১.
কয়েকদিন থেকেই মনটা পালাই পালাই করছিল।ঢাকা থেকে দূরে কোথাও—আরো দূরে।হঠাৎ ছোটবোন ফোন করে জানতে চাইলো ও কক্সবাজার যাচ্ছে আমি যাবো কিনা। প্রথমে ইচ্ছে হলো যাই,পরে ভাবলাম এতো দূরে—এই গরমে, না থাক।অন্য সময় যাবো।যদিও সমুদ্র আমার ভীষণ প্রিয়।কিন্তু আমার বোন গরমকে পাত্তা দিলোনা। বললো—চলোতো ভালো লাগবে।গরমের দিনে গরমতো থাকবেই।ঢাকা তখন রোদের তাপে উত্তপ্ত নগরী,শেষ পর্যন্ত সমুদ্রেরই জয় হলো।মন বললো—চলো যাই।
পাঁচ এপ্রিল দুপুরের প্লেনে দু’বোন কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।চিটাগং হয়ে কক্সবাজার,যদিও নামতে দেয়নি আমাদের বিমান থেকে।তবুও চিটাগং এয়ারপোর্টতো দেখা হলো।আবার দুইটা পনের মিনিটের মধ্যেই কক্সবাজার।একদিনের জন্য,অতএব হাতের ব্যাগেই প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র নিয়েছি।মালপত্রের কোন ঝামেলা ছিলোনা।
আমাদের দলের অন্য তিনজন আগেরদিনে এসেছিলো।তাদের একজন ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে আমাদের নিতে এসেছিলো।এসি গাড়িতে বসে আরাম পেলাম।তখন বেলা তিনটা।ক্ষিদে পেয়েছে,তাই প্রথমেই গেলাম পউশি হোটেলে লাঞ্চ করার জন্য।অনেক রকম খাবার এবং খাবারের মান বেশ ভালো।বিশ রকম ভর্তা একটা প্লেটে,এছাড়াও রূপচাঁদা মাছ,ডাল,ভাত,সবজির একটা আইটেম।খুব তৃপ্তি করে খেলাম।
খাওয়া শেষ করে হোটেলে ছুটলাম।ওখানে আমাদের দলের আরো দু’জন আছে।হোটেল ‘বীচ ভিউ’ রুমে ঢুকে ভালো লাগলো।সুন্দর রুমটা।দরজা খুলে ব্যালকনিতে গেলাম।ওয়াও! হাত বাড়ালেই সমুদ্র।আরেকবার সমুদ্রের প্রেমে পড়লাম।সমুদ্রের ঢেউ গর্জন করে আছড়ে পড়ছে সৈকতে।আমি স্তব্ধ সমুদ্রের বিশালতায়।
একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে সমুদ্র দেখতে বের হলাম।তখন ভরা জোয়ারের সময়।সমুদ্র উত্তাল।সূর্য অস্ত যাচ্ছে।আস্তে আস্তে করে ডুবতে ডুবতে হঠাৎ সমুদ্রের মধ্যে টুপ করে ডুব দিলো লাল সূর্যটা।ইস! তন্ময় হয়ে দেখছি।হঠাৎ ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো পায়ের উপর।পড়ে যাচ্ছিলাম,সঙ্গীরা হাত বাড়িয়ে ধরলো।ছবি তুলছি,হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ পড়লো।আরে এটা আরেকটা সুর্য নাকি!
না—চাঁদ উঠেছে।
আমি এবার অবাক হয়ে দেখলাম,সমুদ্রে কোন ঝিনুক নেই! আগে ঢেউয়ের সাথে অনেক গুলো ঝিনুক উঠে আসতো।কোথায় গেল?
এর পর বার্মিজ মার্কেটে চলে গেলাম।টুকিটাকি কিনলাম।ততোক্ষণে গরমে অস্থির।হোটেলে ফিরে এসে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে আবার খেতে চলে গেলাম হোটেল পউশিতে।শুনলাম ‘অফ সিজন’ বলে লোক একটু কম।সিজনের সময় অনেক ট্যুরিস্ট থাকে। আমার কিন্তু ভালোই লাগছিলো।
২.
