একটি দেশ ও সে দেশের জাতি, ভাষা, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি অর্থাৎ এক কথায় সে দেশের অস্তিত্ব বহন করে সে দেশের বিরল প্রতীক জাতীয় পতাকা। বাঙ্গালির জীবন ও ইতিহাসে অর্জিত সম্পদগুলোর কথা বলতে গেলে যেটির প্রতিচ্ছবি সর্বপ্রথম চোখের সামনে ভেসে উঠে সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের গৌরবের অনন্য প্রতীক- বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। প্রায় ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে যা আমরা অর্জন করেছিলাম ১৯৭১ সালে। তবে বর্তমান যে পতাকাটি আমরা সর্বত্র দেখি তা আগে কিন্তু ঠিক এরকম ছিলো না। আসুন, জেনে নিই কীভাবে এলো বাংলাদেশের পতাকা ও পতাকার নকশা পরিবর্তনের নেপথ্যের ইতিহাস।
বাংলাদেশের পতাকা তৈরির সিদ্ধান্তঃ
বাংলাদেশের পতাকার নকশা কিন্তু করা হয়ে গিয়েছিলো স্বাধীনতার কিছু আগেই। বাংলাদেশের প্রথম পতাকাটির নকশা ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ সংগঠনের কিছু কর্মী ও ছাত্রনেতারা করেছিলেন। যুদ্ধের নয় বছর আগে ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে তিন ছাত্রলীগ নেতা- সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ মিলে পরিকল্পনা করলেন একটা গোপন সংগঠন বানাবেন। যার নাম ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ তবে, গোপনে তারা নিজেদের দলের নাম রেখেছিলেন নিউক্লিয়াস। যা বহুদিন অজানাই ছিলো। ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে এই তিন সদস্যকে নিয়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াসের হাইকমান্ড গঠন করা হলো।
১৯৭০ সাল, ৭ই জুন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে শ্রমিক জোটের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানানো হবে। এ আয়োজনে বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তানের একটি আলাদা পতাকা তুলে দেয়ার পরিকল্পনা করে ’নিউক্লিয়াস’। এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী, মতান্তরে ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ গঠন করা হয়।
সে লক্ষ্যে ৬ জুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হল) ১১৬ (বর্তমান ১১৭-১১৮) নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা কাজী আরেফ আহমদ, আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, মার্শাল মনিরুল ইসলাম, ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ন দাশ, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ এক বৈঠকের আয়োজন করেন।
বাংলাদেশের পতাকার প্রথম নকশাঃ
সেখানে সবার সম্বলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে আলোচনা শেষে সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে সোনালী পাটের প্রতীক হিসেবে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকার নকশাটি চূড়ান্ত হয়। এই বাংলাদেশের মানচিত্রটি একটি বিশেষ কারণবশত পতাকায় যোগ করা হয়।
কাজী আরেফ আহমেদ সাহেব, কামরুল আলম খান (খসরু) সহ আরো দুজনকে নিউমার্কেটের বজলুর রহমান লস্করের “অ্যাপোলো” নামক দোকানে পাঠান। গাঢ় সবুজ ও গাঢ় লাল রঙের কাপড় নিয়ে তারা বলাকা ভবনের পাক ফ্যাশনের মালিকের কাছে রাত প্রায় ১২ টার দিকে যায়। তিনি বিহারী ( অবাঙালী ) ছিলেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে সকল কর্মচারীদের বিদায় করে বিনা পারিশ্রমিকে নিজেই ঐ নকশা অনুযায়ী সবুজ কাপড়ের মাঝে লাল একটি বৃত্ত সেলাই করে পতাকা তৈরী করে দেন।
এরপর ইউসুফ সালাউদ্দিন আহমেদ ও হাসানুল হক ইনু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমান বুয়েট) কায়েদে আজম হল (বর্তমানে তিতুমীর হল)-এর ৩১২ নং কক্ষের এনামুল হকের কাছ থেকে মানচিত্রের বই নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকেন পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। কুমিল্লা ছাত্রলীগের সভাপতি শিবনারায়ণ দাশ এই ট্রেসিং পেপার থেকে কাপড়ে মানচিত্র এঁকে দিয়েছিলেন। তিনি হলুদ রং এবং ম্যাচের কাঠি ব্যবহার করে মানচিত্রটি পতাকার লাল বৃত্তের মাঝে আঁকলেন। মানচিত্রের ওপর দিলেন সোনালী রঙ।
বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলনঃ
১৯৭১ সালের ২রা মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়, কলা ভবনের সামনের পশ্চিম গেটেই বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ছাত্রনেতা ও ‘ডাকসু’র তদানীন্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট আ স ম আবদুর রব। এ সময় অন্যান্য ছাত্রনেতা ও কর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের চিহ্ন ‘চাঁদ’ তারা ব্যবহার না করার জন্য নতুন এই প্রতীক তৈরী করা হয়েছিল।
‘সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যক্টবুক’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি বুঝাতে পতাকায় সবুজ রং ব্যবহার করা হয়েছিল। তৎকালীন পতাকাটি তাই ছিলো উজ্বল সবুজে বিরাজমান লাল বৃত্তের মাঝে বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব বাংলা) এর মানচিত্র। অতঃপর মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে ২৩ শে মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এর বাসভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে সরকারিভাবে গৃহীত হয়।
পতাকার মাঝে মানচিত্র কেন?
