হিমু চন্দ্র শীল
বলা হয়ে থাকে আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত।আজকে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটি হাটি হাটি পা পা করে একসময় বেড়ে উঠবে।শৈশব,কৈশোর পেরিয়ে সে শিশুটি প্রবেশ করবে তারুণ্যে।শক্ত হাতে হাল ধরে পাল উড়াবে দেশের।সব বাধা বিপত্তি ঠেলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবে।এক সময় সে শিশুটির পরিপক্ক কাঁধে ভর করে মাথা তুলে দাঁড়াবে দেশ।কিন্তু আদৌ এটা কি সম্ভব!আমরা কি সে অনাগত কিংবা সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটির জন্য এখনো কি নিরাপদ একাট পরিবেশ তৈরি করতে পেরেছি।পেরেছি কি কোমল কলিগুলোকে নির্বিঘ্নে স্নিগ্ধ পুষ্প হয়ে ফুটতে দিতে।জানি,এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের কারো জানা নেই।
আমাদের সমাজ,আমাদের রাষ্ট্র ও বিশ্ব শিশুদের জন্য সেই সুন্দর পরিবশেটুকু গড়ে তুলতে পারেনি এখনো।পারেনি ছোট্ট ছোট্ট কোমল হৃদয়গুলোকে নিশ্চিন্তে নিরাপদে বিচরণ করার জায়গা করে দিতে।হয়তো কখনো এটা সম্ভব হবে কিনা জানিনা।আমরা আজ বড় ব্যর্থ।এখনো আমরা শিশুদের মনের মতো একটা সুন্দর বাসস্থান তৈরি করতে পারিনি।এই ব্যর্থতার দায় যতটা না পরিবার বা সমাজের উপর বর্তায় ততটা বর্তায় আমাদের রাষ্ট্র ও বিশ্বের উপর।বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ সংঘাত এখন নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের ঝনঝনানি আর হিংস্রতার মধ্যে বেঁচে থেকেও ধুকে ধুকে মরছে লাখো লাখো শিশু।রাতটা কোনোমতে পার করলেও ভোরটা শুরু করছে বোমার শব্দ শুনে।
কিংবা নিশ্চিন্তে রাত পার করে যে ভোরের নতুন সূর্য্য দেখবে,এতটুকু নিশ্চিয়তাও শিশুদের দিতে পারছেনা কতগুলো দেশ।সেই হিংস্রতার কবলে পড়ে প্রতিনিয়ত মারা পরছে লাখের অধিক শিশু।বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো শিশুদের নানাভাবে অপব্যবহার করছে।বৃহৎ স্বার্থের কথা ভুলে গিয়ে তাঁদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতাত্র করার জন্য শিশুদের বেছে নিয়েছে মাধ্যম হিসেবে।কোমল মনে ছড়িয়ে দিচ্ছে হিংস্রতার বিষ।মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ঠেলে দিচ্ছে অপরাধ জগতের দিকে।বিশ্বে শিশুরা কতটা ভয়াবহভাবে দিনাতিপাত করছে তা সাম্প্রতি সেভ দ্য চিলড্রেনের সহযোগিতা ও অর্থায়নে নরওয়ে ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিচ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অসলো এর এক গবেষণায় উঠে এসেছে। ‘স্টপ ওয়ার অন চিলড্রেন:প্রটেক্টিং ইন টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি কনফ্লিক্ট’ নামের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বিশ্বে প্রতিবছর ১ লাখ শিশু যুদ্ধের কারণে মারা যাচ্ছে।
বিশ্বের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বা এক পঞ্চমাংশ শিশু বিভিন্ন দেশের দ্বন্দ্ব নিয়ে সৃষ্ট যুদ্ধ ও সংঘাতের মধ্যে জীবনযাপন করছে।অর্থাৎ প্রতি পাঁচটির শিশুর একটিই মৃত্যুহুমকির মধ্যে জীবন কাটচ্ছে।ওই গবেষণা প্রতিবেদন আরো বলা হয়েছে,বিশ্বে সংঘাতের শিকার সবচেয়ে বেশি শিশু বসবাস করছে ভারত,পাকিস্তান,নাইজেরিয়া,মিসরে।বাদ যায়নি আমাদের বাংলাদেশও। ওই প্রতিবেদনে আরো উঠে এসেছে বিশ্বের সবচেয়ে সংঘাত কবলিত দেশগুলোর তালিকা।সংঘাত কবলিত শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে আছে আফগানিস্তান,মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র,কঙ্গো,ইরাক,মালি,নাইজেরিয়া,সোমালিয়া,দক্ষিণ সুদান,সিরিয়া ও ইয়েমেন।এই দেশগুলোর সংঘাতের মধ্যে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ কতগুলো শিশু।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে এই ১০টি দেশের চলমান সংঘাতে ৫ লাখ শিশু মারা গেছে।