এ যেন কোনো এক জাদুকরের কাঁধে ঝোলানো জাদুর থলে। ভেতরে হাত দিতেই অবিরাম মণিমুক্তা বেরিয়ে আসতেই থাকে। নাহ, আজ আমি কোনো রূপকথার গল্প শোনাতে আসিনি। তবে যা বলতে চাইছি সেটিও শুনতে রূপকথার মতোই শোনাবে। যদি দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থীর স্কুলব্যাগ হাতে নেন তা হলে সেখান থেকে কী বের হতে পারে? কিছু বই, খাতা, পেনসিল আর খেলার সামগ্রী। তার মধ্যে নিশ্চয়ই স্বর্ণ রৌপ্য কিছু থাকবে না। তবে আজ যার কথা বলব তার ব্যাগের মধ্যে শুধু বই-খাতা আর পেনসিল না সত্যি সত্যিই স্বর্ণ রৌপ্যে ভরা। টেবিলের ওপর থেকে ছোট্ট ব্যাগটা এনে সে যখন মেলে ধরল, তখন যেন জাদুকরের জাদুর থলের মতো সেই ব্যাগ থেকে এক এক করে ২৬টি গোল্ড মেডেল বেরিয়ে এল! এগুলো কি সে কুড়িয়ে পেয়েছে? তার কাছে কি আলাদিনের চেরাগের দৈত্য আছে যে তাকে এগুলো এনে দিয়েছে? নাহ, এর সবই সে অর্জন করেছে। ওর নাম মনীষা শংকর পাল। বাড়ি কক্সবাজার পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের আইবিপি মাঠ সড়কে। মনীষা পড়ছে কক্সবাজার সরকারি সেন্ট্রাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিতে। তার বাবা উদয় শংকর পাল কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর। মা জয়শ্রী নন্দী গৃহিণী। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট মনীষা।
দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া মনীষা কীভাবে ২৬টি স্বর্ণপদকের মালিক হলো? সে এগুলো দেশে বিদেশে গিয়ে প্রতিযোগিতা করে জিতে নিয়েছে। তাও কিন্তু যে সে প্রতিযোগিতা নয় বরং কারাতে প্রতিযোগিতা! মনীষা তাই দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়লেও বুক ফুলিয়ে হাবীবুর রহমান রচিত বিখ্যাত সেই কবিতার লাইন বলতে পারে ‘আমি কি আর কাউকে ডরাই? ভাঙতে পারি লোহার কড়াই’। মনীষাকে যদি প্রশ্ন করা হয় তুমি তো কারাতে জান। তোমার বন্ধুরা নিশ্চয়ই তোমাকে ভয় পায়? সে তখন মুচকি হেসে বলে- বন্ধুদের তো আর আমি মারব না। তা হলে ওরা আমাকে ভয় পাবে কেন? ওরা বরং আমার সঙ্গে ঘুরতে ভালোবাসে। ওরা মনে করে আমি সঙ্গে থাকলে ওদের কোনো ভয় নেই। আর তা ছাড়া কারাতে মূলত আত্মরক্ষার জন্য। মনীষাকে যদি প্রশ্ন করা হয় তুমি কি ব্রুস লি, জ্যাকি চ্যান এদের নাম জান? সে মাথা দুলিয়ে বলবে সে এদের নাম জানে না। নাম না জানলেও তাদের সেই বিদ্যায় খুবই পারদর্শিতা অর্জন করেছে।
মনীষার বয়স এখন ১০ বছর। ১০ বছরের ছোট্ট একটা মেয়ে, বেশ লাজুক স্বভাবের। ঠিকমতো গুছিয়ে কথাও বলতে পারে না। কিন্তু তার পড়ার টেবিলটা ভরে গেছে স্বর্ণপদকে। যার মধ্যে ছয়টি আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক এবং বাকি ২০টি দেশ-বিদেশের। আছে জাতীয় পর্যায়ে প্রথম, দ্বিতীয় হওয়ার আরও ছয়টি রৌপ্য ও ব্রোঞ্জপদক। আত্মরক্ষার কঠিন কৌশল কারাতে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে এসব পদক অর্জন করেছে সে।
মাত্র চার বছর বয়সে মনীষা কারাতে শেখা শুরু করেছিল। বাবা কারাতে প্রশিক্ষক হওয়ায় প্রথম দুই বছর সে কারাতের প্রশিক্ষণ নিয়েছে বাসায়। পরের তিন বছর কক্সবাজার সদরে অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়ামের দ্বিতীয় তলার হলরুমে আরও অনেকের সঙ্গে সে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে সে প্রশিক্ষণ নিয়েছে শহরের আবু সেন্টারের ইউনাইটেড কারাতে ক্লাব বাংলাদেশে। এখানে তার সঙ্গে প্রশিক্ষণ নেয় দেড় শতাধিক শিশু। এর মধ্যে মেয়ে ৮০ জন। সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার প্রশিক্ষণ চলে। স্কুলের পড়া শেষ করে সে নিয়মিত কারাতে অনুশীলন করে। প্রতিনিয়ত সে নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
ছয় বছরের প্রশিক্ষণে মনীষার অর্জন ঈর্ষণীয়। ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীদের হারিয়ে সে ছয়টি স্বর্ণপদক জিতেছে।
মনীষার বাবা উদয় শংকর পালই তার প্রশিক্ষক। বাবা প্রশিক্ষক হওয়ায় খুব ছোটবেলা থেকেই মনীষা মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে প্রশিক্ষণকেন্দ্রে যাওয়া আসা করত। অন্য ছেলেমেয়েদের কারাতে শিখতে দেখে মনীষারও ইচ্ছা জাগে শেখার। বাবাকে বলে বাবা আমিও শিখতে চাই। মেয়ের এমন আবদারে তিনি না করেননি। কারাতে প্রশিক্ষণে মোট ২৬টি কাতা বা শেডো ফাইট বা ধাপ থাকে। মাত্র দুই বছরের মাথায় মনীষা রপ্ত করে নেয় ১৬টি কাতা। প্রশিক্ষকদের মতে যা ১৬-১৭ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের পক্ষেও অনেক সময় সম্ভব হয় না। পাশাপাশি ব্ল্যাক বেল্টের জন্য ১০টি ডান থাকে। মনীষা ইতোমধ্যে দ্বিতীয় ডান সম্পন্ন করেছে। অদম্য ইচ্ছেশক্তি থাকলে যে অনেক কিছুই সম্ভব মনীষা নিজেই তার অনন্য নজির স্থাপন করে চলেছে।
আগামী ২৬ থেকে ২৮ জুলাই ভারতের কলকাতায় নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে ইন্টারন্যাশনাল কারাতে প্রতিযোগিতা ২০২৪। সেখানে বাংলাদেশ দলের হয়ে অংশ নিচ্ছে ব্ল্যাক বেল্টধারী মনীষাও। নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারত, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীদের সঙ্গে লড়বে সে। যার ঝুলিতে ২৬টি স্বর্ণ পদক শোভা পাচ্ছে সেই মনীষা এবারও যে সফল হবে তা আমরা আশা করতেই পারি। আর মনীষার প্রতিটি সাফল্য যে বাংলাদেশেরই সাফল্য সেটা বলাই বাহুল্য। মনীষা ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানে ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কারাতে প্রতিযোগিতা ২০২০’-এ একক কারাতে (কাতা মহিলা) বিভাগে অংশ নেয়। সেই প্রতিযোগিতায় মোট ৯ জন প্রতিযোগী ছিল। তখন মনীষার বয়স মাত্র ৬ বছর! তার বিপরীতে অন্য প্রতিযোগীদের বয়স ছিল ১৬ থেকে ১৭ বছর! এত বড় মানুষ দেখে ভয়ে যে কেউ মুষড়ে পড়তে পারে, নাম তুলে নিতে পারে। কিন্তু মনীষা একটুও ভয় পায়নি। নিজের ওপর তার অগাধ বিশ্বাস ছিল। দূরন্ত সাহসী মনীষা নিজের আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে সেবার সেই প্রতিযোগিতায় ষষ্ঠ হয়েছিল। তখনই ধারণা করা হচ্ছিল ছোট্ট মনীষা একদিন অনেক নাম করবে। ওই বছরই সে চট্টগ্রামে ‘শাহজাদা চ্যালেঞ্জ কাপ ২০২০’-এ দুটি বিভাগে (জুনিয়র গার্লস কাতা ও কুমি) অংশ নেয়। উভয় বিভাগে প্রতিযোগী ছিল ১৫ জন করে। সবাইকে পেছনে ফেলে দুই বিভাগেই চ্যাম্পিয়ন হয় মনীষা। এরপর শুধু তার এগিয়ে যাওয়ার গল্প। সর্বশেষ গত ২৫ জানুয়ারি কক্সবাজার সৈকতের লাবণী পয়েন্টে অনুষ্ঠিত বিচ ফ্রেন্ডশিপ কারাতে প্রতিযোগিতা ২০২৪-এ মেয়ের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয় সে।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সেই ভবিষ্যৎকে আমরা যেভাবে নির্মাণ করতে চাইব সেটি আসলে সেভাবেই হবে। শিশুরা হলো নরম কাদামাটির মতো। তাকে আমরা যে শেপ দিতে চাই সেটা সেই শেপে গড়ে ওঠে। একটি চারাগাছকে আপনি যত ভালোভাবে যত্ন নিবেন সেই গাছ থেকে তত ভালো ফল পাবেন এটা আশা করাই যায়। আমাদের শিশু কিশোর কিশোরীদের আমরা যেভাবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করব তারাও সেভাবেই গড়ে উঠবে। ওদের মধ্যে বড় হওয়ার স্বপ্ন বুনে দিতে হবে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে যা করণীয় তা তাদের করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই কেবল তারা সফল হবে। মনীষা নামের ছোট্ট কিশোরী তারই বাস্তব উদাহরণ।
মনীষার স্বপ্ন কারাতেতে বিশ্ব জয়ের মাধ্যমে দেশের সম্মান বৃদ্ধি করবে। একদিন অলিম্পিকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে সে প্রতিনিধিত্ব করবে এবং স্বর্ণপদক জয়ের মাধ্যমে দেশের সম্মান বৃদ্ধি করবে।
লেখাটি দৈনিক খবরের কাগজে প্রকাশিত।