সকালে সমুদ্রের সাথে দেখা হলো একটু দেরিতে।পাশের হোটেলে নাস্তা খেয়ে নিলাম।এদের খাবার,আতিথেয়তা ভালো লাগলো।তখনি সিদ্ধান্ত নিলাম দুপুরে ওখানেই খাবো।
এরপর ছুটলাম ইনানী বীচের দিকে।এর আগে আমি দেখিনি।ইনানী একটি দ্বীপ।একটা সেতু দিয়ে কক্সবাজারের সাথে যোগাযোগ।কক্সবাজার থেকে ইনানী সতের কিলোমিটার দূরে।মেরিন ড্রাইভ রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটছে ইনানীর দিকে।রাস্তার একপাশে পাহাড়, আরেক পাশে সমুদ্র।একদিকে পাহাড়ের মৌনতা,আরেক দিকে উদ্দাম সমুদ্র।প্রকৃতির কী বৈপরীত্য।মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল এই বুঝি ঢেউ এসে গাড়ির উপর পড়লো।
সমুদ্র এগিয়ে আসছে—তাই অনেকটা জায়গা বালির বাঁধ দিয়ে আটকে দিয়েছে মানুষ।ইনানী সমুদ্র সৈকতে পৌছে দেখলাম তখন জোয়ারের সময়।মূল ভূখণ্ড থেকে বীচে যেতে একটি সেতু পার হতে হয়।সেতুর অর্ধেকটাই পানিতে ডুবে আছে জোয়ারের জন্য।
এই যাহ! আমি পার হবো কি করে?
ইতিমধ্যে আমার ছোট দলের সবাই জেনে গেছে আমি তেমন শক্তপোক্ত নই।অতএব দলের একজন তার হাত বাড়িয়ে দিলো।সেতুর তখন অর্ধেকটাই পানির নিচে।অনেকটাই ভিজে গেলাম।বালির মধ্যে হেঁটে সমুদ্রের কাছে গেলাম।এখানকার সমুদ্রকে আমার অনেক ভয়ংকর মনে হলো।মনে হলো একটু অন্যরকম।ভয় ভয় করছিলো আবার ভালোও লাগছিলো।এই বীচে লোকজন কম,এখানে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে নানা রকম পাথর চলে আসে।একটা পাথর নিয়ে আবার সমুদ্রে রেখে এলাম।অন্যের জিনিস নিতে হয় না!ইনানী বীচ অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হলো আমার কাছে।
ইনানী বীচ থেকে কক্সবাজার ফেরার পথে হিমছড়িতে নামলাম।হিমছড়িতে সিঁড়ি বেয়ে অনেক উপরে উঠলে সমুদ্র আর আকাশের মিলন অনেক দূর পযর্ন্ত দেখা যায়।কিন্তু অসম্ভব!আমি উঠতেই পারবো না।কী খাড়া সিঁড়ি।অতঃপর আমার বোন সহায় হলো। আস্তে আস্তে করে আমার হাত ধরে উঠালো।বাহ কী সুন্দর! আদিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র।যতদূর চোখ যায় শুধু আকাশ আর সমুদ্র মিলে মিশে একাকার।নিচে নামার সময় অবশ্য তেমন কষ্ট হলো না।একটু হেটেই হিমছড়ির ঝর্ণা। ঝর্ণার নিচে দাঁড়িয়ে কয়েকজন গোসল করছিলো।আমারও ইচ্ছে করছিলো কিন্তু অতো পাথরের উপরে উঠবো কী করে?
হাতে সময় কম।আমাদের ফিরতে হবে।হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিলাম।শুনলাম ঢাকায় খুব বৃষ্টি হচ্ছে,তাই প্লেন নির্ধারিত সময়ে উড়াল দিচ্ছেনা।অগত্যা রুমে ফিরে একটু বিশ্রাম নিলাম।
ফেরার সময় রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালাম।
অস্ফুটে বললাম, ‘সমুদ্র আমি আবার আসবো’!!
(পুনঃপ্রকাশিত)
Comments are closed.