আবার কি কখনো দেখা হবে?তারিখটি ঠিক মনে পড়ছে না। তবে এতটুকু মনে আছে তখন আমরা দশম শ্রেণির প্রায় মাঝের দিকে। বিকেলবেলা আমরা কয়েকজন মিলে বের হোলাম। গন্তব্য শুরুতে ঠিক না করায় কিছুটা সমস্যা হয়েছিল। তবে পরে উদ্দেশ্য ছাড়াই হাঁটতে শুরু করলাম।কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা চলে গেলাম নদীর পাড়ে। জায়গাটা বেশ ছিমছাম। দেখলেই যেন মন জুড়িয়ে যায়।আমদের গন্তব্য না থাকলেও কিভাবে যেন আমরা সবসময়ই ওই জায়গাটাতেই পৌঁছে যেতাম। সেদিন গিয়ে ভাল একটি জায়গা বেছে বসলাম। তারপর আমাদের গল্পের আর শেষ নেই।
এরই মধ্যে আমাদের মন জোড়ানো হাসি শুনে অনেকে হয়তো একটু অন্যভাবে তাকিয়েও ছিল। আমাদের তাতে কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। কিছুক্ষণ পর আমাদের সামনে দিয়ে এক বাদামওয়ালার আনাগোনা দেখতে পেলাম। আমাদেরই একজন তাকে থামাল।তারপর তার সাথে গল্প করা শুরু করলাম। – তোমার নাম কি? – আমার নাম শাকিল – বয়স কত তোমার? – আমারে দেইখা মনে হয় অনেক কম বয়স। কিন্তু আমি অন্নেক বড়। আমার বয়স ও অনেক। – তা কত হবে শুনি? – হবই তো ভাই। আপনেগর সমানই -ও। বাদাম বিক্রি কর তুমি? বাসা কোথায় তোমাদের? – হ ভাই, বাদামই বেঁচি।আমি থাকি ওই চরের ওইদিকে।
আসলে কোথায় জায়গাটা না বুঝেই কথাবার্তা চালিয়ে গেলাম। -আইচ্ছা ভাই, বাদাম নিলে লন। নাইলে যাইগা। -আরে দাঁড়াও। কথা বলি। তারপর তার সাথে অনেক কথা বলা হলো। অনেক মজা করাও হলো। -আইচ্ছা ভাই। আমি যাই। পরে যাওয়ার সময় দেহা হইবার পায়। -আচ্ছা যাও। কিছুক্ষণ পর… – ভাই, আপনেরা এহনো যান নাই? – আছি। একটু পরেই যাব। তোমার বাদাম বেঁচা কেমন হলো। -হইল আর কি কোন রকম। আইচ্ছা যাই। তারপরের দিন আমরা আবারও নদীর পাড়ে গিয়ে হাজির।
এবার আমরা সংখ্যায় একটু কম ছিলাম।আর সেদিনো শাকিল এসেছিল। – ভাই আপনেরা আইজও আইছেন? -হুম। আসলাম। তোমার সাথে কথা বলি। -আগে বাদাম বেইচাঁ আহি। তারপর আমরা নিজেদের মত গল্প জুড়ে দিলাম আবার। এর মাঝেই হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা দূরে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি শাকিল ওইখানটাতেই বাদাম বিক্রি করছে। তারপর তাকে না ডাকতেই সে আমাদের কাছে আসলো।আমরা তার কাছে থেকে বাদাম নিলাম। তারপর আবার গল্প জুড়ে দিলাম ওর সাথে। ছেলেটার বয়স বেশি হবে না। বড়জোড় বারো হতে পারে।
