সেই ছোট্ট বেলায় আমার এই যায়গার সাথে পরিচয়। বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, ভালো-মন্দ বিচারের ক্ষমতা সব ই পাওয়া আমার প্রাণের পরিবার এর কাছ থেকে। আমার প্রাণের পরিবার এর সদস্য আমি যখন পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু তখন থেকে।
হ্যাঁ আমি আমার প্রিয় বিদ্যালয় মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরী স্কুল এন্ড কলেজ এর কথা বলছি। তখন যদিও এই স্কুলের নাম এটা ছিলো না। ২০০৪ সালে আমার মা সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে প্রিপারেটরী পরিবার এর সদস্য হন।
তখনকার মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরী উচ্চ মাধ্যমিক ও বালিকা বিদ্যালয়ে তখন থেকেই আমার যাতায়াত শুরু। তখন সেখানে যেতাম “মিসের মেয়ে” হিসেবে।
তার পরের বছর অর্থাৎ ২০০৫ সালে আমি পাকাপোক্তভাবে এই পরিবারের সদস্য হয়ে উঠি।
মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরী উচ্চ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় এর নীল-সাদা সেই পোশাকে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে হেটে বেড়ানো শিশু হয়ে একদল ছোট্ট সৈনিকের বেড়ে ওঠা শুরু হয় সেই বছর।
লাল পরী নীল পরী গানের সুরে ঘুরে বেড়ানো, হাম্পটি ডাম্পটি ছড়ায় হাসাহাসি করে গড়িয়ে পড়া, লুকোচুরি খেলার মতো আরও অনেক খেলায় মেতে ওঠা ছিলো আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গি।
এই বিদ্যালয়ের প্রতিটি কোনায় কোনায় রয়েছে হরেক রকম স্মৃতি। সেই ২০০৫ সালে প্লে গ্রুপে পড়ার সময় থেকেই যার শুভ সূচনা। নানা ধরনের স্মৃতিতে স্মৃতির ডালা ভরে উঠতে থাকে আমাদের প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর।
বিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষিকা ও আনন্দ:
আমার জীবনের প্রথম শিক্ষিকা হিসেবে আমি পাই আমার অত্যন্ত প্রিয় হিমানী মিস কে। প্লে গ্রুপে একেকটি ক্লাসে ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষার্থী ক্লাস করলেও মাঝে মাঝেই আমাদের সবকটি শাখা একত্র করে নানা ধরনের খেলা শেখানো হতো।
নিজে নিজে দাত ব্রাশ করা থেকে শুরু করে ডিমের খোশা দিয়ে নানান ধরনের জিনিস বানানোর শিক্ষাটাও দিয়েছে আমাদের এই স্কুল। হাসি খুশির সাথে বেড়ে উঠি।
প্লে গ্রুপের আরো কিছু শিক্ষকের নাম না বললে অপরাধ করা হবে। আমাদের প্লে গ্রুপের প্রত্যেকটি শিক্ষক এর সাথেই ছিলো আমাদের পরম আত্মিয়তা। কৌশিক স্যার, কাঞ্চি মিস, রায়হানা মিস, শামসুন নাহার মিস, হিমানী মিস এর মতো অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাকে পেয়েছিলাম ভাগ্যের জোরে।
আর তার সাথে ছিলেন আমাদের প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর প্রিয় শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক সুফিয়া খাতুন মিস।
শুধু সেই প্লে গ্রুপ ই নয় বরং সেই ২০০৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকার সাথে অজস্র স্মৃতি।
প্রতিটি বছরে নতুন ভাবে নিজেকে জানা, নিজের ক্ষুদ্র কিছু প্রতিভার সম্পর্কেও জানতে পারি এই বিদ্যালয়ে থাকাকালীন ই।
প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় ইংরেজিতে একটি ৫ বাক্যের ছড়া লিখে স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিলো, তারপর থেকেই একটু একটু করে এই লেখালেখির চর্চা শুরু করি।
তারপর ২০১১ সালে চতুর্থ শ্রেনীর শিক্ষার্থী থাকাকালীন একুশে ফেব্রুয়ারি বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লিখে শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের পুরষ্কারে পুরষ্কৃত হই।
তাছাড়াও কবিতা আবৃত্তি করে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার গ্রুপ এ শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিকার হিসেবে পুরষ্কারজয়ী হই।
বর্ধিত পরিবার:
এই বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষক-শিক্ষিকা, আয়া-বুয়া, দারওয়ান- অফিসার প্রত্যেকটি মানুষই হয়ে উঠেছে আমাদের একান্ত আপন।
এই বিদ্যালয়ের একেকটি ক্লাসে প্রতি বছর গড়ে ওঠে একেকটি পরিবার ও তার নানা ধরনের কাহিনি।
প্রথম শ্রেণিতে অধ্যায়ন কালে আমার সেই প্রথম শিক্ষিকা চলে যান অন্য কোথাও চাকরি নিয়ে, সৌভাগ্যবসত এখনো আমার তার সাথে যোগাযোগ আছে।
এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে উঠে গেলে আগের ক্লাস এর শিক্ষক শিক্ষিকা কখনো কোনো কাজে আমাদের ক্লাসের আশেপাশে দয়ে হেটে গেলে তার প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে হতো ৫০ জনের আক্রমণ এর শিকার হতে।
