চলচ্চিত্রের ইতিহাস সঙ্গত কারণেই খুব বেশি দিনের নয়। আজ থেকে প্রায় ১১৭ বছর আগে (২৮ ডিসেম্বর, ১৮৯৫) প্যারিসের হোটেল ডি ক্যাফেতে অগাস্ট লুমিয়ের (১৮৬২-১৯৫৪) ও লুই লুমিয়ের (১৮৬৪-১৯৪৮) নামে দুই ভাই চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী করেন। এর আগেও প্রদর্শনী হয়তো হয়েছে। কিন্তু এটিই ছিল প্রথম সফল বাণিজ্যিক প্রদর্শনী। কিংবা বলা যেতে পারে এর আগের কোনও তথ্য আমাদের হাতে নেই। তাই এই সময়কেই চলচ্চিত্রের সূচনাবিন্দু ধরা হয়। তখন একে চলচ্চিত্র বা সিনেমা নয়, বায়োস্কোপ নামেই ডাকা হতো। ভারতীয় উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী হয় এর মাস ছয়েক পর ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই। লুমিয়ের ভাইদের একজন এসে মুম্বাই শহরের ওয়াটসন হোটেলে উপমহাদেশে বায়োস্কোপের প্রথম প্রদর্শনী করেন। ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় বায়োস্কোপের প্রদর্শনী হয়।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম বায়োস্কোপ প্রদর্শনী হয় কলকাতার ব্রেডফোর্ড বায়োস্কোপ কোম্পানির উদ্যোগে ১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল বাকেরগঞ্জ জেলার ভোলা মহকুমার (অধুনা ভোলা জেলা) এসডিওর (অধুনা ডিসি) বাংলোতে। ১৭ এপ্রিল বায়োস্কোপ প্রদর্শনী হয় ঢাকায় পাটুয়াটুলীর ক্রাউন থিয়েটারে। ক্রাউন থিয়েটারের অস্তিত্ব এখন আর নেই। এই বায়োস্কোপের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন চলচ্চিত্র ছিল।
শিশুদের উপযোগী কাহিনী কিংবা শিশুচরিত্রকে প্রাধান্য দিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রকে শিশুতোষ চলচ্চিত্র বলা হয়। স্বাধীনতার আগে ফজলুল হক পরিচালিত ‘সান অব পাকিস্তান’ (১৯৬৬) একমাত্র শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃত। অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীভিত্তিক এই চলচ্চিত্রটি সিনেমা হলে তেমন চলেনি। তবে বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার পরে ড. আশ্রাফ সিদ্দিকীর স্কুলপাঠ্য গল্প ‘গলির ধারের ছেলেটি’র চলচ্চিত্রায়ন করেন খ্যাতিমান পরিচালক সুভাষ দত্ত। ছোটদের জন্যে এটি নির্মিত হয়নি। কিন্তু দারিদ্র্যক্লিষ্ট এক কিশোরের জীবনকাহিনী বর্ণিত হওয়াই এটি শিশুকিশোরদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এরপর আরও অনেকগুলো শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ হলেও শিশুদের একান্ত নিজস্ব ভুবন নিয়ে কাহিনীর আবর্তন পুরো চলচ্চিত্রে অনুপস্থিত থেকে যায়। আসলে নির্ভেজাল শিশুতোষ চলচ্চিত্রের জন্য প্রয়োজন শিশুদের মনস্তত্ত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করা। তাদের চাওয়া-পাওয়ার গুঢ় রহস্য উদ্ঘাটনের অনন্য ক্ষমতা।
আজ আমরা তোমাদের মতো ছোটদের জন্য নির্মিত বাংলাদেশের শিশুতোষ চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব। শিশু মনস্তত্ত্বের জটিল দিকটি বিশেষভাবে উপলব্ধি করে শিশুদের মানসিক বিকাশ এবং নির্ভেজাল আনন্দ প্রদানের লক্ষ্যে শিশুদের উপযোগী করে নির্মিত চলচ্চিত্রকে শিশুতোষ চলচ্চিত্র বা শিশুচলচ্চিত্র হিসেবে অভিহিত করা হয়, সেটা আগেই জেনেছ। শিশুতোষ চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ বরার্ট বয় বলেন, ‘সেই ছবিই আদর্শ ছোটদের ছবি, যা দেখে ছোট ছোট দর্শক নিজেদের দেখতে পায়, আবিষ্কার করে, চিহ্নিত করতে পারে।’ শিশুতোষ চলচ্চিত্রের লক্ষ্য থাকবে শিশুর বিকাশ। ছবি দেখে শিশু নিজেকে নিয়ে ভাববে, আবিষ্কার করবে ভিন্নভাবে এবং প্রত্যয়ী হয়ে উঠবে। প্রকৃতপক্ষে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে শিশুদেরকে শিক্ষাদানের জন্য চলচ্চিত্র যেমন মহান শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে পারে তেমনি তোমাদের সুপ্ত বৃত্তি ও প্রতিভার উন্মেষ, মানসিক উন্নতি সাধন ও নির্মল আনন্দদানের ক্ষেত্রেও বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম। শিশু মনস্তত্ত্বাত্বিক কাহিনী, দৃশ্যপট ও সংলাপময় শিশুতোষ চলচ্চিত্রের কোনো বিকল্প নেই। শিশুমনের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশে চলচ্চিত্রের এই ব্যাপক প্রভাবকে উপলব্ধি করার পরপরই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নির্মিত হতে থাকে শিশুতোষ চলচ্চিত্র। এ ধরনের চলচ্চিত্র শুধু তোমাদের জন্যই নয়; বড়রা তোমাদের প্রতি কতটুকু যতœবান হবেন তারও একটি গুপ্ত ব্যাখ্যা দেয়া থাকে এই ধরনের চলচ্চিত্রে। অথচ যেভাবে আমাদের দেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্রের বিকাশ হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত বছরে একটি করেও যদি শিশু-কিশোরদের জন্য চলচ্চিত্র তৈরি হতো তাহলে ৪১টি চলচ্চিত্র পাওয়ার কথা। অথচ হিসেব করে দেখ এককের ঘরটিও এখনো আমরা পার করতে পারিনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকারি পর্যায়ে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। বলা হয় সরকারি অনুদানে তিনটি ছবির মধ্যে অবশ্যই একটি শিশুতোষ হতে হবে। হয়েছে কি? আদৌ তা হয়নি। ‘গলির ধারের ছেলেটি’র পর ১৯৮০ সালে সরকারি অনুদানে বাদল রহমান তৈরি করেন ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’। সরকারি অনুদানে এটিই বাংলাদেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র। এরপর ছুটির ঘণ্টা, ডুমুরের ফুল, দিপু নাম্বার টু, দূরত্বসহ হাতে গোনা কয়েকটি ছবি নির্মিত হয়। অথচ আজকের শিশুরাই আগামী দিনে জাতির ভবিষ্যৎ। সবাই বলে চলচ্চিত্র ব্যয়সাপেক্ষ। এই ধরনের ছবি বানিয়ে কেউ দেউলিয়া হতে চান না। অথচ তথ্যপ্রযুক্তিতে পৃথিবী অনেক এগিয়েছে। পশ্চিম প্রান্তের খবর পূর্ব প্রান্তে বসে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই আমরা পেয়ে যাই। সেখানে দ্রুত গতির চলচ্চিত্র সেই পুরনো ইতহাস নিয়েতো বসে থাকার কথা নয়। আজ চলচ্চিত্র নির্মাণে যোগ হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। নির্মাণ ব্যয় চলে এসেছে হাতের মুঠোয়; তারপরেও কিন্তু আমাদের দেশে ছোটদের জন্য চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে না। তাহলে টাকার অজুহাত পিছিয়ে থাকার কারণ কী? তারা আমাদেরকে অন্ধকারে রেখেই বিদেশী শিশুতোষ চলচ্চিত্রের নামে ফ্যাস্টিভ্যল করে অন্য কিছু শিখাতে চান।
প্রিয় বন্ধুরা, শিশুতোষ চলচ্চিত্রের এই দুর্দিনে ২০০৯ সালে তোমাদের জন্য তৈরি করা হয় দেশের প্রথম শিশুতোষ ডিজিটাল চলচ্চিত্র ‘দূরবীন’। আমাদের আজকের আলোচনা এই দূরবীনকে ঘিরেই।
