লেখকঃ মো নাফিজ বিন জামাল
পুকুরের জলে ঢিল ছুঁড়ে দেখেছেন কখনও? অনেক দূর পর্যন্ত গোল ঢেউগুলো ছড়িয়ে যায়! আমাদের মনের মধ্যে যে নির্জন দুপুরের শান্ত পুকুরটা আছে, কখনও সেখানে ঢিল ছুঁড়ে দেখবেন, আপনি নিজে ভাবতেও পারবেন না, অজান্তেই সেখানে এসে যেতে পারে তোলপাড় করা সুনামির ছোট-মেজ-সেজ অথবা বড় ঢেউ! পুরাণের গল্পে সমুদ্র-মন্থন হয়েছে যখন, মন-মন্থনেই বা দোষ কি! ক্ষতি তো বিশেষ কিছু হবে না, ম্যাক্সিমাম গরলামৃতের স্যান্ডউইচে আপনি কিছুক্ষণ নাস্তানাবুদ হবেন! রংচটা-ফিকে-বিবর্ণ কিছু স্মৃতি এসে পড়বে সামনে । পুরনো সেই দিনের কথা ভেবে একটু হাসবেন, হয়তো বা একটা দীর্ঘশ্বাস! মনের কোণের আলমারিতে রেখে দেওয়া, ধুলো পড়া অ্যালবাম থেকে কিছু ছবি ছড়িয়ে যাবে চারদিকে!এত ভণিতার কারণ, আমি নিজে আসলে বেশ নাস্তানাবুদ হলাম এরকমই একটা ছোট-খাটো সুনামির ধাক্কায়, অবশ্যই মনের মধ্যে । সুনামিটা এল কেন, সেটা না হয় শেষে বলব আপনাদের । তার আগে বরং মনের ভিতরে রাখা পুরনো অ্যালবামের যে ছবিগুলো ছত্রাকার হয়ে গেল সেগুলো একটু গুছিয়ে নিই ।
সে অনেকদিন আগের কথা….তখন electricity চলে গেলে জেনারেটর ছাড়া হতো না সহজে।অন্ধকারের সাথে ছুটে আসতো জোনাকির দল। বিল্ডিং এর বাচ্চা কাচ্চারা নেমে পড়তো রাস্তায় জোনাকিপোকা ধরার জন্য। রাতে আকাশে চাঁদ উঠতো। চাদের আলোয় আমরা সেই জোনাকিপোকার পেছনে ছুটতাম। বিল্ডিং জুড়ে আড্ডার আসর বসতো,কোনো আংকেল হঠাৎ হয়তো হেড়ে গলায় গান ধরতো। ২০০২ এর world cup এর সময় বাসায় টিভি কেনা হলো। বিটিভিতে খেলা দেখার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করতাম আমি আর আব্বু। টিভিতে একটু সমস্যা হলে antenna নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যেতো।পরিবারের সবাই মিলে তখন শুক্রবারে তখন বাংলা সিনেমা দেখতাম।অনেকদিন হলো সেই family মুভি show তে আর নায়ক নায়িকারা ডিসুমডাসুম করে না।স্কুল থেকে ফেরার সময় ছাতা গলিয়ে বৃষ্টি তে ভেজা হয়না আর।
আমি বড় হয়েছি সিলেট ক্যাডেট কলেজ ক্যাম্পাসে।তখন শুক্রবারে কলেজে হাড়িপাতিল আর পাপড় নিয়ে ফেরিওয়ালা আসতো। খা খা দুপুরে আকাশে চিল উড়ে বেড়াতো। আম্মু ঘুমিয়ে পড়লে আমি লুকিয়ে ছাদে উঠতাম চিল দেখার জন্য। কখনো বা আব্বুর ড্রয়ার থেকে লুকিয়ে দুই টাকা দিয়ে ফেরিওয়ালার সেই পাপড় কিনতাম।ঈদ গুলোতে সালামি পাইতাম ১০ টাকা,সেই ১০ টাকার আনন্দ এখন ১০০০ টাকার সালামি তেও পাওয়া যায় না।
স্কুল লাইফে যে আমাদের একটা gang ছিলো। তার মধ্যে আমি আর Sakin Hossain শুধু কথা বলার জন্য ধরা খাইতাম Sir দের কাছে। Wahid Hasan Chowdhuryখালি Shirt এর পেছনে দাগ দিয়ে দেওয়ায় ওস্তাদ ছিলো । Nigar Sultana Anika আর আমি খালি ঝগড়া করতাম।ব্লাকবোর্ডের চক ছোড়াছুড়ি দিনগুলো আজ শুধুই স্মৃতি । স্কুলের পেছনে একটা বধ্যভূমি ছিলো। ওইটা ছিলো আমাদের কৌতুহলের প্রধান উৎস। কতো ভুতের কাহিনি শুনতাম ঐ জায়গার।আজও হয়তো সেই ভুতগুলো আমাদের মতো অনেকের আড্ডার আসরকে তাড়া করে ফেরে। বৃত্তি পরীক্ষায় কে কার চেয়ে ভালো বইটা প্রাইজ পেয়েছে এটা নিয়েও অনেক স্মৃতি আছে ঐ শ্ব র্য তা হয়তো আরও ভালো বলতে পারবি ।
সন্ধ্যার আজান হলেই ঘরে ফেরার টাইম হয়ে যেতো, কারন সন্ধ্যার সময় ঘরের বাইরে থাকা বারন ছিলো। আমি প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় বারান্দার আকাশে সন্ধ্যাতারা দেখতাম অনেক্ষন। ভুতুড়ে রাতের নির্বাক নেমে আসা উপলব্ধি করতাম।আমাদের বিল্ডিং এর পেছনে বড় একটা গাছ ছিলো, প্রতিদিন সেই গাছটায় একজোড়া মাছরাঙা পাখি এসে বসতো আর ওদের দেখার জন্য আমিও সকালবেলা বারান্দায় পড়তে বসতাম । ওরা কখনো না আসলে আমার মনটা ও অনেক খারাপ হয়ে যেতো আসলে তখন মন খারাপের কারণ গুলাও ছিল অদ্ভুত। আজও শীত আসে। কিন্তু শীতের সকাল গুলোর নির্মল শুভ্র স্নিগ্ধতা, ভোরবেলার জমে থাকা শিশির গুলো স্কুল থেকে ফেরার পথে যেভাবে ছুয়ে ছুয়ে দেখতাম এখন আর কিছুই এভাবে উপলব্ধি করা হয়না।হয়তো বড্ড যান্ত্রিক হয়ে গেছি আমরা।সময়ের প্রয়োজনে সবাইকে বদলে যেতে হয়।আমরাও এর ব্যতিক্রম নই।
রবিন্দ্রনাথ এর একটা কথা খুব মিলে যায় আমার এই লেখাটার সাথে – “তখন খুব একটা কিছু লাগে নাই।কিন্তু জীবনের এহেন অবস্থায় উপনীত হইবার পর বোধ হইতেছে যাহা ছাড়িয়া আসিয়াছি তাহাই উত্তম ছিল।নির্ভেজাল । দুশ্চিন্তার বালাই নাই। তবে” অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার ধরিয়া রাখার মতন বিরম্বনা আর নাই” – আসলেও সত্য।
লেখকঃ মো নাফিজ বিন জামাল
এক্স ক্যাডেট, কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ
Comments are closed.