বাড়ির পূর্ব দিকটায় তখনো ঘর ওঠেনি। শ্যাওলাধরা দেওয়াল ধরে বেড়ে উঠেছে কিছু গুল্ম আর একটা ডুমুর গাছ। পুরো বাড়িই তখন আমার খেলাঘর। বলা ভাল আমার রাজ্য, আর আমি সেই রাজ্যের রাজা। খুব ছোটবেলায় খেলতে খেলতে হঠাৎ একদিন দেখি আমার রাজ্যে কিছু অতিথিও থাকে। ডুমুর গাছটার দুটো পাতা দিয়ে সংসার পেতেছে এক টুনটুনি। তার দুটো বাচ্চা সারাদিন ডাকাডাকি করে কিচিরমিচির করে। তাদের ঘরটা ঠিক আমার হাঁটুর উচ্চতায়।
আমি মাটিতে বসে কান পাতি। বুঝতে চেষ্টা করি ওরা কী বলছে।ওদের ক্ষুধা পেয়েছে ভেবে রান্নাঘর থেকে চাল আনি, ডাল আনি।ওরা কিছু খায় না। আমি মন খারাপ করে থাকি। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে মা’র গলা জড়িয়ে প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা মা, আমার টুনটুনিরা কিছু খায়না। না খেলে ওরা বেঁচে থাকে কিভাবে?’ ‘ওরা খায় বাবা। ওদের মা খাইয়ে দেয়।”তোমার মতো?”হ্যাঁ, আমার মতো।’
এটা জানবার পরও অতিথী আপ্যায়নের প্রাণান্তকর চেষ্টা চলেছে। ওরা হয়তো খায়, কম খায়- এই ভেবে সান্ত্বনা খুঁজেছি। এক ঝড়ো সন্ধ্যায় যখন বৃষ্টি নামবে নামবে করছে তখন রাজার কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ল। ঝড়ে তার অতিথীদের কী হবে? সে বুদ্ধি করে একখানি ভাঙা টিন দিয়ে সে রাত্রিতে রক্ষা করল তাদের বাসাটা।
এভাবে দিন যেতে লাগল। বাচ্চা টুনটুনিরা একটু একটু বড় হতে লাগল। এবং একদিন রাজা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল অতিথীদের সময় শেষ। তারা চলে গেছে অন্য কোথাও।
আমার শিশুমন ভেঙে গেল কাচের মতো। ভাবলাম পাখিরা কতো অকৃতজ্ঞ!অবুঝ পাখি আর অবুঝ আমি কেউ কাউকে বুঝলাম না।
ওটা ছিল জীবনের প্রথম কষ্ট, শোক কিংবা বিচ্ছেদ।এরপর বড় হতে হতে আমি কোন একদিন ঠিক জানলাম, ভালোবাসা শর্তহীন। ততোদিন অবধি ঐ শোক জিইয়ে রেখেছিলাম আমি। 🙂
লেখকঃ ক্যাডেট, জয়পুরহাট গার্লস ক্যাডেট কলেজ।
Comments are closed.