কিন্তু সে তাকে আমাদের সমানই ভেবে নিয়েছিল। আমরাও তার সাথে অনেক মিশে গিয়েছিলাম। তারপর তার সাথে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। এরপর তাকে বিদায় দিয়ে চলে গেলাম যার যার গন্তব্যে। এরপরের দিন আবারো আমরা নদীর পাড়ে হাজির। কিন্তু এখন আমাদের সংখ্যা কমে ৩ এ নেমে এসেছে। ছেলেটা সেদিনো হাজির আমাদের সামনে। সে দিনটি ছিল ওই ভ্যাকেশান এর শেষ দিন। -শাকিল, কাল আর আমাদের দেখতে পাবে না – হুর মিয়া। মজা লন! – না.. সত্যি সত্যি। – কই যাবেন? – এক এক জন এক এক জায়গায় নিজেদের তাগিদে চলে যাবে।
কেউ যাবে রাজশাহী, কেউ যাবে পাবনা। আর সিলেটের কয়েকজন তো চলেই গিয়েছে। ও তখনো তা মেনে নিতে পারেনি। – হুর মিয়া। মজা করেন কেন! কই যাবেন! একজন যাব সিংগাপুর, আরেকজন কই! – না সিংগাপুর না। আমরা সত্যি ই আর কাল থেকে আসতে পারব না। – ও… কবে আইবেন আবার। – ডিসেম্বর মাসের দিকে আসব। তুমি আবার এসো। দেখা হবে। – আইচ্ছা ভাই। আমি আসমু সমস্যা নাই…ভালা থাইকেন। – হুম। তুমিও ভাল থেকো। এভাবেই চলে গেলাম আমরা সবাই। শাকিলের সাথে যে সম্পর্কটি গড়ে ওঠেছিল তা সত্যিকার অর্থেই ভোলার নয়।
ক্যাডেট কলেজে গিয়েও তার কথা মনে পড়ত। মনকে বোঝাতাম হয়তো ডিসেম্বরে তো দেখা হবেই। ডিসেম্বর এলো। আমরা ভ্যাকেশান পেলাম।শুরুর দিনটাতেই নদীর পাড়ে গিয়ে শাকিলের সাথে দেখা করার ইচ্ছে ছিল। আমাদের এক বন্ধু জামালপুর এই ছিল। ও আবার আমাদের আসার আগের দিন নদীর পাড়ে গিয়েছিল। কিভাবে যেন শাকিলও সেদিন সেখানে হাজির। – ভাই…আপনে একলা কেন। বাকি ভাইরা কই? – আসবে। ওরা কালকেই আসবে। এরপর…আসার দিনটিতে যেতে পারিনি। কিন্তু গিয়েছিলাম তার পরের দিন। গিয়ে আর শাকিলকে পেলাম না। একটা জিনিস বুঝি নি।
আমরা বলেছিলাম ডিসেম্বর এ আসব। কিন্তু আমরা বলিনি কবে আসব। তাহলে সেদিন আমাদের বন্ধুর সাথে দেখা হলো কিভাবে!এটা কি কাকতালীয় নাকি ও প্রতিদিন আসতো আমাদের জন্য?? এভাবে প্রশ্ন করেই ভাবতে লাগলাম। এরপর আরো কয়েকটা দিন গিয়েও তার দেখা আর পেলাম না। এভাবে ওই ভ্যাকেশান টা শেষই হয়ে গেল। কলেজ এ গিয়ে এ গল্প চাপা রাখতে না পেরে ওয়াল ম্যাগাজিন এর টপিক হিসেবে জমা দিলাম। সেটা সিলেক্টও হয়েছিল।
কিন্তু পুরোটা বর্ণনা করতে গিয়ে বড় হয়ে যাওয়াও শেষমেশ তা বাতিল হয়ে যায়। এভাবেই ব্যাপারগুলো মাঝে মাঝেই মনে পরতো। আরো কয়েক ভ্যাকেশান এ গিয়েও তার আর কোন দেখা পাইনি। একবার তার মতই একজনকে জিজ্ঞেস করে -(তারা তাকে চেনে) এ পর্যন্তই। এখনো তার সাথে আর দেখা হয়নি। জানি না এখন দেখা হলে চিনবে কিনা। কিন্তু এটা বলতে পারি সে হয়তো এখনো আমাদেরকে ভোলে নি।
হয়তো মনে করিয়ে দিলেই চিনে যাবে। গল্পটিতে যা বলা হয়েছে সত্যি আমাদের জীবনেরই কথা। জানি না এই করোনা ভাইরাস এর মহামারি তে তারা কেমন আছে। জানি না তাদের পরিবার কেমন আছে। জানি না আবার কখনো দেখা হবে কিনা।
– সিরাজুস সালেহীন
৫/৪/২০২০
Comments are closed.