দিল্লিতেই প্রতিদিন গড়ে তিনটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। শিশু ধর্ষণের পরিসংখ্যানে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। শিশু অধিকার ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার শিশুর সংখ্যা ৫৯৩ জন। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ৪৯টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু সনদে বর্ণিত ঘোষণা অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়সের কম সবাই শিশু। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু, যাদের সংখ্যা প্রায় সাত থেকে আট কোটি। এই শিশুদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই কন্যাশিশু। যৌন নিপীড়নের পরিপ্রেক্ষিত থেকে প্রায় চার কোটি কন্যাশিশুর নিরাপদ শৈশবের নিশ্চয়তা কতটা দেওয়া হচ্ছে বা দেওয়া সম্ভব? সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এ ধরনের নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যার সামান্যই পুলিশের নথিভুক্ত হয়। সেটি বিবেচনায় আনলে ধর্ষণ কিংবা এ জাতীয় নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যা প্রতিবেদনে প্রকাশিত সংখ্যার কয়েক গুণ হবে। শিশু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ক্রমবর্ধমান ধারা বাংলাদেশকে শিশুদের জন্য নিরাপত্তাহীন জনপদে পরিণত করে তুলেছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দুই লাখ মা-বোন নির্যাতিত হয়েছেন। রাষ্ট্র তাঁদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দিয়েছে। জানি না এই উপাধি সমাজের বুকে তাঁদের কতটা সম্মানিত করেছে। অনেকের কাছেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁদের অপূরণীয় আত্মত্যাগ আর অপরিসীম ধৈর্য গৌণ হয়ে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের নির্যাতিত হওয়ার বিষয়টি। এরপরও হয়তো এই বীরাঙ্গনার কিছুটা হলেও স্বস্তি খুঁজে ফেরেন এই ভেবে যে তাঁদের এই আত্মত্যাগ বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিচিতি দিতে সাহায্য করেছে আর বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। কিন্তু আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিটি মাসে যে প্রায় ৫০টি শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তারা কোথায় কোন স্বস্তি খুঁজে ফিরবে! পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের সময় লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল বাঙালি নারীকে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে। যেকোনো যুদ্ধে ধর্ষণ শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙে দেওয়ার অনন্য একটি কৌশল হিসেবে বিবেচিত হয় যুগে যুগে। কিন্তু আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশে এই যে শকুনের দল রোজ শিশু ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে, আমার বিবেচনায় তারা পাকিস্তানি সেনাদের চেয়েও বেশি ভয়াবহ, নির্মম ও নিষ্ঠুর।
শিশু ধর্ষণের সঙ্গে নারী ধর্ষণের বিষয়টি যোগ করলে সামগ্রিক যে চিত্রটি ফুটে ওঠে, তা আরও ভয়ংকর। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবমতে, ২০১৭ সালে সারা বাংলাদেশে ৮১৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৪৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় আর ১১ জন ধর্ষণের পর আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। ২০১৬ সালে এ ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৬৫৯টি। একদিকে ধর্ষণের মাত্রা যেমন বেড়েছে দ্রুতগতিতে, অন্যদিকে কচ্ছপগতিতে চলছে ধর্ষণের বিচারপ্রক্রিয়া। শিশু অধিকার ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মাত্র ৩২টি শিশু ধর্ষণ মামলার রায় প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো সংঘটিত হয়েছিল ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে কিংবা তারও আগে। প্রকৃত অপরাধীরা জামিনে ছাড়া পেয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর নতুন নতুন অপরাধের ছক কষছে।
ঘরে বাইরে,স্কুলে,বিশ্ববিদ্যালয়ে,কর্মস্থলে রাস্তায় কোথাও আজ আর নারীদের নিরাপত্তা নেই।শিশু কিশোর কিশোরীরা যৌন নিযার্তনের শিকার হচ্ছে নিজেদের ঘরে,নিকটাত্মীয়র কাছে,গৃহশিক্ষকের কাছে,স্কুলে,খেলার মাঠে।এভাবে চলতে থাকলে এ পৃথিবীটা বুঝি আর বেশি দিন টিকে থাকবে না।আমরা চাই শিশু কিশোর কিশোরীদের জন্য নিরাপদ একটি পৃথিবী গড়তে।পৃথিবী কোন মাটির কলসী নয় যে আমি একাই চাকা ঘুরিয়ে সোজা করে বানিয়ে ফেললাম।সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এ পৃথিবীটাকে শিশু কিশোর কিশোরীদের জন্য নিরাপদ করে গড়ে তুলতে।
আপনি সন্তানের অভিভাবক?চাই সে ছেলে সন্তান হোক বা মেয়ে সন্তান হোক।তাকে নিয়ে আপনার পরিকল্পনার বিষয়টি তুলে ধরুন।তাকে নিয়ে আপনার কি কি ভয় কাজ করছে এবং সেগুলো দূর করতে হলে সমাজে কি কি করা যেতে পারে তা সবার সাথে তুলে ধরুন।আসুন আমরা ছোটদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তুলি।আপনার ও আপনার শিশু কিশোর কিশোরী সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বদলে যান।এবং অন্যকে বদলে যাবার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করুন।যে কোন পরামর্শ লিখে পাঠান আমাদের কাছে [email protected] এই ইমেইলে।
আরও পড়ুনঃ
Comments are closed.