লেখকঃ জাজাফী
বিকেল গড়িয়ে তখনো সন্ধ্যা নামেনি।প্রচুর বইপ্রেমীদের ভীড় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে বইমেলায়।সিসিমপুরে তখন হালুম,টুকটুকি আর ইকরিকে নিয়ে মেতে উঠেছে রাজকন্যা রাজপুত্ররা।ক্ষুদে পাঠক কিংবা দর্শক যাই বলিনা কেন ওই শিশুরাই মাতিয়ে রাখে গোটা প্রাঙ্গন আর যখন হালুম তার লেজ নাড়াতে নাড়াতে মঞ্চে আসে তখন সবার মধ্যে সে কি উত্তেজনা।তবে আরো অনেকেই আছে সিসিমপুরের আনন্দকে পাশকাটিয়ে বইয়ের মধ্যে আনন্দ খুঁজতে ব্যাস্ত।তেমনই এক ক্ষুদে পাঠক ইবন। ইবনের প্রায়ই বইমেলায় যাওয়া হয়।ছোট্ট ইবন বই কিনতে এবং বই পড়তে ভালোবাসে।তার থেকেও বেশি ভালোবাসে লেখকের অটোগ্রাফ নিতে।বইমেলার সতের তম দিনে গুটিগুটি পায়ে ইবন এসে দাড়ালো ঐতিহ্য প্রকাশনীর সামনে।বেশ কিছু বই সে নেড়েচেড়ে দেখলো,পাতা উল্টিয়ে ফ্ল্যাপের লেখা পড়লো এবং লেখক পরিচিতিও দেখে নিলো।দেখে মনে হবে সে অত্যন্ত গুণী পাঠক।
বয়স কতইবা হবে?দশ কি এগার কিংবা বড়জোর বার হবে হয়তো।সাথে কেউ নেই।বাবা কোথায় জানতে চাইলে সে বললো বাবাতো অন্য স্টলে বসে আছে।বাবার সাথে বসে থাকলে কি আর বইমেলায় আসা নিত্যনতুন বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়?তাছাড়া কোন বইয়ে কি লিখেছে সেটা জানতে হলেতো স্টলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতেই হয়।কিন্তু বাবা নিজেই এতোটা ব্যস্ত যে তার কি আর অত সময় হবে ঘুরে দেখার।ইবন শেষে একাই ঘুরছে।লাবনী আপা তখন স্টলে বসে নতুন আসা বইগুলি সাজিয়ে রাখছিলেন।স্টলের সামনে এক ক্ষুদে পাঠককে দেখে তিনি বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠলেন কারণ এই পাঠকের আসেপাশে আর কেউ নেই,তার অভিভাবকও নেই এবং এই ক্ষুদে পাঠক নিজে বইগুলো থেকে বেছে বেছে দেখছে,কিছু কথা হয়তো পড়ছেও দাড়িয়ে দাড়িয়ে।
ঐতিহ্য থেকে প্রতিবছরই নতুন অনেক বই বের হয়।অতনু তিয়াসের লেখা “আমি অথবা অন্য কেউ” বইটা হাতে নিয়ে প্রথমে লেখক পরিচিতি পড়ে তার পর ভিতরের লেখার দিকে সে মন দিলো।কবিতা দেখে প্রথমে ভড়কে গেলেও মনে মনে একটা কবিতা সে পড়লো তার পর বইটা রেখে দিলো।এর পর আরো একটা দুটো বই দেখলো,পড়লো এবং এভাবেই সে বইয়ের গুনাগুণ যাচাই করতে লাগলো।লাবনী আপা তখন বেশ মুগ্ধ হয়ে সব দেখছে।এবার তিনি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন তুমি কার সাথে মেলায় এসেছ?ইবন বললো বাবা মার সাথে এসেছি তারা অন্য স্টলে আছে আর আমি ঘুরে ঘুরে মেলার বইগুলো দেখছি।লাবনী আপা জানতে চাইলেন তুমিতো বেশ ছোট।একা একা ঘুরছো যদি হারিয়ে যাও।
