নাসরিন সুলতানা
একটা শিশু যখন পৃথিবীতে আসে তখন তার বাবার পরিচয় সবাই নাও জানতে পারে কিন্তু মায়ের পরিচয়টা সবাই জানে। কারণ সে মায়ের গর্ভে থেকে মানবশিশু হয়েছে, মায়ের পেট থেকেই পৃথিবীতে এসেছে। মায়ের গর্ভে থাকা অব¯থায় সে লক্ষ করেছে তার মায়ের সাথে কে কী রকম আচরণ করে। পৃথিবীতে আসার পরেও তার স্মৃতিতে সেগুলো থেকে যায়। যারা তার মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে তাদের কোলে গেলে শিশু কাঁদে। কারণ সে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শিশু যখন কাঁদে তখন তার মা তাকে কোলে নেন। তার কান্না থেমে যায়। মহান সৃষ্টিকর্তার এ এক অসাধারণ কৌশল। তার মায়ের শত্রু তাকে কোলে নিয়ে দূরে চলে গেলে তার ক্ষতি হতে পারে, সে হারিয়ে যেতে পারে, এমন কী তার মৃত্যুও হতে পারে। শিশুর জীবনে মা ও শিক্ষকের প্রভাব অনেক।মায়ের গর্ভে থাকাকালীন মা যে পরিমাণ ঝাল খেতেন সে পরিমাণ ঝালে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। মা যদি কখনও অতিরিক্ত ঝাল খেয়ে ফেলেন, পেটের মধ্যে সে ছটফট করে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরেও মা কোনোদিন অতিরিক্ত ঝাল খেলে শিশু কাঁদে, মলত্যাগের সময় বেশি কাঁদে। কারণ তার মলদ্বারে জ্বালা-পোড়া হয়। মা লালশাক খেলে শিশুর মল লাল হয়। শিশুর সাথে মায়ের যে সম্পর্ক তা আর কারো সাথে হয় না। গর্ভাব¯থায় মায়ের আচরণ ভালো হলে শিশুর চরিত্র ভালো হয়। প্রতিটা ক্ষেত্রে শিশু মাকে অনুসরণ করে। মাকে চুরি করতে দেখলে শিশু চোর হয়, মাকে মিথ্যে কথা বলতে দেখলে শিশু মিথ্যুক হয়। মা যদি শিশুকে খারাপ কাজ শেখায় শিশু প্রতিবাদ করতে পারে না। এই ধরণের শিশু বড় হয়ে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় মাকে।
শিশু যখন বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তখন সে অন্য একটা জগতের সাথে পরিচিত হয়। একজন শিক্ষকের সাথে সে আড়াই ঘণ্টা থাকে। তার একটা প্রভাব শিশুর উপরে পড়ে। শিক্ষক যদি প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির জন্য নির্ধারিত পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সঠিকভাবে অনুসরণ করেন তাহলে শিশু অবশ্যই তাকে ভালোবাসবে। কারণ প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষাক্রমটাই এমনভাবে তৈরী যে শিক্ষক ও শিক্ষালয়ের প্রতি তার মনে একটা আকর্ষণ সৃষ্টি হবে। সে বিদ্যালয় বন্ধ দিয়ে বেড়াতে যেতেও পছন্দ করবে না। বরং বিদ্যালয় বন্ধ থাকলে সে খোলার অপেক্ষায় থাকবে। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির আসল উদ্দেশ্যই হচ্ছে শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করা। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষক যদি অসৎ হন তাহলে তিনি সরকারি নিয়ম উপেক্ষা করে যতদূর সম্ভব নিজের মতো করে চলবেন। ইংরেজি শেখাবেন, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মসূচি অনুযায়ী পরীক্ষা নিবেন ইত্যাদি। তাতে বিদ্যালয়ের প্রতি শিশুদের আকর্ষণ কমে যাবে। অভিভাবকরা জানেন না কেন তার শিশু বিদ্যালয়ে যেতে চায় না। তারা শিক্ষককে বলেন, পড়া আদায় করবেন, তাতে যত মার দিতে হয় দিবেন, একটুও প্রশ্রয় দিবেন না, আমি চাই আমার বাচ্চা পড়া শিখুক। এই ধরণের শিক্ষক ও মায়ের কাছে শিশুমনোবিজ্ঞান বা উচ্চতর শিক্ষামনোবিজ্ঞানের সব কথা অর্থহীন।