কাজী আরেফ আহমেদের ‘বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র’ বই থেকে জানা যায়- ৬ জুন ৭০ সালে নিউক্লিয়াস-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্ল্যাগ তৈরির কথা জানা যায় ও এই ফ্ল্যাগ পরবর্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। তখন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি) ও আসম আবদুর রব বলেন যে, এই পতাকার জমিন
অবশ্যই বটলগ্রিন হতে হবে। শাজাহান সিরাজ বলেন যে, লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকতে হবে। বটলগ্রিন জমিনের উপর প্রভাতের লাল সূর্যের অবস্থান।
তারপর পতাকার এই নকশা ‘নিউক্লিয়াস’ হাইকমান্ডের অনুমোদন নেয়া হয়। তখন কাজী আরেফ আহমেদ প্রস্তাব করেন, এই পতাকাকে পাকিস্তানি প্রতারণা থেকে বাঁচাতে হলে লাল সূর্যের মাঝে সোনালী রঙের মানচিত্র দেয়া উচিত। কারণ, প্রায়ই বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভারতের হাত আছে বা ভারতীয়দের অনুপ্রবেশ হচ্ছে অথবা ভারতীয় এজেন্টদের কার্যকলাপ বলে প্রচারণা চালায়।
তাছাড়া এই সময় ইউনাইটেড স্টেটস অফ বেঙ্গল বা বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র নামের কাল্পনিক একটি দেশের জন্ম দেয়া হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যসহ পূর্ব পাকিস্তান ও মায়ানমারের আরাকান রাজ্যসহ এই কল্পিত ইউনাইটেড স্টেটস অফ বেঙ্গল-এর মানচিত্র তৈরি করে বাঙালির স্বায়ত্বশাসনের দাবিকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সরকারি প্রশাসন ষড়যন্ত্র বলে তা বিলি করত। এই ধরনের প্রচারণা থেকে পতাকাকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের সোনালী আঁশ ও পাকা ধানের রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র পতাকার লাল সূর্যের মাঝে রাখার প্রস্তাবে সবাই একমত হয়।
এছাড়াও সে সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত স্লোগান ছিলোঃ “জয় বাংলা”। সে ক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, যে কোন বাংলার কথা বলা হচ্ছে? পূর্ব বাংলা, পশ্চিম বাংলা নাকি দুই বাংলাই? তখন সিদ্ধান্ত হয় পতাকায় দেয়া থাকবে তৎকালীন পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) এর ভূমি প্রতিকৃতি তথা মানচিত্র। মজার ব্যাপার হলো দেশ স্বাধীন হলে যে ঐ মানচিত্রের প্রয়োজন হবে না সে সিদ্ধান্তটিও ওখানে নেয়া হয়েছিলো- যা কিনা পরবর্তীতে পটুয়া কামরুল হাসানের নকশা করা পতাকার (বর্তমান পতাকা) ক্ষেত্রে সত্যি হয়েছিলো।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাঃ
স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিবনারায়ণ দাশের ডিজাইনকৃত পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ ও তার ব্যাখ্যা সম্বলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলে পটূয়া কামরুল হাসানকে। সবুজ রং বাংলাদেশের সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্যের প্রতীক, বৃত্তের লাল রং উদীয়মান সূর্য, স্বাধীনতা যুদ্ধে
আত্মোৎসর্গকারীদের রক্তের প্রতীক। তাই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় সবুজ আয়তক্ষেত্রের মধ্যে লাল বৃত্ত।
পতাকায় ১০:৬ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তক্ষেত্রাকার সবুজ রঙের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত থাকবে। লাল বৃত্তটি পতাকার দৈর্ঘ্যের এক-পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট হবে। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার এই রূপটি ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সরকারীভাবে গৃহীত হয়। কামরুল হাসান দ্বারা পরিমার্জিত রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
বর্তমান পতাকায় বাংলাদেশের মানচিত্র বাদ যাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- পতাকার দুই দিক থেকে মানচিত্রটি সঠিকভাবে দেখা যাবে না। পতাকার দুইদিকে মানচিত্রের সঠিক উপায়ে সেলাই নিয়ে জটিলতা হবে। চিত্রশিল্পী ব্যতিত অন্যদের পক্ষে পতাকা আঁকা কঠিন হয়ে যাবে। লাল বৃত্তটি একপাশে একটু চাপানো হয়েছে, পতাকা যখন উড়বে তখন যেন এটি পতাকার মাঝখানে দেখা যায়।
মূলত শিব নারায়ন দাসই বাংলাদেশের পতাকার প্রধান ডিজাইনার। সেটাকে সামান্য পরিবর্তন করেন কামরুল হাসান। তবে যেহেতু বর্তমানে মানচিত্র খচিত পতাকা ব্যবহার করা হয় না তাই বর্তমান পতাকার ডিজাইনার হিসেবে কামরুল হাসানকে বলা হয়ে থাকে। মুক্তিযুদ্ধকালীন পতাকার ডিজাইনার হিসেবে শিব নারায়ন দাসের নাম উল্লেখ থাকে।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ইতিহাসটা আবেগের। এই পতাকা পুরো দেশকে ধারণ করেছে তার বুকে।
আরো পড়ুন