বাংলাদেশে তিন কোটি ২০ লাখের বেশি কিশোর-কিশোরী রয়েছে। তরুণ জনমিতির এই দেশে তারাই মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ।
বেড়ে ওঠার সময়ে কিশোর-কিশোরীরা বাড়তি দায়িত্ব নেয়, নতুন কিছু করতে চায় এবং স্বাধীনতা চায়।
এটা সেই সময় যখন মানুষের মূল্যবোধ ও দক্ষতা তৈরি হয়, যার বিরাট প্রভাব থাকে নিজের ও সমাজের কল্যাণে। কিন্তু বাংলাদেশে এই বয়সী ছেলে-মেয়েদের সম্ভাবনা অবিকশিতই রয়ে যায়।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট সাধারণত কিশোর-কিশোরীদের মতামত প্রদান, কোনো কিছু নিয়ে সোচ্চার হওয়া বা বড়দের প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করে।
সে কারণে তাদের প্রয়োজন ও সমস্যার বিষয়গুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নজর দেওয়া হয় না। এদেশে কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রয়োজনীয় সেবাগুলো সম্পর্কেও মানুষ ভালোভাবে জানছে না।
এই তরুণ জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে তাদের কম বেতনের কাজের চক্রে আটকে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
এদেশের কিশোরীরা গর্ভধারণের হার অনেক বেশী কিন্তু স্বাস্থ্য সেবায় তাদের সেভাবে প্রবেশাধিকার না থাকায় প্রজনন স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে খুব জ্ঞান থাকে না।
প্রচণ্ড পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কুপ্রথার কারণে কিশোরীরা খুব বেশি সহিংসতা ও হয়রানির শিকার হয়। অন্ত্যজ শ্রেণি, আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং প্রতিবন্ধীরা আরও বেশি বৈষম্যের শিকার হয়। দ্রুত নগরায়নের ফলে শহর এলাকা ও বস্তির কিশোর-কিশোরীদের জন্য মৌলিক সেবাও সংকুচিত হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ ভীষণভাবে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোপ্রবণ। এ রকম পরিস্থিতিতে শিশু শ্রম, পাচার ও বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। সংকট ও দুর্যোগের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে ধর্ষণসহ অন্যান্য হয়রানির ঝুঁকি বাড়ে তাদের।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রতিনিধিত্বকারী কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ অধিকাংশ এলাকাতেই সংবাদমাধ্যমের আলো পৌঁছেনি।
বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলে ও মেয়েদের ক্ষেত্রে একই ধরনের সফলতা অর্জনের নজির তেমন একটা নেই।
যথাযথ পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক না হওয়া, সরকারি প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্যের ঘাটতি এবং তরুণ ছেলে-মেয়েদের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে তাদের তেমন অংশগ্রহণ না থাকার কারণে এমনটা ঘটছে।
সমাধান
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যত্নশীল প্রাপ্তবয়স্করা যখন কিশোর-কিশোরীদের সহায়তা ও উৎসাহ দিয়েছে এবং তাদের প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে নীতি নির্ধারণ ও সেবা দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে তারা দীর্ঘকালীন দারিদ্র্য, বৈষম্য ও সহিংসতার চক্র ভেঙে ফেলার সক্ষমতা অর্জন করেছে।
অংশগ্রহণমূলক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তরুণ ছেলে-মেয়েদের তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো তুলে ধরনে উৎসাহ দেয় ইউনিসেফ। প্রয়োজনীয় সেবা দাবি করা ও তার সদ্ব্যবহার এবং ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ এড়িয়ে যেতে শেখানো হয় তাদের।
কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তি এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগের পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের অংশগ্রহণ, বিনোদন ও খেলাধুলার সুযোগ নিশ্চিতে কাজ করে ইউনিসেফ।
তরুণদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের নিরাপত্তা ও বিকশিত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী সামাজিক আচরণের বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতেও কাজ করে এই সংস্থা।
কিশোর-কিশোরী, তাদের পরিবার ও কমিউনিটির সঙ্গে দুই ধাপে সম্পৃক্ত হয় ইউনিসেফ।
বেতারের শ্রোতাদের মাধ্যমে গ্রামীণ তরুণ-তরুণীদের কাছে পৌঁছায় ইউনিসেফ।সে কারণে কমিউনিটি রেডিওর বিস্তারে কাজ করা হচ্ছে।
প্রত্যন্ত অঞ্চল, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযুক্ত ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক মানসম্মত কনটেন্ট উপহার দিতে কাজ করে ইউনিসেফ।
প্রচারমাধ্যমের নাগালের বাইরে থাকা এলাকায় তথ্য পৌঁছাতে কমিউনিটি, স্থানীয় ও পল্লীকেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্ম জোরদারে ইউনিসেফ বিনিয়োগ করে।
২০১২ সাল থেকে ইউনিসেফ তরুণদের তিনশর বেশি ক্লাবকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, যেগুলোর সদস্য অন্তত এক লাখ ছেলে-মেয়ে।
জ্ঞান ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়াতে তাদের জীবনাভিজ্ঞতার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মেয়েদের বিশ্লেষণমূলক চিন্তা, সমঝোতা ও সিদ্ধান্তগ্রহণের সক্ষমতা তৈরিতে বিশেষ নজর দেওয়া হয়।
অল্পবয়সীরা নিজেদের মধ্যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে জীবনমুখী দক্ষতা আয়ত্ত্ব করে নেয়। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা তৈরিতে তাদের গ্রুপ লিডারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে করে সামাজিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলী গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে।
পরিবার, সমাজ, স্থানীয় সরকার ও ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে গঠিত কমিউনিটিভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটিকে সহায়তা দেয় ইউনিসেফ। এতে বাল্যবিয়ে বন্ধের জনমত তৈরি হয়।
এসব কমিটিতে ক্লাব সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত দুজন কিশোর-কিশোরীও প্রতিনিধিত্ব করেন।
কিশোর-কিশোরীবান্ধব নীতিমালা ও কর্মসূচি প্রণয়নে ইউনিসেফ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, তরুণদের বিভিন্ন গ্রুপ, বেসরকারি খাত, জাতীয় ও আঞ্চলিক প্রচারমাধ্যম এবং জাতিসংঘের অপরাপর সংস্থার সঙ্গে কাজ করে।
তাদের অধিকার ও বিভিন্ন সমস্যার বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ এবং তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ ও সামাজিক প্রথার পরিবর্তনের উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমকে কাজে লাগানো হয়।
বয়স উপযোগী, সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল এবং শিশুদের বিনোদন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান তৈরিতে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি ও বেসরকারি খাতের স্থানীয় মিডিয়ার নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করে ইউনিসেফ।
জলাবয়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধিতে বেতারের শ্রোতা গ্রুপ, প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ ও কমিউনিটি মিডিয়া, যেমন: ফোন-ইন শো ও কুইজ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের সম্পৃক্ত করা হয়। এর মাধ্যমে জরুরি পরিস্থিতিতে হয়রানি, সহিংসতা ও অবহেলার বিষয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য তাদের সক্ষমতা তৈরিতে সহায়তা করা হয়।