ইবন নামের ছেলেটি একবার স্টলের এই মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে বললো আপনি কি আমাকে চিনতে পারেন নাই?এই কথাটি শুনে লাবনী আপা থতমত খেয়ে গেলেন এবং আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন এই ছেলেটি তাহলে কে?যাকে আমার চেনার কথা বলে মনে হচ্ছে।তিনি নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে নিয়ে বললেন না বাবু আমিতো তোমাকে চিনতে পারছি না।তুমি কে?ইবন এবার হেসে দিয়ে বললেন আরে আমাকে চিনবেন কি করে?আমি কি আর বড় বড় লেখকদের মত বিখ্যাত যে আমাকে চিনবেন?আমি জাষ্ট দুষ্টুমী করে দেখলাম আপনি চমকে গেছেন।আমার নাম ইবন।আর আমি হারিয়ে যাবো না কারণ বইমেলাতে আমি প্রায়ই আসি আর সবইতো পরিচিত।ওর কথাশুনে বেশ মজা পেলেন লাবনী আপা।এই পুচকে ছেলেটা খুব ট্যালেন্টেড,ওর বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা লাবনী আপাকে মুগ্ধ করলো আর মন বললো ওর সাথে বেশ গল্প করা যেতে পারে।তিনি জানতে চাইলেন তুমি যদি কোন বই পছন্দ করে ফেলো তাহলে কি করে কিনবে?বাবা মা তো সাথে নেই।তাছাড়া ধরো বই পছন্দ করে রেখে বাবা মাকে ডাকতে গেলে তখন দেখা গেল ফিরে এসে আর সেই স্টল খুঁজে পাচ্ছ না।
ইবন মাথা তুলে আরেকবার তাকিয়ে বললো না না কোন সমস্যা নেই।বই কেনার জন্য বাবা মাকে ডাকতে যাব কেন?আপনিকি আমার শার্টের পকেটের দিকে তাকান নাই?লাবনী আপা ভাবলেন এই পিচ্চিটা নিশ্চই আবারও দুষ্টুমী করছে।তিনি বললেন নাতো কি হয়েছে ? ইবন পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা পাচশো টাকার নোট বের করে বললো আপাতত এটা দিয়েইতো একটা দুটো বই কিনতে পারবো।তবে সবার আগে বইতো পছন্দ হতে হবে।ইবন নামের ক্ষুদে পাঠকের সাথে কথা বলে লাবনী আপার অনেক ভালো লাগলো।ঐতিহ্য প্রকাশনীর স্টলে সব সময়ই খুব ভীড় থাকে সেদিন ছিল আরো বেশি ভীড়।তবে লাবনী আপা অন্যদেরকে একটু ম্যানেজ করতে বলে ইবনের সাথে কথা বলতে লাগলেন।
তিনি জানতে চাইলেন কার কার বই কিনেছ?ইবন বললো অনেকের বই কিনেছি।লাবনী আপা বললেন রবীন্দ্রনাথের বই কিনেছ? ইবন সহজ করে উত্তর দিলো না কিনিনি। কাজী নজরুলের বই কিনেছ? না কিনিনি।তাহলে জসীম উদদীনের বই কেন,আমাদের এখানে জসীম উদদীনের সুন্দর সুন্দর বই আছে।ইবন বললো তা কেনা যায় যদি লেখকের অটোগ্রাফ পাই। আমি আবার অটোগ্রাফ ছাড়া কোন বই কিনি না।শুনে লাবনী আপা খুবই অবাক হলেন।তিনি বললেন জসীম উদদীনতো নেই তাই অটোগ্রাফ কি করে দিবেন?ইবন বললো অটোগ্রাফ না দিলে বই কিনবো না।যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের বইই কিনিনি সেখানে অটোগ্রাফ ছাড়া জসীম উদদীনের বই কি করে কিনি বলুন।তাকে বলা হলো কিন্তু জসীম উদদীনকে কোথায় পাবে? সে তো আসবে না এবং তাঁর পক্ষে আসা সম্ভবও নয়।