লেখকঃ মালিহা নামলাহ
রাস্তাঘাটে এমন কিছু দৃশ্য থাকে, যা শুধু একাকী থাকলেই চোখে পড়ে! সেসব দৃশ্য খুজে পাওয়া যায় হয়তো কোনো চিত্রকর্মে, চলচিত্রে, সাহিত্যে। তখন সেসবকে মনে হয় অপার্থিব কিছু অথবা শুধুই শিল্পীর কল্পনা জগতের শৈল্পিক বহিঃপ্রকাশ। অথচ সেসব যে এক মহাশিল্পীর আঁকা পৃথিবীর বাস্তব চিত্রেরই আবেগময় প্রতিফলন, তা বোঝা যায় তখনই, যখন ঢাকা শহরের মতো এক কর্মব্যস্ত শহরের রাস্তায় কর্মবিহীন কেও একা একা হাটে অথবা দাঁড়িয়ে থাকে সময়ের প্রতীক্ষায়। সাফার জীবনের ঠিক এমনই এক মুহূর্তের কথা বলছি। সেদিন একটা কাজে সে তাজমহল রোডে গিয়েছিল। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে এক বান্ধবীর অপেক্ষায়। সে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু তার দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে সারারাস্তাময়, কখনো মন উড়াল দিচ্ছে চোখের পিছু পিছু। হঠাত পাশে একটা বাচ্চা ছেলে এসে দাড়ালো, বয়স আনুমানিক ৮-৯ বছর, হাতে একগুচ্ছ বেলুন। তার চোখের বিষণ্নতার কৃত্রিমতা সাফার অভিজ্ঞ চোখ খুব সহজেই ধরে ফেলল। সাফার দিকে তাকিয়ে চোখে কৃত্রিম বিষণ্নতা নিয়ে সে টেনে টেনে বলল,
-আপাআ, একটা বেলুন নেএএন। সারাদিন কিছু খাই নাই, ভাআত খামু।
ওদের কর্মকান্ড সাফার কাছে প্রায়ই মজার ঠেকে! তার দুঃখী মুখের প্রত্যুত্তরে সাফার মুখ প্রসন্ন কেন হলো সেই রহস্য বেচারা বুঝল না, কিছুটা বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো, হয়তো সাফা ভাষায় প্রকাশ করবে সেই আশায়। সাফা তার আশাকে বাস্তবে রূপান্তিরিত করে হাসতে হাসতে বলল,
-তুমি কি ভীক্ষা করছ?
সে মাথা নাড়ল দুই পাশে, সে ভীক্ষা করছে না।
-কি করছ তুমি।
-বেলুন বেচতাছি।
তখনও তার মুখের বিষণ্নভাব কাটেনি। হয়তো বুঝে উঠতে পারছিলো না সেই মুহূর্তে মুখভঙ্গী কেমন করা লাভজনক। ওরা ভীক্ষা করার কৌশল খুব ছোটবেলায়ই রপ্ত করে, বেলুন বিক্রির কৌশল হয়তো রপ্ত হয়নি এখনো। সাফা বলল,
-তাহলে তুমি এভাবে বলছ কেন? এসব বলে কি কেও বেলুন বিক্রি করে?
এতোক্ষণে মুখে হাসি ফুটলো তার! দাঁত কপাটি বের করে বলল,
-তাইলে ক্যামনে বেলুন বিক্রি করে?
সাফা বলল,
-প্রথমে মুখটা হাসি দিয়ে ভরে ফেলবে। তারপর বলবে, “আপা দেখেন কতো সুন্দর সুন্দর বেলুন! কিনবেন একটা? দাম মাত্র দশ টাকা”।
সে উৎসাহ নিয়ে বলল,
-বেলুনগুলা সুন্দর না আপা?
-হ্যা, খুব সুন্দর। তুমি বেলুন পছন্দ কর?
-হ।
এবার সাফা কন্ঠ থেকে কৌতুক সরিয়ে ফেলে নরম গলায় বলল,
-তুমি বেলুন বিক্রি করছ, নিজে পরিশ্রম করে টাকা উপার্জন করছ, কেও তোমার কাছ থেকে বেলুন কিনলে সেটা দয়ার দান না। তুমি কাজ করে খাচ্ছ, মাথা সবসময় উঁচু রাখবা, হাসিমুখে কাজ করবা, কারো দয়া ভীক্ষা করবা না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথা নত করা যায় না, এটা সবসময় মাথায় রাখবা। আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বেচে থাকতে হবে।
কথাগুলা বলে ফেলার পর সাফার মনে হলো এই কথাগুলো ওর ভাষায় বলা উচিৎ ছিলো। আত্মসম্মানের মতো কঠিন শব্দ যে সে বুঝবে না, তা সাফার মাথায় আসলেও না বলে থাকতে পারল না। কেমন যেন একটা বক্তা বক্তা ভাব চলে এসেছিলো তার ভেতর! কিছু বুঝতে না পেরে অসহায় চোখে ছেলেটা তাকিয়ে আছে দেখে মায়া লাগলো। ওর ভাষায় বুঝাল,
-দেখ, আমি যদি রাস্তা দিয়ে হেটে যাই, কেও কি আমাকে একটা বাজে কথা বলার সাহস পাবে? একটা গালি দিতে পারবে কেও? পারবে না। কেন পারবে না জান? কারণ আমি তাদের কারো দয়ায় বাচি না। তাদের গালির প্রতিবাদ করার মতো অবস্থান আমার আছে, সেটা তারা জানে। রাস্তাঘাটে ক্রমাগত মার খাও তোমরা। তুমি কি চাও না আমার মতো একটা জীবন পেতে? এরজন্য কিন্তু উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন হয় না, অনেক টাকাপয়সার প্রয়োজন হয়না, দামী কাপড়ের প্রয়োজন হয় না। কারো কাছে হাত না পেতে সৎ পথে টাকা কামাই যদি কর, তোমার গায়ে হাত তুলতে গেলে মানুষজনকে অনেকবার ভাবতে হবে। যখনই তুমি কারো কাছে হাত পাতবা, তখনই তারা তোমার সাথে যা খুশি তাই করার চেষ্টা করবে। সমাজের কিছু মানুষ সর্বদা দুর্বলদের উপর চড়াও হয়, তাই নিজের অবস্থানকে মজবুত করে গড়ে তুলতে হবে।
বাচ্চাটা কিছু বুঝল কিনা জানি না, তবে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। তার মূল্যবান সময় নষ্ট করে উপদেশ দেওয়ার সুবাদে সাফা তার কাছে থেকে একটা বেলুন কিনে তাকেই সেটা উপহারস্বরূপ দিল। তবুও বাচ্চাটা হাসলো না, একটা শান্ত গাম্ভীর্যে আচ্ছন্ন তখন সে! বেলুনটা হাতে নিয়ে প্রস্থান করল নিরবে।
সাফার মনটা খারাপ হয়ে গেল। হয়তো আত্মসম্মানবোধের অভাবই একসময় তাদেরকে নিষ্ঠুরতম অপরাধের দিকের ঠেলে দেয়! রাস্তাঘাটে চুরি ছিনতাই এর শিকার হলে কি আমদের আসলেও ওদেরকে দোষ দেওয়া উচিৎ, যেখানে আমাদের সমাজ অর্থাৎ আমরা তাদেরকে জন্মলগ্ন থেকে সর্বদাই উপলব্ধি করাই যে তারা ছোট, তারা নিচ, তারা দয়ার কাঙাল? যেখানে আমরা নিজেদের সবার্থ সিদ্ধির জন্য তাদেরকে সবসময়ই মাথা ঠেসে নিচে নামিয়ে রাখি, কাজের মেয়েটা সোফায় বসলে সোফা নোংরা হয়ে যায়, সে আমাদের মতো খাবার খেলে আমাদের অমর্যাদা হয়, বাবার বয়সী রিকশাওয়ালাকে তুই করে না বললে তৃপ্তি হয় না, সেখানে আমরা কিভাবে সেই তাদেরই বিরুদ্ধে অভিযোগ করি? কেন আমরা ভুলে যাই যে আমরাই তাদেরকে দীক্ষা দিয়েছি তোমরা “নিচু শ্রেণির মানুষ” তোমরা “ছোটলোক”! এই ছোটলোক সম্প্রদায় তো তথাকথিত “বড়লোক” দেরই সৃষ্টি।
আরও পড়ুনঃ