লেখাঃ জাজাফী
ঘুম থেকে ওঠার পর বাবাকে চোখে পড়েনা ওয়াং এর।বিশেষত সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া বাবাকে দেখার সুযোগই পায়না ওয়াং।বাবা ঠিক কত সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে বেরিয়ে পড়ে তা সে অনুমানও করতে পারে না।এমনকি বাবার মতই সুর্যেরও দেখা পাওয়ার উপায় নেই।কারণ সুর্য যখন আরামের ঘুমে আচ্ছন্ন তখন ওয়াংকেও উঠে বেরিয়ে পড়তে হয়।বাবা কাজে বেরিয়ে পড়ে আর ওয়াং যায় স্কুলে।স্কুল শেষে ওয়াং বাসায় ফিরে রাতের খাবার খেয়ে স্কুলের পড়া শেষ করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাবার জন্য কিন্তু তখনো বাবার আসা হয়না।ফিরতে ফিরতে বাবা এতো দেরিতে ফেরে যে তখন ওয়াং নামের আট বছরের ছেলেটি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায়।ছুটির দিনে বাবাকে কিছুটা কাছে পাওয়া হয় এটাই ওর শান্তনা।মাকে কখনো মনে পড়েনা ওয়াংয়ের।ও যখন দুই বছরের শিশু তখনই মা ওকে আর বাবাকে ছেড়ে সুখের সন্ধানে বেরিয়ে গেছে অন্য কারো হাত ধরে।শিশু মনে সেই আঘাত এতোটাই প্রবল হয়েছিল যে ও চেষ্টা করেছে মাকে ভুলে যেতে।হয়তো কিছুটা পেরেছে।পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে সবাই যখন মা বলে কেদে ওঠে ও তখন মায়ের বদলে বাবাকে ডাকতো।এভাবেই একটু একটু করে মায়ের স্থানটা বাবার অধীনে চলে গেল।তবে বাবাও সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে ওকে তেমন সময় দিতে পারে না।
বাড়ি থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে ওয়াংএর স্কুল।এই সাড়ে চার কিলোমিটার সে রোজ হেটে হেটে পাড়ি দেয়।সামর্থ নেই গাড়িতে করে যাওয়ার।সরকারী স্কুল বলেই ওয়াং কিছুটা নিশ্চিন্তে পড়তে পারছে।ওর পরিবারের যে অবস্থা তাতে স্কুলে যাওয়াটা খুবই কঠিন।পরিবারে বাবা দাদি আর এক বোন ছাড়া আর কেউ নেই।স্কুলে আর যারা পড়তো তাদের সবার থেকে ওয়াংদের অবস্থা বেশি খারাপ ছিল।অন্যরা যখন দিনে দিনবেলা পেট ভরে খাবার খায় ওয়াং তখন দিনে একবেলাই পেট ভরে খেতে পায় না।এক ছুটির দিনে বাবার সাথে ওয়াং তিয়ানজি পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে হাটছিল আর ভাবছিল পাহাড়টি কত্ত উচু।সে বিস্ময় ভরা চোখে পাহাড়ের উচ্চতা দেখে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল বাবা এই পাহাড় গুলো কত্ত উচু!মানুষকি এতো উচুতে উঠতে পারে?বাবা ওর চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলেছিল এর চেয়েও অনেক উচু পাহাড় আছে নেপালে।সেটার নাম মাউন্ট এভারেষ্ট আর তুমি শুনলে অবাক হবে সেই পাহাড়েও মানুষ উঠেছে।বাবার কথা শুনে ওয়াং আরো বিস্মিত হলো।মানুষ এতো উচুতে কি করে উঠতে পারে।বাবা তখন ওকে বলেছিল তুমি জানো পৃথিবীতে এমনও মানুষ আছে যাদের এতো বেশি টাকা আছে যা সাজিয়ে রাখলে এই পাহাড়ের চেয়েও উচু হবে।যেমন বিলগেটস।
বাবার কথা শুনে ছোট্ট ওয়াং ভাবনায় পড়ে যায়।মানুষের এতো টাকা হয় কি করে?সে প্রশ্ন করে আচ্ছা বাবা ওদের এতো টাকা কিন্তু আমাদের নেই কেন?কি করলে আমরাও টাকার মালিক হবো?ছেলের কথা শুনে কিম ওয়াংয়ের মনটা খারাপ হয়ে গেল।তার ছোট্ট ছেলেটি জীবনে সুখ পেলো না।তিনি ওকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন বাবা অনেক টাকাওয়ালা হওয়ার চেয়ে অনেক ভালো মানুষ হওয়াটা বেশি জরুরী।টাকাওয়ালারা যেমন একদিন মরে যায় টাকা ছাড়া যারা তারাও একদিন মরে যায় কিন্তু যারা ভালো মানুষ তারা মরে গিয়েও বেচে থাকে মানুষের মনে।বাবার কথা শুনে এবার খুবই অবাক হয় ওয়াং।বড়লোক না হয়েও মানুষের মনে জায়গা পাওয়া যায়!কি করতে হবে ? বাবা তখন বলে তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করবে,মানুষের মত মানুষ হবে।মানুষের উপকার করবে,সব সময় সত্যি কথা বলবে দেখবে তুমি কত সুখী।তোমাকে মানুষ কত ভালোবাসে।বাবার কথাগুলি খুব মন দিয়ে শোনে ওয়াং।তারপর থেকে সে পড়াশোনায় খুব মন দিতে থাকে।
এক সকালে ওয়াং এর বাবা কিম ওয়াং কাজে ব্যবস্ত আছে এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো তারই অফিসের এক সহকারী।কিমের হাত ধরে নিয়ে গেল টিভির সামনে।টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কিমের চোখে পানি চলে আসলো।সেখানে যে মানুষটিকে দেখানো হচ্ছে সে তার আট বছরের প্রিয় পুত্র ওয়াং। পৃথিবীর চারদিকে টিভিতে,খবরের কাগজে,ফেসবুকে আট বছরের ছোট্ট ওয়াং এর ছবি ছাপা হলো।খবর রটে গেল পৃথিবী ব্যাপী।একটি ছোট্ট ছেলে স্কুলের বেঞ্চের পাশে দাড়িয়ে আছে তার মাথাভর্তি চুল সব বরফে ঢেকে গেছে।দেখলে মনে হবে হয়তো এক শিশু মজার ছলে বরফ নিয়ে খেলতে খেলতে মাথায় বরফ রেখেছে কিন্তু আসলে তা নয়।ওয়াং বাড়ি থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার হেটে স্কুলে এসেছে।
মাইনাস ৯ ডিগ্রি তাপমাত্রায় চারদিকে তুষারপাত হচ্ছিল আর তাই হাটতে হাটতেই ওর চুল বরফে আবৃত্ত হয়ে গেছে।ওর ছোট্ট হাতদুটি শীতে ফুলে উঠেছে।ওর ভ্রুদুটিও বরফে ঢেকে গেছে।স্কুলের শিক্ষক ওর এই অবস্থা দেখে কয়েকটি ছবি তুলে তা ফেসবুকে দিয়ে দিলে বিশ্বব্যাপী সেটা ছড়িয়ে পড়ে।টেলিভিশনগুলো ওর খোজ নিতে আসে এবং এভাবেই পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে ছোট্ট ওয়াং এর নাম।যে তার গরীব বাবার কাছ থেকে শিখেছে বড় লোক হও বা না হও ভালো মানুষ হতে হবে,তাহলেই মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে,মনে রাখবে।আর ভালো মানুষ হতে হলে পড়াশোনাও করতে হবে মন দিয়ে।আর সে জন্যই ভয়ংকর শীতের মধ্যেও সে স্কুলে যেতে পিছপা হয় নি।
কিম ওয়াং ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখলো বাড়ির উঠানে অনেক মানুষ।টিভির মানুষও আছে।ওয়াং এর শরীরে তখন দামী শীতের কাপড়।স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সামাজিক সংগঠনের লোকেরাও এসেছে এবং তারা জানিয়েছে এই অঞ্চলের সব সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শীতের কাপড় দিবে এবং দেখভাল করবে।এ জন্য তারা একটি ফাউন্ডেশান করবে যেটির নাম হবে ওয়াং ফাউন্ডেশান।ওয়াংকে টেলিভিশন সাংবাদিক জিয়ানা জং প্রশ্ন করলো যে তীব্র তুষারপাত হচ্ছে এর মধ্যে মানুষতো খুব প্রয়োজনেও ঘর থেকে বের হয় না তাহলে তুমি কেন এতো দূর পথ হেটে হেটে স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হলো? ওয়াং বললো বাবা বলেছে আমাকে মানুষ হতে হবে আর মানুষ হতে হলে সবার আগে চাই নিয়মিত স্কুলে যাওয়া।আমি যদি তুষারের ভয়ে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করি তাহলে আমি কি কখনো মানুষ হতে পারবো?ওর কথা শুনে সবার চোখে পানি চলে আসে।
লুদিয়ান কাউন্টির ওয়াং এবং মানুষ হওয়ার গল্প
১৭ জানুয়ারি ২০১৮
আরও পড়ুনঃ
- ক্ষুদে লেখক রাশিকের মিস্ট্রি অব দ্য সুপার ন্যাচারাল।
- শিহাব এবং টিটোনের সাহসীকতার গল্প।
- অনন্য যারিফ আকন্দ,গ্রহ নয় যেন একটি নক্ষত্রের নাম।
- বয়স ১৪ তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
- রিয়া দিয়া ক্ষুদে মহাতারকা।