-এই একটি ছোট্ট শব্দে কি এক রহস্য আছে যেন! পৃথিবীর সকল শান্তি, তৃপ্তি, বিশ্বাস, আস্থা আর নির্ভরতার আধার হলেন মা। মায়ের ঋণ পরিশোধ করবার ক্ষমতা কারও নেই,হবেও না কোনোদিন। পৃথিবীর প্রতিটি মা কী দীর্ঘ সময় গর্ভে ধারণ করে,অসহ্য প্রসব বেদনা সহ্য করে পৃথিবীর আলোতে আনেন তার সন্তানকে । আর সে যদি হয় কন্যা সন্তান সেই মা-সন্তানের সম্পর্কে তৈরি হয় অন্যরকম অদৃশ্য এক বন্ধন। মা যেন অজান্তেই হারিয়ে যায় তার নিজের ফেলে আসা জীবনে। লালন করতে থাকেন কত স্বপ্ন তার ফুটফুটে রাজকন্যাকে ঘিরে। মা-মেয়ে সম্পর্ক কীভাবে হবে মধুর?
ঘুম পাড়ানি গান থেকে শুরু করে মা তার স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে ঠাকুরমার ঝুলি, রাজকন্যা, পরী, দৈত্য- এমন সব হাজারো গল্প বলে যান তার মিষ্টি মেয়েকে। মায়ের এই মমতার বলয়ে মেয়ে তৈরী করে নেয় নিজের কল্পলোকের এক সুন্দর স্বপ্নপুরী। সে স্বপ্নপুরীতে নির্ভয়ে, আনন্দে, নিঃসঙ্কোচে বড় হতে থাকে মায়ের রাজকন্যা। এই রাজকন্যার সকল সমস্যার সমাধান এক নিমিষেই করে দেন মা। মায়ের আছে মায়ার যাদু। এভাবেই মায়ার যাদুতে মা-মেয়ের দিন চলে যায়। ঝড়ের রাতে বিজলীর শব্দে চমকে যাওয়া মেয়েটি যে মায়ের আঁচলে মুখ লুকাতো বা দৌড়োতে গিয়ে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেলে যে- “ও মা গো!” বলে চিৎকার দিত, সেই ছোট্ট মেয়েটি সময়ের সাথে সাথে কবে যে বড় হয়ে গেল! তা মা-মেয়ে বুঝে উঠার আগেই হয়তো একদিন কোন মত বিরোধ কালো মেঘের মত দেখা দিল। সেদিন সেই স্বপ্নপূরীর আকাশেও কাল বৈশাখীর ঘন কালো মেঘ দেখা যায়। আর ওদিকে মায়ের মমতার বলয়ে জমতে থাকে মান-অভিমান। এত কষ্টে, এত যত্নে-শ্রমে লালিত প্রতি মূহূর্তের প্রতিদানের হিসেব কষেন তিনি। সেই নিবির, দৃঢ় বন্ধনেও যেন দু জনই একা হয়ে পড়ে তখন। অথচ কষ্টটা এই পবিত্র সুন্দর সম্পর্কে কেবল এক পরত ধূলোর মত। দিন বদলের হাওয়ায় নিজেদের বুঝে নিলেই সব একদম আগের মত রঙ্গিন!