তোমরা অনেকেই হয়তো ইতোমধ্যে ছবিটি দেখেছ একবার, দু’বার, বহুবার। ছবিটি দেখে হয়তো কেউ হেসেছ আবার কেউ কেঁদেছও। দেশের সকল প্রচার মাধ্যমে ছবিটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা হয়েছে। এমনকি দেশের বাইরেও বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ছবিটি নিয়ে খবর বেরিয়েছে। এই ছবিটির জন্য পরিচালক আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কারও অর্জন করেছেন।
আমরা এখন দূরবীনের গোড়া থেকে জানতে চেষ্টা করবো। প্রথমেই শ্যুটিং থেকে শুরু করা যাক। একটা সিনেমা বা ছবি তৈরি করার জন্য ৪টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। এগুলোকে বলা হয় প্রি-প্রোডাকশন, প্রোডাকশন, পোস্ট-প্রোডাকশন এবং ডিস্ট্রিবিউশন।
একটি ছবির ভালো-মন্দ নির্ভর করে প্রি-প্রোডাকশনের উপর। যার প্রি-প্রোডাকশনের কাজ ভালো হবে তার প্রোডাকশন মানে ছবিটিও ভালো হবে। সে জন্য পৃথিবীর সেরা চলচ্চিত্র পরিচালকদের দেখা যায় প্রি-প্রোডাকশনে অনেক সময় দিচ্ছেন। তোমরা যদি কেউ ছবি বানাতে চাও তাহলে প্রি-প্রোডাকশনটা ভালোভাবে মাথায় রাখবে। তো, দূরবীনের প্রি-প্রোডাশনের কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তার পরের বছর মানে ২০০৯ সালের ৬ ফেব্রয়ারি সকাল ১১টায় ক্যামেরা অন হওয়ার মাধ্যমে ছবিটি প্রোডাকশনে চলে যায়। পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ শেষ হয় অক্টোবরে। আর ডিস্ট্রিবিউশন শুরু হয় অক্টোবরেরই ২৯ তারিখে বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সেÑ শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে।
ভাবছো, কত সহজেই প্রি-প্রোডাকশন থেকে ডিস্ট্রিবিউশনে চলে এসেছি, এ আর এমন কঠিন কী কাজ! অথচ এর মাঝে চলে গেলো প্রায় ২টি বছর। অনেক পরিশ্রম অনেক ব্যয় অনেক সময় অনেক মেধা এরপর তৈরি হয় ৯০ অথবা ১২০ মিনিটের একটি ছবি। যা তোমরা মাত্র ৯০ অথবা ১২০ মিনিটেই দেখে শেষ করতে পারো। অথচ আসল কথা হচ্ছে ৮ ঘণ্টা শ্যুটিংয়ের পর ৬ মিনিটের সঠিক ফুটেজ পাওয়াও অনেক সময় কষ্টকর।
দূরবীনের পরিচালক জাফর ফিরোজ। বয়সে খুবই তরুণ, মনে তার শিশুসুলভ স্বপ্ন। সব সময় চিন্তা করেন তোমাদের নিয়ে। স্বপ্ন দেখেন তোমাদের জন্য কিছু করার। ওই যে বললাম, মনটা তার একেবারেই শিশুদের মতো! কল্পনা-চিন্তাগুলো সে কারণেই তোমাদেরকে নিয়ে আবর্তিত হয়। আর সেই স্বপ্ন ও কল্পনা থেকেই তোমাদের জন্য বানালেন ‘দূরবীন’। ছবিটির কাহিনী, চিত্রনাট্যও লিখেছেন তিনি। তোমরা যারা ছবিটি দেখেছ তারা সাঈফ স্যারকে মনে রেখেছ। ছাত্রদের কত প্রিয় সেই সাঈফ স্যার! বাস্তবেও ঠিক তাই। সেই সাঈফ স্যারই এই ছবির পরিচালক। শিশু বয়সের ভাবনা, দুরন্তপনা, অজানাকে জানার ইচ্ছা, শ্রেণী-বৈষম্য বিরোধী ভাবনা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, দেশপ্রেমÑ এসব নিয়েই ছবিটি বানিয়েছেন স্বপ্নচারী এই তরুণ পরিচালক।
দূরবীনের প্রযোজনায় রয়েছে জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠন অনুপম সাংস্কৃতিক সংসদ। পরিবেশনায় বাংলাদেশ ডিজিটাল ফিল্ম সোসাইটি। নির্বাহী প্রযোজক নিজামুল হক নাঈম। তিনি ছবিটির নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, চলচ্চিত্র অনেক বড় একটি শিল্প মাধ্যম। আর আমাদের প্রথম কাজটি শিশুদের জন্য করতে পারার জন্য আমরা আনন্দিত। দূরবীনকে সবাই যেভাবে সাদরে গ্রহণ করেছে এবং করছে তাতে মনে হয় শুধু শিশুদের জন্য নয়, সব বয়সের মানুষের জন্যই এই দূরবীন। আসলে আমরা দূরবীনকে সবার উপযোগী করেই বানিয়েছি। আশা করি পরবর্তী শিশুতোষ চলচ্চিত্রে ‘দূরবীন’ পথ নির্দেশকের ভূমিকা পালন করবে ইনশাআল্লাহ।