তখন ছোট্ট ইবন বললো বাহরে বই লেখার সময় সম্ভব, বই মেলায় নিয়ে আসা সম্ভব আর আমি অটোগ্রাফ চাইলেও তখন তিনি মেলায় নেই! এ কেমন কথা?লেখকের অটোগ্রাফ ছাড়া আমি বই কিনবো না।তিনি যদি আমাকে পাঠক হিসেবে পেতে চান তাহলে হুইল চেয়ারে করে হলেও বই মেলায় এসে আমাকে অটোগ্রাফ দিতে হবে।নাকি তার হাতের লেখা খুবই বেখাস্তা তাই অটোগ্রাফ দেওয়ার ভয়ে মেলায় আসেন নি?উনি আসলে বলবেন আমার কথা।আমার নাম বললেই চিনে ফেলবেন কারণ আমাকে সবাই চেনে,আমি অটোগ্রাফ ছাড়া বই কিনিনা।
হাতে রাখা বইটা স্টলের টেবিলে নামিয়ে রেখে ইবন নামের ক্ষুদে পাঠকটি হাটতে হাটতে চোখের আড়ালে চলে গেল আর লাবনী আপা ওর যাওয়ার পথের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।ওকে বলতেও পারলেন না যে জসীম উদদীনতো বেঁচে নেই যে তোমাকে অটোগ্রাফ দিবেন।যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তোমাকেই সবার আগে অটোগ্রাফ দিতেন।মন থেকে স্মৃতিটুকু নিশ্চই মুছে যাবেনা।পাঠকের ভীড় বাড়তে থাকায় আবার অন্য পাঠকদের দিকে দৃষ্টিনিবেশ করলেন।কিছুক্ষন পর লাবনী আপা শুনলেন কেউ একজন মিষ্টি কন্ঠে ডাকছে এই যে আন্টি শুনুন।চোখ ফেরাতেই দেখলেন ইবন দাড়িয়ে আছে।হাতে বেশ কিছু বই। সে একটা একটা করে পাতা উল্টে সদ্য নেওয়া অটোগ্রাফগুলো দেখাতে লাগলো।প্রথম বইয়ে বিখ্যাত লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের অটোগ্রাফ,দ্বিতীয়টিতে আনিসুল হকের অটোগ্রাফ। তিনি লিখেছেন বাস্তবে গুড্ডুবুড়াকে দেখতে হলে ইবনকে দেখতে হবে।তবে গুড্ডু বুড়া একটু বোকা ধরনের কিন্তু ইবন আইনস্টাইনের মত জ্ঞানী।এভাবেই বাকি বইগুলিতে বিখ্যাত সব লেখকদের অটোগ্রাফ দেখা গেল।বইগুলোতে নেওয়া অটোগ্রাফ দেখানো শেষ হলে সেগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে লাবনী আপার দিকে তাকিয়ে বললো আন্টি পল্লী কবি জসীম উদদীন অনেক আগেই মারা গেছেন সেটা আমি জানি।আমি দুষ্টুমী করেছিলাম।তবে আন্টি আমি অটোগ্রাফ ছাড়া বই কিনিনা এটা যেমন সত্য্ তেমন এটাও সত্য যে সব লেখক জীবিত নেই তাদের বইও কিনি অটোগ্রাফ ছাড়া।কিন্তু জসীম উদদীনের যে বইগুলি আপনাদের স্টলে আছে তা কিন্তু আমার বয়সীদের জন্য নয়।পাঠক বুঝে বই কিনতে বলবেন দেখবেন দারুণ বিক্রি হবে।লাবনী আপাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কিছু উপদেশ দিয়ে হনহন করে হেটে চলে গেল অটোগ্রাফ ছাড়া বই না কেনা ক্ষুদে পাঠক ইবন ইবতেশাম মজিদ।লাবনী আপা জানতেই পারলেন না এই ক্ষুদে পাঠক আসলে কে!যে তাকে বার বার অবাক করে দিয়েছে।
৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