লেখকঃ মালিহা নামলাহ
“পরীক্ষা”! শব্দটির অর্থ বুঝে ওঠার আগেই এই যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বারংবার পিষ্ট হতে হয় শিশুদের। তাই অর্থ সম্বন্ধে সন্দিহান এই জটিল শব্দটি সকল শিশুর জীবনেই এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো! এই শব্দটির পুনরাবৃত্তি হতে থাকে তাদের জীবনের অংশ হয়ে। পরীক্ষা শব্দটির মধ্যে নীহিত থাকে তাদের মা বাবার আদর, রাগ, পুরষ্কার, তিরষ্কার আর সেই সাথে “মেধাবী” অথবা “গবেট” উপাধি। তাদের প্রতিভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পর্যন্ত পায় না, অথচ তাদের প্রতিভার মূল্যায়ন এমনকি তাদের প্রতিভা সম্পর্কিত চূড়ান্ত “ট্যাগ” লাগিয়ে দেওয়া হয়।
অভিভাবকের প্রয়াস থাকে ছেলেমেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকেই “বিদ্বান” অর্থাৎ অধিক বোঝা বহনে সক্ষম নিরীহ গাধার দলভুক্ত করার, যা একটা শিশুর পাকস্থলির আকার হয়তো বৃদ্ধি করে, কিন্তু হজমশক্তিকে করে তোলে অধিক থেকে অধিকতর দুর্বল! তাই তারা গলধঃকরণ এবং উদগীরণ পদ্ধতিতে আরো বেশি দক্ষ হয়ে উঠলেও খুব কম অংশই হজম করতে সক্ষম হয়। সদ্য বাড়তে থাকা কাদামাটির মতো মস্তিষ্ককে চাপে চাপে এমনভাবে থেতলে দেওয়া হয় যে পরবর্তীতে আর কোনোভাবেই কোনো ছাচে ফেলেই তাকে পূর্বের আকারে ফিরিয়ে আনা যায় না। প্রাণচঞ্চল ছেলেবেলাকে “হতাশা” আর কষ্ট দিয়ে ভরিয়ে দেয় এই পরীক্ষা পদ্ধতি! হ্যা, আমাদের দেশের শিশুরাও “হতাশা” নামক অনুভূতির সাথে পরিচিত, যদিও তারা জানে না হতাশা কি।
এই যান্ত্রিক প্রক্রিয়া শিশুদেরকে তো পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত করে, কিন্তু “শিক্ষা” থেকে করে দেয় বিমুখ। তাই আজীবনভর সে “শিক্ষা” অর্থ বলতে পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাওয়াই অর্থাৎ গলধঃকরণ এবং উদগীরণই বোঝে, হজম করার পন্থা জানে না, আর তাই চিরকালই সে ভোগে পুষ্টিহীনতায় যা তার বড় হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ঐ যে বললাম, “থেতলে যাওয়া মস্তিষ্ক!” যে বয়সে শিশুদের কাছে শিক্ষা হওয়ার কথা খেলার আরেক রূপ, পড়াশোনা হওয়ার কথা হজমশক্তি বাড়ানোর ঔষধ, সেই বয়সে তাদের “লিভার ড্যামেজ” হয়ে যায় এই পড়াশোনার জন্যই (পুষ্টিকর খাবার ধারণক্ষমতার অধিক গ্রহণ করলে সেই পুষ্টিকর খাবারই হয় রোগের কারণ) এবং বড় হতে হতে গলধঃকরণের জন্য প্রয়োজন হয় বাহির থেকে অতিরিক্ত ঔষধ সেবন, খাদ্যের প্রতি অনীহা যায় না শুধু হজমি বড়িতে। তাই সাইক্রিয়াটিস্ট, অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি কোনোটাই বাদ থাকে না।
আমাদের দেশে শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা বদলাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর শিক্ষাব্যবস্থা ও তার ফলাফল এর দিকে নজর দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার নানাবিধ পরিবর্তন আনছেন সরকার। এরকমই একটা পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ১৩ মার্চ, ২০১৯ জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ এর উদ্বোধনী তে সামনের বছর থেকে শিশুদের মানসিক চাপ কমানো ও স্বাভাবিক বিকাশের লক্ষ্যে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত সকল প্রকার পরীক্ষা বাতিল করার সিদ্ধান্তের কথা জানান তিনি। প্রথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুদের লিখিত ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কে সমালোচনা করে তিনি বলেন এসব পরীক্ষা বন্ধ করে এলাকার স্কুলে বাচ্চারা যেন পড়তে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বাচ্চাদের পরীক্ষা নেওয়ার ব্যপারটিকে শিশুদের প্রতি “মানসিক অত্যাচার” বলে উল্লেখ করেছেন।
অত্যন্ত প্রশংসনীয় এই উদ্যোগের ফলে শিশুরা খেলাধুলার অবকাশ পাবে, পাবে পড়ার পাশাপাশি চিন্তা করার সুযোগ। অভিভাবকদের মধ্যে প্রচলিত প্রতিযোগিতায় শিশুকে হতে হবে না শিক্ষা ও অভিভাবকের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তারা শিখবে শেখার মতো করে, পড়বে জানার ও শেখার জন্য, পরবর্তীতে বড় হয়ে পরীক্ষা দিবে শ্রদ্ধার সাথে সুস্থ মানসিকতায়। সুখাদ্য হজম করে মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে জাতিকে একটি সুস্থ সমাজব্যবস্থা উপহার দেবে তারা (ইনশাআল্লাহ)। এই উদ্যোগ সফল হোক, কোটি চোখের এক স্বপ্ন সুন্দর ও শিক্ষিত সোনার বাংলা বেড়ে উঠুক সকল খোলশ ভেঙে।
আরো পড়ুনঃ টেরোরিস্ট h