প্রাথমিক স্তরের শিশুরা কাদা মাটির মতো। তাদেরকে শিক্ষাক্রম অনুযায়ী গড়ে তোলা যায়। শিক্ষক যদি বলেন, আমাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমি তোমাদের পরিবারের অন্যসব মানুষের মতোই একজন মানুষ, যে কোনো কথা আমাকে বলতে পার, আমি কোনোদিন তোমাদেরকে মারব না, তাহলে অসৎ শিক্ষক ও মায়েরা মনে করেন যে এই শিক্ষক শিশুর জীবন নষ্ট করে দিবে, প্রত্যেক পিরিয়ডে গান গায়, এটা-ওটা করে, একে স্কুল থেকে তাড়াতে হবে। তার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ সাজায় এবং সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে মিথ্যে শেখায়। একজন ভালো মানুষ কখনও কাউকে অভিশাপ দেন না। তার কষ্টটাই অভিশাপ হিসেবে লেগে যায়। শিক্ষকের অভিশাপ মা-বাবার অভিশাপের চেয়ে কম নয়। এটা সবাই বোঝে না। তাদের ধারণা হচ্ছে শিশু অবশ্যই শিক্ষককে ভয় পাবে, শিক্ষক শিশুকে না মেরে পড়া আদায় করতে পারবেন না। মারতে তো হবেই, তারপরেও যদি না পারে তাহলে বাসা থেকে বিভিন্ন খাবার-দাবাড় এনে শিক্ষকদেরকে খাওয়ালেই পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া যাবে। যেভাবেই হোক, শ্রেণিতে প্রথম ¯থান রাখা চাই।
যে শিশু পড়াশোনায় ভালো, নিয়মিত স্কুলে যায় তাকে শিক্ষকরা অবশ্যই ভালোবাসবেন। কোনো কারণে যদি শিক্ষক তার গায়ে হাত তোলেন সেটা সে আজীবন মনে রাখে। ঐ শিক্ষককে সে কোনোদিন শ্রদ্ধা করতে পারে না। শিক্ষককে সব সময় চেষ্টা করতে হবে শিশুর মনের কাছে যাওয়ার, শিশু যেন শিক্ষককে তার পরম বন্ধু মনে করে, যে বিষয়টা সে বোঝে না সেটা যেন নির্ভয়ে শিক্ষককে বলতে পারে। এ রকম একজন শিক্ষকই আদর্শ শিক্ষক। তাকে কোনো পদক দেওয়া না হোক কিংবা দিয়েও কেড়ে নেওয়া হোক, অসৎ মা ও শিক্ষকরা তার সম্পর্কে যত অপপ্রচার করুক তাতে তার কিছু আসে-যায় না। শিশু যদি একবার তাকে চিনতে পারে তাহলে সে তার অসৎ মা ও শিক্ষকদেরকে আজীবন ঘৃণা করবে। একজন মা বা শিক্ষকের জীবনে এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর নেই। এমনও হতে পারে, ঐ শিশুর আর পড়াশোনাই হলো না। কারণ তার জীবনে শিক্ষক বা মায়ের প্রতি ঘৃণা একটা বিরাট ব্যাপার। শিক্ষক বা মাকে ভালোবাসতে না পারলে কোনোকিছুতেই সে মন দিতে পারে না।
খারাপ লোকের সংখ্যা বেশি। তাদের মনোবল কম। খারাপ লোকেরা সব সময় জোট বাঁধে। জোটই তাদের শক্তি। ভালো মানুষকে খারাপ প্রতিপন্ন করার জন্য তারা আদাজল খেয়ে লাগে। স্বার্থ আদায়ের জন্য তারা যত নিচে নামতে হয়, নামে। খারাপ শিক্ষকরাও এর বাইরে নয়। তারা মনে করে, সবাই মিলে একটা মিথ্যে বললে সেটা সত্যি হয়ে যাবে। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে আল্লাহ বলে একজন আছেন। একজন মানুষ যখন মিথ্যে বলে তখন তার মুখের দুর্গন্ধে কাঁধের ফেরেশতা নেমে যায়। দূরে গিয়ে তাকে অভিশাপ দেয়। ফেরেশতার অভিশাপ আল্লাহ কবুল করেন।
একটা নিষ্পাপ শিশু শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য প্রথমেই আসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেই শিশুটাকে অক্ষর লেখা থেকে শুরু করে এমন একজন শিশুতে পরিণত করতে হয় যাতে সে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি না হলেও নিজের কাজটা নিজে করতে পারে। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে একটা শিশু আত্মনির্ভরশীল হতে পারে। লেখা, পড়া, বলা, ক্যালকুলেটর চালানো, কম্পিউটার চালানো, বাজার করা, ব্যাংকের সাথে লেন-দেন করা, ধর্মীয় নিয়ম-কানুন মেনে চলা, স্বা¯থ্যবিধি, প্রাথমিক চিকিৎসা, সাহিত্য, সংগীত, শারীরিক শিক্ষা, দেশপ্রেম, চারু ও কারুকলা, মোট কথা এমন কোনো বিষয় নেই যা সে শিখবে না। শিক্ষার মধ্য দিয়েই তৈরী হয় শিশুর চরিত্র। শিশুর চরিত্র গঠনে মা ও শিক্ষকের প্রভাব অপরিসীম। তাদের ভুলের জন্য শিশুর জীবন যেন নষ্ট হয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।