আচ্ছা বন্ধুরা, যাকে কেন্দ্র করে ছবিটি তৈরি হয়েছে অর্থাৎ যে শিশুটির জীবনাচার ও স্বপ্ন-কল্পনা এবং বাস্তবতা নিয়ে এর কাহিনী চিত্রিত হয়েছে, তার সাথেও একবার পরিচিত হয়ে নিলে কেমন হয়? ছেলেটির নাম লাবিব। ছবির প্রধান চরিত্র। ছবিটি দেখতে দেখতে তোমরা লাবিবের জন্য চোখের পানি ফেলেছ সেটা আমরা জানি। আবার লাবিবের পুরস্কার ও বৃত্তির খবরে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছ তাও জানি। এই জায়গাটিতে নিজেকে কখনোই ধরে রাখা যায় না। লাবিব তো দূরবীনের ছেলেটির নাম, প্রকৃত নাম আবু সায়াদ তামিম। বর্তমানে ও মতিঝিল মডেল হাই স্কুলের নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান ক শাখার ছাত্র। অষ্টম শ্রেণীতে সরকারি বৃত্তিপ্রাপ্ত তামিম জেএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাসও পেয়েছে।
তোমরা আজ প্রথম যারা দূরবীন সম্পর্কে পড়ছো ও জানছো, তারা নিশ্চয়ই এর কাহিনী সম্পর্কে জানতে চাইছো। ঠিক আছে, এবার দূরবীনের কাহিনীটা সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক। তবে যারা ইতোমধ্যেই ওটা দেখে ফেলেছ, তারা কিন্তু আবার মুখ গোমড়া করে ফেলো না। তোমার জানাটা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে তো তোমারই ভালো লাগবে।
লাবিবের মা নেই। বাবা বড় ব্যবসায়ী। সবসময় সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ছেলেকে দেয়ার মতো তার তেমন সময় নেই। বাড়ি, গাড়ি, দামী খেলনা কোনো কিছুর অভাব নেই লাবিবের। কিন্তু এসব ওর মনকে এতটুকু খুশি করতে পারে না। ও পাখি হয়ে স্বাধীনভাবে আকাশে উড়তে চায়। ঘাসের বুকে রঙিন পাখা মেলে উড়ে বেড়ানো ফড়িং বা প্রজাপতি ধরতে চায়। স্কুল থেকে বাড়ি আর বাড়ি থেকে স্কুলÑ নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা এই গোলকধাঁধা ওর একদম ভালো লাগে না। কিসের একটা প্রচণ্ড তৃষ্ণা ওর হৃদয়-মনকে আচ্ছন্ন করে রাখে সর্বদা। চাপা একটা চাওয়া-পাওয়ার মাঝখানে ওর মন নামক সুন্দর ভুবনটা ক্রমেই ছোট থেকে ছোটতর হতে থাকে। নিজের মধ্যে কেমন গুটিয়ে যায় ও।
এভাবেই কাটছিল দিন। এর মাঝেই একদিন ওর পরিচয় হয় সাঈফ স্যারের সাথে। সাঈফ স্যারের উপস্থিতি ওর জীবনে সূচনা করে এক নতুন দিগন্ত। সাঈফ স্যার হয়ে যায় ওর বন্ধু। যে কল্পনার রঙ মেখে স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়াত লাবিব, সেই রঙ বাস্তবে ওর জীবনে বয়ে আনে সাঈফ। সুযোগ পায় মুক্ত আকাশে ডানা মেলার।
এই ছবিতে আমরা একজন শিক্ষককে শাসক নয়, বন্ধু হিসেবে দেখতে পাই। শিক্ষক যে ছাত্রদের মানসিক বিকাশ ঘটাতে সক্ষম তা এখানে দৃশ্যমান। আমরা দেখতে পাই শিশু লাবিবের মানসিক বিকাশ ও জাতীয় শিশু অভিনয় প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার দৃশ্য, প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তিপ্রাপ্তির মতো আনন্দময় সুখবর। একজন স্নেহবঞ্চিত অমনোযোগী শিশুর পক্ষে এসব কিছুই সম্ভব হয় একজন স্নেহপরায়ন আদর্শ শিক্ষকের কারণে। এই ছবিটিতে আমরা দেখি লাবিব শিশু হলেও তার মাঝে মানবিক কিছু গুণ প্রতীয়মান। খাবার টেবিলে বসে ভাবছে এই বুঝি মা ওর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। অথচ তখন ওর পাশে শূন্য চেয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই। এই জায়গাটিতে এসে কেউ নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারে না। বিড়ালকে খাবার দিয়ে লাবিব বুঝিয়ে দেয় যে, সমাজে সবাই ভালোবাসার মাঝে বেড়ে উঠতে চায়।