আমরা রেক্টর হিসেবেও পেয়েছিলাম দারুণ কিছু মানুষকে। আরশাদ স্যার, মিজানুর রহমান স্যার, ফাতেমা রহমান মেডাম তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
পরে আমাদের স্কুল থেকে রেক্টর পদটি বাতিল করে সেখানে আসে ভাইস প্রিন্সিপাল পোস্ট।
ফাতেমা রহমান মেডাম বেলজিয়াম চলে গেলে তখন আমাদের আইরিন মিস কিছুদিন ভাইস প্রিন্সিপাল এর দায়িত্ব পালন করার পর আমরা পাই আমাদের প্রিয় জিন্নাতুন নেসা মেডাম কে।
অত্যন্ত হাসিখুশি একজন মানুষ যিনি যেকোনো সময় দেখা হলেই হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করতেন আমরা কেমন আছি, ক্লাস কেমন চলছে ইত্যাদি।
দারুন স্মৃতির ছোটবেলা:
পঞ্চম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সময়টা ছিলো আরো মজার। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শাখায় উত্তরণের পরীক্ষা “প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনি” পরীক্ষায় পাস করে ষষ্ঠ শ্রেনীতে উঠি।
তখন ৬ টা বিষয় থেকে এক ঝাপে ১৪ টা বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা সবার। তার উপর সৃজনশীল পদ্ধতির প্রশ্ন বুঝতে বুঝতেই পরীক্ষার সময় চলে আসে। যথারীতি অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় ঢালাও ভাবে অসংখ্য শিক্ষার্থী ফেল করে এক বাজে অবস্থার সৃষ্টি হয়।
তবে সেবার ৩ টা পরীক্ষার বদলে ২ টা পরীক্ষা হয়েছিলো। ফলে ষষ্ঠ শ্রেণীর সময়টা তেমন একটা মনে রাখার মতো কোনো ঘটনাই ঘটে নি।
সপ্তম শ্রেনীতে অধ্যায়ন কালে বন্ধুত্ব হতে থাকে গাঢ়। ইংরেজি মাধ্যমের সেভেন সি ছিলো একই সাথে মেধাবী, সৃজনশীল, দুষ্টু ও শান্তের মিশ্রন।
ক্রিকেট খেলাকে ছেলেদের খেলা বলা হলেও আমরা প্রতিদিন ছুটির পর অন্তত ৩০ মিনিট করে ক্রিকেট খেলতাম। কুচকাওয়াজের প্রশিক্ষনের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা স্কুল ক্যাম্পাসে থাকার অভিজ্ঞতাও হয়েছে সেই সময়ে।
তখন থেকেই জন্ম নেয় আমার কুচকাওয়াজের নেশা যা দশম শ্রেণী পর্যন্ত চলেছে।
অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীকে আমরা বলি পড়াশোনার সময়।
জুনিওর স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা থেকে মাধ্যমিক এই সময়।
অন্য কোনো কিছুর চিন্তা করার ও তেমন একটা সময় পাওয়া যায় না।
তবে দশম শ্রেণীতে শিখেছি ড্রাম বাজানো।
আর নবম দশম শ্রেণীতে নিয়মিত নানান অনুষ্ঠানে কোরাস এ গান গাওয়া একটা অভ্যাসে পরিনত হয়েছিলো।
দশম শ্রেণীতে স্কুলের প্রিফেক্ট হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমাদের ১৬ জন শিক্ষার্থীর।
ছোট থাকতে যেই সকল আপুদের প্রিফেক্ট হিসেবে দেখতাম। তাদের প্রতি শিক্ষক দের অন্য রকম এক ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হতাম।
আনন্দের ক্যাম্পাসে বিপদের আশংকা:
আমরা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে প্রিপারেটরীর এক কালো অধ্যায় দেখতে হয় আমাদের।
২০১৫ সালে প্রথম বারের মতো প্রিপারেটরীর শিক্ষার্থীদের দেখতে হয় অনির্দিষ্ট কালের ছুটি।
তবে সৌভাগ্য বসত সেই সমস্যার সমাধান খুব অল্প দিনেই সমাধান হয়ে যায়।
তার সাথে সাথে সেই অভিযোগ ও ভুল প্রমানিত হয়।
বিদায় বেলা:
বিদায় বেলায় আমাদের সেই ছোটবেলার সৈনিকদের সাথে আরো কিছু নতুন সৈনিকের একসাথে পরিবার ত্যাগ করতে হয়।
তবে এখনো সেই বিদ্যালয়ে গেলে ফিরে যাই সেই ছোটবেলার সময়ে। ক্যাম্পাসের প্রত্যেক অংশে কোনো না কোনো স্মৃতি ভেসে আসে।
১৮ ব্যাচের ২০০ শিক্ষার্থীর এই গল্পের মতোই আরো হাজার হাজার প্রিপারেটরিয়ানের হাজারো গল্পের কথা শোনা যায় দেশের আনাচে কানাচে।
ফেসবুকের এই সময়ে কোথাও কোনো প্রিপারেটরিয়ানকে খুঁজে পেলেই হয়তো হয়ে যায় এক ঝলক আড্ডা।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে মিলন মেলা।
রিইউনিওনের আয়োজন হলে প্রত্যেকেই চেষ্টা করে অংশ নিতে।
অন্তত কিছু সময়ের জন্যও সময় বের করে ছোট বড় সকলের সাথে দেখা করতে ছুটে যেতে।
একই পরিবার হয়ে মেতে থাকে সবাই একসাথে।
অনেক অনেক দিন পর সেই ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে কেও যদি জানতে পারে একদা আমি ছিলাম এই বিদ্যালয়ের এক হাসি মুখ।
যদি কেও জিজ্ঞেস করে, “এতদিন পর?”
তখন আমাদের প্রত্যেকের উত্তর ই হয়, “কেন নয়?”
মোহাম্মাদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এন্ড কলেজ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য:
- স্নেহা সালাম
- ১৮ই মে, ২০২০
আরো পড়ুন: