কি অদ্ভূত এ পৃথিবী, দেখ।মানুষ মানুষকে গুলি করে মারে, জবাই করে মারে! আমার বাড়ি বৃহত্তর রংপুরের লালমণিরহাট জেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের বরুয়া গ্রামের গোবিন্দপাড়াস্থ গোবিন্দবাড়িতে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালিদের সব রকম “অসহযোগিতার” ফলস্বরুপ খাবার-দাবার বন্ধ হয়ে যাবার ফলে অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে বর্ডারের নিরাপত্তার দায়িত্ব ফেলে রেখে ফুলবাড়ি বর্ডার থেকে পলায়নরত পাকিস্তানি সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কুলাঘাট হয়ে সকালের দিকে লালমনিরহাট শহরে প্রবেশ করার মুখে অসংগঠিত লোকজন কর্তৃক প্রতিরোধের সম্মুখিন হয়ে শুরু করে গোলাগুলি। আর এর প্রেক্ষিতে লালমনারহাট শহরের উত্তরদিকে উপ-শহর আপইয়ার্ডে বসবাসকারি অবাঙালি “বিহারী”রা সংগঠিত হয়ে নেমে পড়ে পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে। তারা বাঙালির প্রতিরোধ ভেঙে শহরে শুরু করে দেয় বাঙালিদের বসতবাড়িতে হামলা, লুটপাট অগ্নি সংযোগ আর গোলাগুলি।
এর ফলে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ জীবন বাঁচাতে দলে দলে শহর থেকে খালি হাতে ছুটে আসতে থাকে শহর ছেড়ে বাইরে, গ্রামের দিকে। মানুষের এ দুর্গতি দেখে গ্রামের সাধারণ মানুষজন হয়ে ওঠে আতঙ্কিত। সে কি যে বিভিষিকাময় দিন ছিল সেই দিনটি – বলে বোঝানো যাবে না।
মানুষ ছুটছে জীবন বাঁচাতে, খালি হাতে, নিঃস্ব হয়ে। সামনে কি আছে, ভবিষ্যৎ কি, কোথায় যাবে, কি করবে, কি খাবে, কোথায় আশ্রয় পাবে – কোন ঠিকানা নেই।
দলে দলে চলে আসছে পলায়মান মানুষের ঢল – হিন্দু-মুসলিম, ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর; পিছনে গোলাগুলির শব্দ, আকাশে কুন্ডলি পাকানো ধোয়ার উদ্গিরণ….. সে কী যে এক অবর্ণনীয় ভীতিকর উদ্বেগসংকুল হতাশাময় নারকীয় পরিবেশ… যে না দেখেছে, সে শুনে ধারণা করতে পারবে না।
এর আগেই দেশে শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ আর পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞের খবর বিবিসি আর ভারতীয় আকাশবাণীর মাধ্যমে জেনে গেছে পৃথিবীর মানুষদের সাথে গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষও। এরপর এই লালমনিরহাটে পাকিস্তানী বাহিনী কি করতে পারে – তা জানে সবাই। ভেঙে পড়ে গ্রামের মানুষজন।
এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান আর্মির ভয়ে আমরাও লালমনিরহাট থেকে সেদিন প্রাণ বাঁচাতে বাড়ি ছেড়ে খালিহাতে কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়া হঠাৎ করে ভারতের দিকে রওনা দিতে বাধ্য হই আমরাও।
প্রাথমিকভাবে আমাদের লক্ষ্য পশ্চিমবাংলার কুচবিহার জেলার দিনহাটা – মামাদের বাড়ি – পরবর্তি লক্ষ্য আসামের বঙাইগাঁওয়ের সেজদির বাড়ি। মামারা কেউ বেঁচে নেই – মামাতো ভাইয়েরা আছেন। লালমনিরহাট শহরের পাকাবাড়ি ছেড়ে গিয়ে তারা ওপারে অভাব অনটনে দিনাতিপাত করেছেন বলে শুধু জানি।
মামাদেরকে দেখি নাই। শুধু একবার এক মামতো ভাই এসেছিলেন – তাদেরকে নিয়ে স্মৃতি শুধুমাত্র এ টুকুই। আর লালমনিরহাট শহরের বাড়ি, বাবা মা ভাইবোন – সব ছেড়ে রেলের চাকুরে সেজো জামাইবাবু দেশভাগের পর অপশন দিয়ে চলে যান আসামে, থাকেন বঙাইগাঁওয়ে। এত আগে চলে গেছেন যে, দিদি আর জামাইবাবুর কোন স্মৃতি নেই মননে।
বিবাহিত তিন দিদি ছাড়া আমরা বাড়িতে তিনভাই একবোন। বড়দ্ কৃষ্ণগোপাল রায় কারমাইকেল কলেজের ছাত্র, ছাত্র সংসদের সদস্য, ছাত্রনেতা। সত্তুরের নির্বাচনে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে রংপুরের ভাষায় “খোলান বৈঠক” – শুদ্ধ বাংলায় উঠান বৈঠক করে দিনরাত নাওয়া খাওয়া ভুলে গ্রামে গ্রামে মানুষজনকে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আর স্বাধীকার ও স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষা দিতে ছুটে বেড়িয়ে একাত্তুরে ছুটে বেড়াচ্ছে স্বাধীনতার সংগ্রামে। সে বাড়িতে নেই। একাত্তুরের শুরু থেকে সে প্রায় নিখোঁজ। শুধু তার খবর পাওয়া যায় লোকমুখে। আজ সে রংপুরে তো কদিন পর সে নাকি দিনহাটায় কিংবা কুচবিহারে – স্বাধীনতার সংগঠকের কাজে ব্যাতিব্যস্ত। পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের খবরে মা তো ধরেই নিয়েছেন যে, তার “কৃষ্ণ”কে মেরে ফেরেছে পাকিস্তানী বাহিনি- না হলে সে বাড়ি আসে না কেন? মায়ের কান্না আর থামে না। বড়দা না থাকায় বাবা আমাদের দুইভাই, ছোটবেন আর মাকে পাঠিয়ে দিলেন।
রওনা দিলাম আমরা হেটে। বাস নেই, রিকসা নেই সে সময়। আমরা হাটছি। আমাদের বাড়ির কুকুর “ভুলু” আমাদের সাথে হেটে, দৌড়িয়ে, ধরলা নদী সাতার কেটে পার হয়ে ভারতের গীতালদহ স্টেশন পর্য়ন্ত গিয়ে হাজির হল। দিনহাটা যাবার উদ্দেশে ট্রেন আসার পরে যখন ট্রেনে উঠলাম সবাই, ভুলুও লাফিয়ে ট্রেনে উঠে বসল। কিন্তু অন্য মানুষেরা তাকে তাড়া দিয়ে নামিয়ে দেয়। ট্রেন ছেড়ে দিলে সে পাশে পাশে দৌড়াতে থাকে। ট্রেনের গতি বাড়ে, ভুলুরও দৌড় বাড়ে। দৌড়াতে দৌড়াতে ট্রেনের গতির কাছে সে একসময় পিছিয়ে পড়ে হারিয়ে যায়। আমাদের সবার মন খারাপ হয়ে যায়। আর মা তার প্রিয় কুকুরটির জন্য অঝোর নয়নে কাঁদতে থাকে।
যুদ্ধের শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে এলে ভুলুর কথা শুনলাম সবাই মনসুর কাকার কাছে। তারা মাটি কামড়ে ধরে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে পড়ে ছিলেন বাড়িতে। দিনের বেলা বই-বাচ্চা নিয়ে জঙ্গলে, বাঁশঝাড়ে, ডোবার পানার আড়ালে, পানা মাথায় দিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে থাকতেন আর বাড়ি ফিরতেন সন্ধ্যায়। সন্ধ্যার পরে মুক্তিবাহিনীর ভয়ে বের হত না পাকিস্তানী বাহিনী।
ভুলু আমাদের জনমানব শুন্য বাড়িতে ফিরে এসে বাড়ির সামনে বসে দিনরাত শুধু ভেউ ভেউ শব্দে কাঁদত। মনসুর কাকা নিজে ভাত দিয়ে যেত,কিন্তু সে খেত না, শুধু কাঁদত। দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। না খেয়ে না খেয়ে কিছুদিন পর ভুলু দুর্বল হয়ে এক জায়গাতেই শুয়ে কাঁদত। মনসুর কাকা তার মুখের সামনে ভাত দিয়েছে, কথা বলেছে, খেতে অনুরোধ করেছে, গায়ে পিঠ হাত বুলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কোনকিছুতে মন গলে নাই ভুলুর। সে শুধু মনসুর কাকার দিকে মুখ তুলে তাঁকিয়ে ভেউ ভেউ শব্দে কাঁদত আর জল গড়িয়ে পড়ত তার দুচোখ দিয়ে। এভাবে না খেয়ে না খেয়ে একদিন মরে যায় ভুলু।
মনসুর কাকা ভুলু কষ্ট বুঝতে পেরেছেন। আর সে জন্যই মারা যাবার পর ভুলুর মৃতদেহ তিনি ফেলে রাখেন নাই – তাকে যত্ন করে কবর দিয়ে প্রতিদান দিয়েছেন তার এই আত্মত্যাগের
কতবার কতজনকে এ কাহিনী যে শুনিয়েছেন মনসুর কাকা। যারাই তার কাছে এ কাহিনী শুনত, তাদেরই চোখ দিয়ে আপনা আপনি গড়িয়ে পড়ত জল। আটকাতে পারত না কেউ চোখের জল।
এই ভুলুকে নিয়ে “মানুষ ও কুকুর” নামে আমার লেখা একটি গল্প আছে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ “যে জীবন ফড়িঙের”- যাতে বাবার স্বগোক্তি মত বলা কথাটি অবিকল লিখেছিলাম – “কি অদ্ভূত এ পৃথিবী, দেখ।মানুষ মানুষকে গুলি করে মারে, জবাই করে মারে! আর বাড়ির একটি পোষা কুকুর – বাড়ির মানুষ তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় তাদের শোকে দু:খে না খেয়ে না খেয়ে জীবন দেয়…”
—-
গল্পঃ কুকুর
লেখকঃ মুকুল রায়।
(একটি সত্য কাহিনী)
—-
Comments are closed.