লেখকঃ মালিহা নামলাহ
একটা সময় ছিলো, যখন স্কুল প্রাঙ্গণে অনেক কিছুই নতুন ঠেকতো আমার কাছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিভি, সিরিয়াল, বন্ধু বান্ধব, প্রেম-প্রণয়, মুভি, নায়ক-নায়িকা গড়া একটা অতিউচ্চ দেয়াল ঘেরা কুয়ার মাঝে আবদ্ধ থাকত ছেলেমেয়েরা। সমস্যা জর্জরিত পরিবেশ এইসব দেয়াল ভেদ করে শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে পৌছাতে পারত না। পড়াশোনা আর বইপত্রসহ জ্ঞান অর্জনের বিভিন্ন পথে তাদের আনাগোনা, তবুও অনেক কিছু নিয়েই তারা ভাবত না, তারা বুঝত না এসব নিয়ে আসলে তাদেরই ভাবার কথা।
![](https://chotoderbondhu.com/wp-content/uploads/2019/03/YRC-General-Logo.png)
আমরা আসলে চিন্তা করতে শিখিনা ছোটবেলা থেকে, শিখি না সমস্যার মধ্য দিয়ে সমধান করতে। সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুজতে যেয়ে হতাশা যখন আমাকে ঘিরে বিদ্রুপ করতো, তখন আমি আমার আশাপাশের আমারই বয়সী ছেলেমেয়েদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতাম, তাদেরকে ঘিরে রাখা দেয়াল আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকতো! কারো সাথে এসব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তারা আমার দিকে প্রথমে এমনভাবে তাকাতো যেন আমি এক ভিনগ্রহের প্রাণী! তবে আমি দেখেছি, যখন দেয়ালের ওপাশের সামান্য আলো তাদের চোখে এসে পড়তো, তখন তারা আপনা থেকে দেয়াল ভাঙার সরঞ্জাম নিয়ে উঠে পরে লাগতো- মানুষ সর্বদাই মুক্তিপ্রিয়। কিন্তু সেই আলোটুকু তাদের চোখে পৌছে দেওয়াটাই ছিলো বড় চ্যালেঞ্জ।
![](https://chotoderbondhu.com/wp-content/uploads/2019/03/image-1.png)
এখন যখন ৮ম-৯ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা এসে আমার কাছে বলে, “আপু, কোচিং ব্যবসা নিয়ে গবেষণা করলে ভালো হবে নাকি প্রযুক্তির প্রভাবে পারিবারিক সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করলে ভালো হবে?” অথবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন শিক্ষার্থীদের কোনো দল যানজট সমস্যার সমাধান বের করার জন্য উন্মত্ত হয়ে থাকে, অথবা যখন এইটুকু ছেলেমেয়েরা টেবিল ঘিরে বসে গম্ভীর মুখে আলোচনা করে নগর বিকেন্দ্রিকরণ নিয়ে, তখন আমার হৃদয়ের সেই ক্ষত হওয়া জায়গাগুলো প্রশান্তিতে ভরে যায়! মনে হয় এইতো, এইতো আমার চোখের সামনে গড়ে উঠছে আমার দেশ! আর কোনো চিন্তা নেই। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা চিন্তা করতে শিখে গেছে!
![](https://chotoderbondhu.com/wp-content/uploads/2019/03/c1.png)
কিভাবে ভাঙছে সেসব সুউচ্চ দেয়াল? কিভাবে পৌছাচ্ছে শিশুদের চোখে সত্যচেতনার আলো? এর পেছনে যার অবদান সে হলো “চিন্তার চাষ”। “পথচলা আলোর সাথে” স্লোগান ধারণ করে যারা শিক্ষার্থীদের নিয়ে করে যাচ্ছে বিভিন্ন গবেষণার কর্মশালা। তারা শিক্ষার্থীদের নিজস্ব চিন্তায় নিজের মতো করে গবেষণা করতে শেখাচ্ছে। ২০১৬ সালে প্রথম চিন্তার চাষের স্কুল গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় অনুষ্ঠিত হয় “ক্ষুদে গবেষক সম্মেলন”। সেই থেকে প্রতি বছর ৭ম-১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় এই সম্মেলন। চিন্তার চাষের এই কার্যক্রম যাদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান (চেয়ারম্যান), এম জাকির হোসেন খান (ভাইস চেয়ারম্যান), এস এম মেসবাহ আর রহমান (নির্বাহী পরিচালক), জাহিদুল ইসলাম (উপ-পরিচালক), মোকারমা মিতা (সমন্বয়ক) ও রুকাইয়া আলম (সমন্বয়ক)। এছাড়া ৬৭ জন স্বেচ্ছাসেবকের অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে ‘স্কুল গবেষণা কার্যক্রম’ বাস্তবায়নে। গত বছর ২০১৮ সালে ৩৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মোট ৪৭০জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিলো স্কুল গবেষণা কার্যক্রমে।
![](https://chotoderbondhu.com/wp-content/uploads/2019/03/image-2.png)
চিন্তার চাষের উপপরিচালক ও ফেলো (শিক্ষা ও গবেষণা) জাহিদুল ইসলাম কে “এতটা পথ পাড়ি দিয়ে কতটা সফল? কতখানি লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে?” প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “যে কাজ চিন্তার চাষ শুরু করেছে তার প্রযোজ্যতা ফুরাবার নয়। তাই পথ পরিক্রমায় প্রথম চার বছরকে একটা সুদীর্ঘ পথ চলার শুরু বা ভিত্তি স্থাপন পর্ব বলা যেতে পারে। সে হিসেবে এ পর্বে আমরা আশানুরূপ অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছি। ঢাকা থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রাম, শ্রীমঙ্গল, রংপুর পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি। এই বছরই ক্যালেন্ডারে রয়েছে নোয়াখালী, বরিশাল, ঠাকুরগাঁও ও খুলনা। তবে আমাদের এই স্কুল গবেষণা কার্যক্রমের একটা জাতীয় প্রভাব এখনও অর্জিত হয়নি। এর কারণ যাদের নিয়ে আমরা কাজ করছি তাদের এখনো জাতীয় পর্যায়ে পৌছার বয়স হয়নি। আমরা আশা করছি যারা নিজের মত করে চিন্তা করতে শিখছে তারা যখন সমাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করবে তখন জাতীয় পর্যায়ে একটি দৃশ্যমান গুণগত পরিবর্তন আসবে”। তিনি আরো বলেন যে তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আরোপিত ব্যবস্থাকে প্রশ্ন কর। দেখো, ভাবো, চিন্তা কর ও সিদ্ধান্ত নাও মুক্ত ভাবে, যৌক্তিকতার সাথে নিজের মত করে”।
![](https://chotoderbondhu.com/wp-content/uploads/2019/03/ম.png)
এই স্কুল গবেষণা কার্যক্রমের সার্বিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো স্কুল ছাত্র ছাত্রীদের স্বাভাবিক চিন্তাশক্তির লালন, ছাত্রছাত্রীদের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ঘটানো এবং বৈশ্বিক বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পূর্বে ছাত্রছাত্রীদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি। চিন্তার চাষের কাঙ্খিত ফল হলো চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশের মাধ্যমে এরূপ একটি প্রজন্ম তৈরি হবে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতার মধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নততর আসনে নিয়ে যাবে ।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে আগামী সম্মেলনের জন্য ‘গবেষণায় হাতেখড়ি’ কর্মশালা। আগামী সম্মেলনের সম্ভাব্য তারিখ ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯। প্রতিযোগিতায় ২টি ইভেন্ট থাকছে-গবেষণা পত্র এবং ধারণাপত্র। যেকোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৭ম-১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে চিন্তার চাষ ক্ষুদে গবেষক সম্মেলনে। এমন যুগোপযোগী উদ্যোগ নিয়ে দেশ গড়ার প্রয়াসে চিন্তার চাষের কার্যক্রম অসংখ্য প্রসংশাযোগ্য, তাদের পথচলা যেন আলোকিত করে বাংলাদেশকে।
মহম্মদপুর প্রিপারেটরী স্কুল এন্ড কলেজ
আরও পড়ুনঃ রুমকির বাল্যবিবাহ আমরা বন্ধ করেছিলাম।
Comments are closed.