শুধু লাবিব নয়, তার অন্য বন্ধুদের দায়িত্ববোধ চোখে পড়ার মতো। বন্ধুরা লাবিবের দুর্দিনে পাশে দাঁড়ায়। ছবিটিতে সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান। লাবিব মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে একপর্যায়ে লাবিবের বাবার ভুল ভাঙে। তিনি বুঝতে পারেন তার অমানবিকতা এবং ছেলের প্রতি অবহেলার বিষয়টি। তাই সাঈফ স্যার ও বন্ধুদের মাঝে ফিরিয়ে দেন লাবিবকে। লাবিব ফিরে পায় আপন ঠিকানা। ছবিটিতে তোমরা যে স্কুলটি দেখছ তা ঢাকার বিখ্যাত সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল। আর বাড়িটি বনানীর ১৩ নম্বর রোডের মমতা।
ছবিটি নিয়ে দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিরা চমৎকার সব মন্তব্য উপহার দিয়েছেন। সেসবের কয়েকটি তোমাদেরকে বলার লোভ সামলাতে পারছিনে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ ধরনের চলচ্চিত্র সুন্দর জাতি গঠনে বিশেষ অবদান রাখবে। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেন, শিশুদের মেধা বিকাশে শিশুতোষ চলচ্চিত্র কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। একান্তই শিশুদের কথা চিন্তা করে শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘দূরবীন’ নির্মাণ করায় এর কলাকুশলীকে অভিনন্দন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মাননীয় প্রতিমন্ত্রী ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী বলেন, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের কর্ণধর। শিশুদের সঠিকভাবে পরিচর্যার দায়িত্ব আমাদের সকলের। দূরবীন সে কাজটি করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সে সময়ের বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর চেয়ারম্যান শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, শিশুদের আকাক্সক্ষা নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র দূরবীন ভবিষ্যতের দূরকে স্পষ্ট করে দেখাতে পারে, মানুষে মানুষে দূরত্ব দূর করতে পারে। বাংলাদেশ ডিজিটাল ফিল্ম সোসাইটির চেয়ারম্যান (এ.সি) মোহাম্মদ আসাফ্ উদ্দৌলাহ্ বলেন, পৃথিবীর সব শিশুর মনে দূরবীন আলো ছড়াবে। শিশুদেরকে দেশপ্রেম, মহানুভবতা, আত্মত্যাগী ও সত্যভাষী হিসেবে তৈরি করবে এটা আমার বিশ্বাস। সেভ দ্যা চিলড্রেন অস্ট্রেলিয়ার কান্ট্রি ডিরেক্টর সুলতান মাহমুদ বলেন, I am very happy to know that ONUPOM has taken the task producing DURBEEN, the first ever digital children film in Bangladesh as far as my knowledge gose. I hope this film will help the people to realize about to take more responsibility to create an enabling environment for children to grow with their full potential. After watching this film the children will be very much curious in education. Congratulations the young people who are working in this field and we are always with you. জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ বাংলাদেশের সিনিয়র অফিসার সাইদ মিলকী মনে করেন এই ছবিটি তৈরি করা হয়েছে ছোট-বড় সবার জন্য। বিশেষ করে শিক্ষকদের জন্য এই ছবিটিতে অনেক মেসেজ রয়েছে। মেসেজ রয়েছে বাবা-মায়ের জন্যও। এখন সময় হয়েছে ছবিটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করার। চলচ্চিত্র পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম দূরবীন নিয়ে এতো বেশি-ই আশাবাদী, তিনি মনে করেন মার্জিত ও রুচিবোধের ছবি দূরবীন। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন মনে করেন, শিশুরা ফুলের মতো। আর যারা এই ফুলের সংস্পর্শে আসে তাদের কাছ থেকে ফুলের সুবাসই প্রত্যাশা করা যায়। দূরবীনের মাঝে সেই ফুলেরই ঘ্রাণ। দূরবীন অসাধারণ একটি ছবি। বিখ্যাত টিভি ব্যক্তিত্ব মাহবুবুল আলম গোরা মনে করেন দূরবীনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুস্থ সুন্দর চলচ্চিত্রের বীজ বপন হল। এখন অপেক্ষা সুন্দর চলচ্চিত্রের জয়গানের। বাংলাদেশ ডিজিটাল ফিল্ম সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান (এ.সি) মো: দেলাওয়ার হোসেন বলেন, দূরবীন শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সকল শিশুদের মনের খোরাক যোগাবে। চিত্রনায়ক শেখ আবুল কাশেম মিঠুন বলেন, দূরবীন দূর দেখাচ্ছে বাংলাদেশের শিশুতোষ চলচ্চিত্রের। বাংলাদেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্র অনেক তৈরি হবে সে পথ দূরবীনই বাংলাদেশকে প্রথমে দেখিয়েছে।
দূরবীনে দু’টি গান রয়েছে অসাধারণ। মা শিরোনামে গানটি লিখেছেন পরিচালক নিজেই। সুর করেছেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আমিরুল মোমেনীন মানিক। শিশু শিরোনামে গানটি লিখেছেন আবু তাহের বেলাল। সুর করেছেন গোলাম মাওলা। মা গানটি শুনে কারো অশ্রু ঝরেনি এমনটি হয়নি। এই গানটি শুনলে মনে হয় মা কতো বড় সম্পদ। অথচ আমরা মাকে কতো জ্বালাতন করি। শিশু গানটি শিশুদের অধিকার নিয়ে। গানটির কথা এই রকমÑ “প্রতিটি শিশুরই সুকোমল মন সুবাসিত ফুলের মতন/পৃথিবীতে তারা আনবে ফাগুন করো যদি সোহাগ যতন…।”
গত ৪ আগস্ট ২০১২ সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাব ভিআইপি লাউঞ্জে হয়ে গেল ছবিটির ডিভিডি রিলিজ অনুষ্ঠান। মার্কেটিং-এ রয়েছে সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ (সসাস)। এখন বসুন্ধরা সিটিসহ যে কোনো ডিভিডি দোকানে ছবিটি পাওয়া যাবে।
ছবিটিতে আরো যারা অভিনয় করেছেনÑ প্রফেসর কাজী অখতারুজ্জামান, মাহবুব মুকুল, ফারুক খান, আবদুল্লাহিল কাফি, ফেরদৌস কামাল, আমান, সাইফুল্লাহ, বান্না, আফনান, ইব্রাহিম, ফয়সাল, প্রান্ত দাস, শান্ত, উইলিয়াম, তারিক, তুহিন, রুবিনা, মেহেদী হাসান ও বিশেষ একটি চরিত্রে কবি আবদুল হাই শিকদারসহ আরো অনেকে। ছবিটির ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি হীরা আজাদ, সম্পাদনায় সামসুল আলম, মিউজিক করেছেন পারভেজ জুয়েল, প্লেব্যাকে আমিরুল মোমেনীন মানিক, টুম্পা দাস ও আবদুল্লাহ বিন ফায়েজ। গ্রাফিক্স তাওহিদ ও শাহিদী।
সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার স্নেহ ভালোবাসা, পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা এবং শিক্ষক-ছাত্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছবিটিকে করেছে অমূল্য। ছবিটি বিনোদনের পাশাপাশি মানবিক ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন হওয়ার শিক্ষা দেয়।
Comments are closed.