যুদ্ধক্ষেত্রের আশেপাশের ৫০ কিলোমিটার এলাকাকে সংঘাতকবলিত এলাকা হিসেবে ধরা হয়েছে ওই গবেষণায়।সেভ দ্য চিলড্রেন পরিচালিত ওই গবেষণাটিতে আরো উঠে এসেছে বিশ্বের সংঘাতকবলিত এলাকায় বসবাসকারী শিশুর সংখ্যা।২০১৭ সালে বিশ্বের সংঘাতকবলিত এলাকায় বসবাসকারী শিশুর সংখ্যা ৪২ কোটিতে এসে পৌঁছেছে।খোদ এশিয়ায়ার সংঘাতকবলিত এলাকাতেই সাড়ে ১৯ কোটি শিশু বসবাস করছে।যা সব মহাদেশ মিলিয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যা।আফ্রিকায় ১৫ কোটি ২০ লাখ শিশু জীবন কাটাচ্ছে সংঘাতের মধ্যে।বর্তমান বিশ্বে ইয়েমেন শিশুদের জন্য ভয়ঙ্কর এক জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৭ সালে উচ্চ-সংঘাতপূর্ণ এলাকার মধ্যে দেখা গেছে,ইয়েমেনের ৯০ শতাংশ শিশুর জীবন কাটছে যুদ্ধ,সংঘাত আর মৃত্যুর খড়গ মাথায় নিয়ে।ইয়েমেনের যুদ্ধে ৫ বছর বয়সের নিচে ৮৫ হাজার শিশু মারা গেছে শুধু অনাহারে।অপরদিকে সিরিয়ায় আট বছর ধরে চলা সংঘাতে ২১ হাজার শিশু নিহত হয়েছে।নরক কি জিনিস তা বোধ হয় মৃত্যু যন্ত্রণায় বেঁচে থেকেও পদে পদে অনুভব করছে ইয়েমেন ও সিরিয়ার শিশুরা।তাদের জীবন বলতে,হাড্ডিসার শরীরে স্যালাইনের সুইচ গায়ে ফুটিয়ে হাসপাতালের বেডে নিথর হয়ে পড়ে থাকা।বিশ্বের বিভিন্ন শিশু সংগঠনগুলো এর বিরুদ্ধে কিছুটা সোচ্চার হলেও,অন্যান্য ক্ষমতাধর সংগঠন ও রাষ্ট্রগুলো এর বিরুদ্ধে কতটা সক্রিয়,তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়।বিশ্বের প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে আমাদের দেশের শিশুরাও কতটা শান্তিতে আছে,তা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।আমাদের দেশ থেকে এখনো পুরোপুরিভাবে শিশুশ্রম নামক জিনিসটি দূর করতে পারিনি আমরা।ইটের ভাটা থেকে শুরু করে গাড়ির গ্যারেজ,সবখানে কচি কচি হাতগুলোকে ব্যবহার করছে কতগুলো স্বার্থান্বেষী মহল।
প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মেয়ে শিশুরা।ধর্ষণের পর হত্যা করা হচ্ছে। চুরির অপবাদ দিয়ে মারধর করা হচ্ছে শিশুদের।পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের রোষানলে পড়ে প্রাণ হারাতে হচ্ছে অনেক শিশুকে।আজ আমাদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নিরানব্বই তম জন্মবার্ষিকী।সেই সাথে জাতীয় শিশু দিবসও।বঙ্গবন্ধু ছিলেন কোমল হৃদয়ের অধিকারী।নিমিষে সহজ সরল শিশুদের মনের সাথে সহজে মিশে যেতে পারতেন।যদি দেশদ্রোহীরা মানুষটিকে নির্মমভাবে হত্যা না করতো তাহলে উনি শিশুদের জন্য অনেক কিছু করে যেতেন।এটা অন্তত নিশ্চিত। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও শিশুদের সাথে সহজে মিশে যেতে পারেন।জাতীয় বই উৎসব থেকে শুরু করে বিভিন্ন দিবস।শিশুদের আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরেন।যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর আদর পায় তাঁরা অত্যন্ত ভাগ্যবান।তাঁদের হাসিমুখগুলো অন্তত সেই কথাই বলে।কিন্তু দেশের প্রতিটা শিশুর প্রধানমন্ত্রীর আদর পাওয়ার সে সুভাগ্য হয়ে উঠে না!প্রকৃত পক্ষে এটা সম্ভবও না।
কিন্তু আমরা চাইলে ওই শূন্যতার কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারি।আমরাই পারি আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিশুদের বুকে টেনে নিতে।আমরা একটু সচেতন হলেই পারি শিশু নির্যাতন রোধ করতে।অন্তরে শিশুদের প্রতি একটু ভালোবাসা থাকলেই, পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে অনায়াসে একটি শিশু বান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলা যায়।অন্তত বড়রা চেষ্টা করলে শিশুদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে শিশুদের এই ক্ষুদ্র উপহারটুকু দিতে পারে।
হিমু চন্দ্র শীল,শিক্ষার্থী,কক্সবাজার সরকারী কলেজ।
আরও পড়ুনঃ