একটি মেয়ের প্রথম ও চিরকালের বন্ধু তার মা। তবে যদি মেয়েকে সমাজের বেড়াজালে টেনে শাসন-বারণে বড় করতে যান, সে চিত্র বলবে- বন্ধু কম, শত্রু বেশী। হয়তো বলবে শ্ত্রুও আপন। অথচ কোন মা তার মেয়ের খারাপ চান? শাসন-বারণ যা করেন মেয়ের ভালোর জন্যই । কিন্তু জানেন কি? মা হিসেবে আপনি যেমন আলাদা সত্তা, তেমনটি আপনার মেয়েও। যতই নিজের মনের মত মানুষ করে তোলেন! আপনার কার্বন কপি সে কখনো হতে পারবে না। আপনি হয়তো মত-বিরোধ হলে বলবেন বিদ্যাবুদ্ধি দিয়ে এত কষ্ট করে কি পেলেন জীবনে? এমন ভাবনাটা একেবারেই ভুল। আপনি আপনার সন্তানকে বুদ্ধি দিতে পারেন, তবে তাকে বোধ তৈরি করে দিতে পারবেন না। মেয়ের এবং আপনার বেড়ে উঠার পরিবেশ দুটো কিন্তু এক নয়, ফারাক কিছু থাকবেই। আপনি রবীন্দ্র সঙ্গীত পছন্দ করেন। মেয়ে হয়ত ব্যান্ড সঙ্গীত পছন্দ করছে । এ দোষের কিছু নয়। মেয়ের পছন্দের গান নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করবেন না ভুলেও। বরং একটু না হয় নতুনকে গ্রহন করুন। আপনি যদি আপনার মেয়ের পছন্দের গান শোনেন, হয়ত আপনার মেয়েও তেমনি আপনার পছন্দের রবীন্দ্র সঙ্গীত কখনো শুনবে। এভাবে শুধু গান নয়, প্রতিটি পছন্দের ক্ষেত্রে এভাবেই গুরুত্ব দিন।
এমন একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং মা-মেয়ের মধ্যে থাকা চাই যেন সকল দ্বিধা ভুলে মেয়ে সব কষ্ট-সুখ মায়ের কাছে বলতে পারে। এমনকি উঠতি বয়সের অজানা কোন প্রশ্ন যদি মনের কোণে উঁকি দেয় তাও যেন মায়ের কাছেই বলতে পারে অকপটে। আমাদের সমাজের একটি পরিচিত দৃশ্য হল সন্তানকে আয়ত্বে আনার উদ্দেশ্যে এ ধরনের কোন কথোপকথন হলে মায়েরা তার মেয়েদের উপর রেগে যান। “পাকামো” বা “বাজে সঙ্গে মিশে যাচ্ছে”- বলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কিন্তু একটু বুঝিয়ে যদি বলেন যে –”মা এখনো এসব বিষয় তোমার জন্য না” কিংবা “আমি পরে সময় হলে তোমাকে বলব”, তাহলেই কিন্তু কৌতুহল কিছুটা হলেও কমে।
আর যতটুকু সম্ভব তা মেয়ের সাথে তখনই শেয়ার করা ভালো। কোন বিষয়ে মেয়ে অযথাই ক্রোধ প্রকাশ করলে, “আপনিও বেয়াদবির চূড়ান্ত”- বলে মারধর করবেন না। একটু সময় নিন। ভালো করে বুঝিয়ে, গল্প করার ছলে মেয়েকে বলুন কোন আচরণে আপনি কষ্ট পান। দেখবেন মেয়েও তার ভুল বুঝতে পারবে। বুঝতে চেষ্টা করুন আপনার মেয়েটা আসলে কী চায়।
কালের পরিক্রমায়, নিজের কোলেপিঠে লালিত-পালিত মেয়েটি আজ সম্পূর্ণা। যে পথে হেটে মেয়েকে চলতে শিখিয়েছেন, সেই চিরচেনা পথেই আজ মেয়ের হাত ধরে মায়ের বিচরণ। সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও আজ মেয়ের সাথে পরামর্শ করে নেন। এমনকি কোন দাওয়াতে কোন শাড়ি ভালো মানাবে সে কথাও আজ মেয়ের মতামতের উপর ছেড়ে দেন। মায়ের আদরের মেয়ে তখন যেন চোখ বন্ধ করে দেখতে পায় মায়ের পুরোনো অভিজ্ঞতার পথ। নিশ্চিন্তে অগ্রসর হওয়া যায় কেবল সেই পথেই।
মা-মেয়ে সম্পর্ক কীভাবে হবে মধুর হবে তখনি যখন দুইজন দুইজনকে বুঝবে। হাজারো সম্পর্কের ভীড়ে মা-মেয়ের সম্পর্কের তুলনা হয় না, তা সে যতই রাগ-অভিমান এসে ঝড় তুলুক না কেন! মনের গভীরে ভালোবাসার জোয়ারে সেই সমস্ত রাগ-অভিমান ভাঁটা পড়ে যায়। মেয়ে যতই বড় হোক না কেন, চিরজীবন সে মায়ের আঁচলেই সকল শান্তি, স্বস্তি ,সাহস আর তার সবটুকু সুখ খুঁজে পায়। মেয়ের সুন্দর জীবন গড়তে মায়ের ভূমিকা অসীম। পিতা-পুত্রের বিরোধ প্রতিকারে মায়ের ভূমিকা যেমন অসীম তেমনি মা-মেয়ে সম্পর্ক উন্নয়নে মায়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মা-ই হোক মেয়ের একমাত্র প্রেরনার উৎস।