কান ফোঁড়ানোর আগে যা জানা প্রয়োজন

0
15

আগেকার দিনে ছোট বয়সে কান ফোঁড়ানোর কাজটা মা–খালারাই করতেন। ঘরে থাকা সুই–সুতা দিয়ে দক্ষ হাতে কাজটা সারতেন তাঁরা। কানের সেই সুতা খুলে কিছুদিন পর পরিয়ে দিতেন রুপা বা সোনার রিং। সময় বদলেছে। এখনকার মায়েরা ছোট্ট মেয়ের কান ফোঁড়াতে পারলার বা চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে কান ফোঁড়ানো হয় বলে খুব একটা টের পাওয়া যায় না। তবে শখের বশে কান কেবল ফোঁড়ালেই হবে না, মেনে চলতে হবে কিছু বিশেষ নির্দেশনা। কান ফোঁড়ানোর আগে যেমন প্রস্তুতি আছে, পরেও তেমনি যত্ন নেওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। একটু অসাবধানতায় কানের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে অনেক।

কোন বয়সে শিশুর কান ফোঁড়ানো উচিত

আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মায়েরা কম বয়সেই মেয়েদের কান ফোঁড়াতে পছন্দ করেন। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ বিউটি পারলারের কর্ণধার শারমিন কচি বলেন, কান ফোঁড়ানোর নির্দিষ্ট কোনো বয়স নেই। তবে কান ফোঁড়ানোর সময় কানের লতির ওপরের হাড় পরিপক্ব হতে হবে, না হলে বয়স হতে হতে ছিদ্র নিচে নেমে আসতে পারে, পরে ভারী দুল পরলে টান লাগবে। আর এমন বয়সে কাজটা করা উচিত, যখন শিশু বুঝতে পারে কান ফোঁড়ানো ব্যাপারটা কী। না হলে কানের দুল টানাটানি করে বা হাতের ঘষায় ঘা তৈরি করে ফেলতে পারে।

যেসব বিষয় মাথায় রাখা জরুরি

১. কান ফোঁড়ানোর আগে কানের লতি ও ব্যবহৃত সুই জীবাণুমুক্ত কি না, নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষ হাতে কান ফোঁড়ানোর দায়িত্ব দিতে হবে।

২.ব্যথা হলে হালকা গরম সেঁক দেওয়া যেতে পারে। ক্ষতস্থান যেন সব সময় পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখার পরামর্শ দিলেন শারমিন কচি। ক্ষত সেরে ওঠার জন্য অন্তত সাত দিন সময় দিতে হবে। শিশুকে স্বাভাবিক খাবার ও পর্যাপ্ত তরল খাবার দিতে হবে। সঙ্গে খেতে হবে ভিটামিন সি–জাতীয় ফলমূল। ভিটামিন সি শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে, দ্রুত ক্ষত সারায়। কিছুদিন এড়িয়ে চলতে হবে অ্যালার্জিজাতীয় খাবার, যেমন গরুর মাংস, বেগুন ইত্যাদি।

দুল পরানোর আগে কোনো ওষুধ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে দুল পরানোর পর কানে ৩. যদি লালচে বা ফোলা ভাব দেখা দেয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিসেপটিক বা ব্যথানাশক ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। ফোসকা বা অতিরিক্ত ফোলা ভাব অবহেলা করা যাবে না। সংক্রমণের লক্ষণ দেখলে দেরি না করে চিকিৎসক দেখাতে হবে।

৪. ঘন ঘন শিশুর কান ধরা যাবে না। অপরিচ্ছন্ন হাতে কান ধরা যাবে না। ক্ষতস্থান যথাসাধ্য পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

৫. জোর করে বা টানাটানি করে দুল পরানোর চেষ্টা করা যাবে না। শুরুতেই ভারী দুল পরানো যাবে না। সোনা বা এমন ধাতুর দুল পরাতে হবে, যাতে অ্যালার্জির ঝুঁকি কম থাকে।

৬. ছোট্ট শিশুর কানে দুল পরানো আনন্দের মুহূর্ত হলেও এর জন্য সঠিক নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ছোট বয়সে সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি থাকে। এই সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও তার আচরণের দিকে খেয়াল রাখলে শিশুর কান ফোঁড়ানোর অভিজ্ঞতা নিরাপদ ও সুন্দর হয়ে উঠবে। আজকাল ব্যথামুক্ত উপায়েই কান ফোঁড়ানো হয়ে থাকে। বিভিন্ন পারলার ভেদে ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকায় কান ফোঁড়ানো যায়।

একসময় ছয় মাস বয়সেই মেয়েশিশুর কান ফুটো করে দেওয়া হতো। তখন বাড়িতেই নানি-দাদির হাতে সোনামুখি সুই দিয়ে কান ফোঁড়ানো হতো। বর্তমান সময়ে কিছুটা বড় হওয়ার পর এবং পারলারে গিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে কান ফোঁড়ানোর প্রবণতা বাড়ছে।

১০ বছর বয়স হওয়ার আগে কান ফোঁড়ানো ভালো নয়। কারণ, শিশুদের কানের বৃদ্ধির কারণে সঠিক জায়গাটি পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। আবার বেশি দেরি করাও উচিত নয়।

কান ফুটো করার সময়

যে শিশুর কান ফোঁড়ানো হবে, তাকে আগে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে। নয়তো সে ভয় পাবে বা কান্নাকাটি করবে। সে জন্য একটু বড় বা সচেতন হওয়ার পরই কান ফোঁড়ানো উচিত। 

কান ফোঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই কানে গোল্ড প্লেটেড বা ইমিটেশনের কানের দুল না পরানোই ভালো। অনেকের এতে অ্যালার্জি হতে পারে।

যে যন্ত্র দিয়ে কান ফোঁড়ানো হবে, তা যেন জীবাণুমুক্ত হয়। যদি বাড়িতেই কান ফোঁড়ানোর ব্যবস্থা হয়, তবে যে সুই দিয়ে কান ফোঁড়ানো হবে তা অবশ্যই গরম পানিতে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। ব্যবহৃত নয়, নতুন সুই ব্যবহার করতে হবে। একজনের ব্যবহৃত সুই আরেকজনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে না।

অভিজ্ঞ চিকিৎসকের হাতে বা পারলারে আধুনিক জীবাণুমুক্ত যন্ত্রের সাহায্যে কান ফুটো করাই সবচেয়ে ভালো।

যেদিন কান ফোঁড়ানো হবে, সেদিন বা তার আগের কয়েক দিন শিশুর জ্বর, সংক্রমণ বা অ্যালার্জি জাতীয় অসুস্থতা থাকলে ফোঁড়ানো পিছিয়ে দিতে হবে। শিশু সুস্থ হলে তারপর কান ফোঁড়াতে হবে।

কান ফোঁড়ানোর পর

বারবার কান স্পর্শ করা যাবে না। ভালো করে হাত ধুয়ে তারপর স্পর্শ করতে হবে। শিশুকেও এ বিষয়ে সচেতন করে দিতে হবে।

দিনে দুবার কানের সুতা বা দুল ঘুরিয়ে বা নাড়াচাড়া করে দিতে হবে। কাঁচা অবস্থা থেকে হিলিং হওয়ার সময় ওই স্থানে ফাইব্রোসিস হয়ে কানের ফুটো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বারবার নাড়িয়ে দিলে তা হবে না।

সেভলন বা ডেটল জাতীয় জীবাণুনাশক পানি দিয়ে দ্রবণ করে দিনে একবার কানের ফুটোর চারপাশে ভালো করে মুছে দিন। তাহলে ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

কান ফোঁড়ানোর পর লেবু, কমলা বা ভিটামিন সি আছে এমন খাবার খেতে দিন বেশি করে। এতে তাড়াতাড়ি ক্ষতস্থান শুকিয়ে যাবে।

যেসব খাবারে শিশুর অ্যালার্জি আছে, সেসব খাবার একেবারেই দেবেন না। চুলকানি হলে শিশু নখ দিয়ে চুলকাবে এবং সংক্রমণ হবে।

কাঁচা অবস্থায় ওই স্থানে নিজে বা অন্য কেউ হাত দেওয়ার আগে অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।

সংক্রমণ হলে

শরীরের সবচেয়ে নরম অংশ হলো কানের লতি। এতে কোনো হাড় নেই। তাই এখানে সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। যদি কানের লতিতে সংক্রমণ হয়, তবে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন। পুঁজ দেখা দিলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হবে।

ডা. জাহেদ পারভেজ

সহকারী অধ্যাপক, চর্ম, যৌন ও ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা