লেখক:ডাক্তার মারুফা আক্তার
সুখী ও সুন্দর জীবনের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন শারীরিক সুস্থতা। সুস্থ থাকতে দরকার স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাত্রা ও পরিমিত ওজন। যারা হেলদি লাইফস্টাইল মেনটেইন করেন না, খাবারের ক্ষেত্রে অনিয়ম করেন এবং শারীরিক পরিশ্রম এড়িয়ে চলেন, খুব সহজেই তাদের শরীরে অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি জমে যায়। অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধির এই সমস্যাকে বলা হয় ওবেসিটি। বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই অনুযায়ী দেহের উচ্চতার বিবেচনায় ওজন বেড়ে গেলে তখনই তা চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়ে থাকে! আজকের টপিক চাইল্ড ওবেসিটি নিয়ে। কেন বাচ্চাদের ওয়েট বেড়ে যায় এবং কীভাবে সেটা কন্ট্রোল করা যায়, সেই বিষয়গুলো নিয়ে আজকের আলোচনা।
যেসব কারণে ওজন বাড়ে
শিশুদের অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি বা মুটিয়ে যাওয়ার কারণ কী, চলুন প্রথমেই সেগুলো জেনে নেওয়া যাক-
- জেনেটিক্যাল ইস্যু
- হরমোনের অসামঞ্জস্যতা
- পারিপার্শ্বিক পরিবেশ
- সারাদিন শুয়ে বসে থাকা
- অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা
- বাইরে খেলাধুলা না করা
- অতিরিক্ত কোমল পানীয় পান এবং চকোলেট, ডোনাট, চিপস, বার্গার ইত্যাদি ফাস্টফুড নিয়মিত খাওয়া
মানসিক চাপের কারণেও শিশুর ওজন বাড়তে পারে। একঘেয়েমি জীবনযাত্রার কারণে বা কোনো বিনোদন ব্যবস্থা না থাকায় অনেক বাচ্চারাই ঘরে বসে অতিরিক্ত খাবার খায়। কিন্তু শারীরিক পরিশ্রম না হওয়ার কারণে সেই ফ্যাট বার্ন হয় না। তাই ওজন বেড়ে যায়। স্টেরয়েড জাতীয় মেডিসিন দীর্ঘদিন যাবত সেবনেও ওজন বাড়তে পারে।
কম খেলেও বাড়ছে ওজন?
পরিমাণে কম খেলেও ওজন বাড়তে দেখা যায় অনেক বাচ্চার। এ ক্ষেত্রে ধীরে খাবার হজম হওয়াকে দায়ী করা যেতে পারে। দেখা যায় অনেক বাচ্চারা একই স্থানে বসে দীর্ঘ সময় টেলিভিশন দেখে, তাদের ক্ষেত্রে এটি বেশি দেখা যায়। ছোটাছুটি না করলে হজমের সমস্যা দেখা দেয়। অনেকে আইসক্রিম, মিল্ক চকোলেট, বার্গার, তেলে ভাজা খাবার ইত্যাদি ফাস্টফুড রেগুলার খেয়ে অভ্যস্ত। এসব খাবারে উচ্চমাত্রায় ক্যালরি থাকে। তাই এসব খাবার অল্প খেলেও শরীরে অধিক মাত্রায় ক্যালরি জমা হয়। ফলে পরিমাণে কম খেলেও ওজন বেড়ে যায়।
চাইল্ড ওবেসিটি কি জটিল কোনো সমস্যা?
চাইল্ড ওবেসিটি থাকলে সাধারণত কিছু জটিলতা দেখা দেয়-
- টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়
- রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়
- উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা দেখা দেয়
- কোমর ও জয়েন্টে জয়েন্টে পেইন হয়
- ঘুমের মধ্যে নাকডাকার সমস্যা ও শ্বাসকষ্ট হয়
- পিত্তথলিতে পাথর বা ইনফেকশন হয়
- শারীরিক ও মানসিক অবসাদ দেখা দেয়
- ঘাড় ও ত্বকের ভাঁজে ভাঁজে কালো দাগ দেখা দেয়
- চর্বি জমে লিভারের স্থায়ী সমস্যা হতে পারে
এছাড়াও অল্প বয়সেই ছেলে শিশুদের দাঁড়ি গোফ ওঠা বা মেয়েদের মাসিক শুরু হয়ে যাওয়া এবং অবাঞ্চিত লোম গজানোর মতো বিব্রতকর সমস্যা হতে পারে। তাহলে আপনি এখন নিজেই বুঝতে পারছেন যে চাইল্ড ওবেসিটি গুরুত্বর সমস্যা কিনা!
চাইল্ড ওবেসিটি প্রতিরোধে মা-বাবার করণীয়
১) শিশুর ওজন বৃদ্ধি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিতে একটি ওয়েট চার্ট রাখতে হবে। বয়স অনুযায়ী বাচ্চার ওয়েট কেমন হওয়া উচিত, সেটা ডাক্তারের কাছ থেকে জেনে নিন।
২) স্কুল যদি বাসার কাছে হয়, তাহলে গাড়ি বা রিকশা ব্যবহার না করে শিশুকে হেঁটে যাতায়াতের অভ্যাস করুন।
৩) কৌটার দুধ বা শুধুমাত্র প্যাকেটজাত খাবার খাওয়ালে অল্প বয়সেই শিশু ওবেসিটিতে ভুগতে পারে। তাই শিশুকে ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ান। ছয় মাস পূর্ণ হলে ঘরে বানানো পুষ্টিকর খাবার ও ফলমূল পরিমিত পরিমাণে দিতে হবে। বাড়ন্ত শিশুকে ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, চকোলেট, আইসক্রিম, সসেজ, ফ্রোজেন স্ন্যাকস প্রভৃতি বাইরের খাবার যতটা সম্ভব কম দিতে হবে।
৪) শিশুকে নিজের কাজ নিজে করতে উৎসাহিত করতে হবে এবং বাইরে খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে। সারাদিন যেন টিভির সামনে বসে না থাকে বা ডিভাইসে আসক্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৫) লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ির ব্যবহার, প্রতিদিন বাইরে খোলামেলা পরিবেশে খেলাধুলা করা, বাড়ির কাজে শিশুর অংশগ্রহণ ইত্যাদি শিশুকে ফিট থাকতে সাহায্য করবে।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন
শিশু বেশি মুটিয়ে যাচ্ছে বা অতিরিক্ত ওজনের কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, এমনটা সন্দেহ হলে অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি উচ্চতা ও ওজন মেপে এবং প্রয়োজনে অন্যান্য টেস্ট করে বলতে পারবেন যে আপনার শিশু আসলেই ওবেসিটির দিকে যাচ্ছে কিনা। কোনো হরমোনাল প্রবলেম থাকলে সেটাও বোঝা যাবে। তাই চাইল্ড ওবেসিটি থাকলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ হলো খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন। ফাস্টফুড পরিহার করে ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যকর ও সুষম খাবার গ্রহণ করুন এবং শিশুকেও এই ব্যাপারে উৎসাহিত করুন। সুষম খাবার গ্রহণ ও শরীরচর্চার মাধ্যমেও ওজন নিয়ন্ত্রণে না এলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না! আজ এই পর্যন্তই, ভালো থাকবেন।
Comments are closed.