রূপক নবম শ্রেণীর ছাত্র। তার বয়স ১৪ বছর। সে তার জীবনের অত্যন্ত পরিবর্তনশীল সময়ের প্রাথমিক পযার্য়ে আছে। কৈশর জীবনের এই অংশে এসে রুপক তার চারপাশের পরিবেশকে আগের মত মানিয়ে নিতে পারছে না। রুপকের মা বাবা চাকুরীজীবি। তাদের পরিবার মধ্যবিত্ত। কিন্তু ১৪ বছরের রুপক যখন তার আশেপাশের পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলার আপ্রাণ চেষ্টা করে তখন সে হোচট খায়। রুপক অষ্টম শ্রেণীতে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে কিন্তু গোল্ডেন পায়নি। রেজাল্টের দিন বাবা তাকে খুব মেরেছে। মায়ের মুখে একটিই কথা তুই গোল্ডেন পেলিনা কেন আমি আমার বান্ধবীদের কিভাবে মুখ দেখাবো?
রুপক ক্লাসে যায়, সেখানে ক্লাসে তাকে কেউ পছন্দ করেনা। রুপক যে বেঞ্চে বসে সেখানে কেউ বসতে চায় না। ক্লাসের ছেলেরা ফুটবল খেলে, ক্রিকেট খেলে কিন্তু রুপক এসব খেলতে পারেনা। বাবা তার ব্যষ্ততার ফলে কখনো তাকে মাঠে নিয়ে যেতে, খেলা শেখাতে পারেনি। রুপক এসব দেখে মনের মধ্যে নিজেকে শান্ত করে।কিন্তু বুকের কষ্ট কাউকে বলতে পারেনা। ক্লাসের ছেলেরা প্রত্যেকেই দামী মোবাইল ব্যবহার করে। রুপক যখন তাদের মধ্যে নিজেকে দেখে নিজের উপর তার ঘৃণা হয়। নিজের উপর বিরক্ত হয়। মনের মধ্যকার হতাশা তার হৃদয়ে হানা দেয়। বলে “রুপক সামনে দেখো, স্কুলের করিডোরের সামনে ফাঁকা উচু স্থান থেকে লাভ দাও, সব যন্ত্রনা শেষ”। রুপক এগিয়ে যায় কিন্তু বাবা মায়ের কথা ভাবে পিছু হটে যায়। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান সে। কিভাবে এতো স্বার্থপর হতে পারে।
ছুটির দিন রাস্তায় সে ক্লাসের অনেক ছেলেকে দেখে কেউ দামী ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে না হয় কেউ ভিডিও বানাচ্ছে কিছু ছেলে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যায় সে মুখ ফিরিয়ে নেয়, মুখ শক্ত করে রাখে। কিন্তু ভিতরে সে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। রাতে খুব সাহস করে বাবাকে বলে বাবা আমিতো ক্লাস নাইনে পড়ি আমাকে একটা ফোন কিনা দিবে। ক্লাসের সবার কাছে.. রুপক কথা শেষ করতে পারেনা। ততক্ষণে তার বাবা তাকে দুটো চড় মেরেছেন। রুপক নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে তার ঘরের দরজা বন্ধ করে। অন্ধকার ঘরে সে কাঁদে। তার চোখের জল আর থামছে না। নিজেকে সে ঘৃণা করে জীবনকে ঘৃণা করে। নিজের অসহায়ত্বের জন্য নিজের উপর কষ্ট পায়। মনের মধ্যে এক আশ্চর্য ব্যকুলতা কাজ করে। আগে তো এমন ছিল না, আগেতো কখনো আমার এতো খারাপ লাগতো না। এই দুই বছরে কি হলো! আমি কি ভুল করেছি। খোদা তুমি আমাকে ক্যান্সার দাও আমি মরতে চাই। খোদা আমাকে এই কষ্ট থেকে মুক্ত করো প্লিজ।
রুপক এই বিষন্নতা, মানসিক অবসাদ, হীনমন্যতার মাঝে থাকতে চায় না। আগে সে নিজেকে বলতো “রুপক একদিন তোমার সময় আসবে, সব ঠিক হয়ে যাবে, বিশ্বাস রাখো”। কিন্তু এখন সে আর নিজেকে তা বলতে পারেনা। সে যেন এমন এক দৌড় প্রতিযোগীতায় আছে যার কোন শেষ নেই। সে ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত। সে থামতে চায় কিন্তু পারে না।
আমরা যে রূপকের কথা বলতে চেয়েছি সে রুপক একটি কাল্পনিক চরিত্র হলেও আমাদের সমাজে রূপকদের ছড়াছড়ি।তার জীবনে বর্তমান সময়ের কিশোর কিশোরীদের জীবন দেখা যায়। জীবনের অনুসন্ধানে পর্যায় হিসেবে পরিচিত কৈশর বয়স। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় বলা চলে। রুপকের মধ্যে যে সব সমস্যা দেখা যায় তা অন্য সকল তার সমবয়সীদের ক্ষেত্রেও সমান। ১৩ থেকে ১৯ বছরের এই সময়ে কিশোর কিশোরীরা পৃথিবীকে চিনতে শুরু করে। এসময়ে তাদের অনেক বন্ধু হবে যাদের কাছ থেকে সে বিভিন্ন ভুল জিনিষ শিখবে কিন্তু ভালো উপদেশ দিয়ে সাহায্য করার মত বন্ধু খুব কম থাকবে।
কিশোর কিশোরীদের মধ্যে এ বয়সে নিজেকে অন্যের কাছে উপস্থাপন করার প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়। তারা দেখাতে চায় তারও এখন বড় হয়ে গেছে। কিন্তু তখনই এই বয়সের কঠিন বাস্তবতার সামনে তারা মুখ থুবড়ে পড়ে। এই বিশেষ সময়ে তারা যখন অসফল হবে তখন অতিদ্রুত তাদের মধ্যে হতাশা ও বিষন্নতা কাজ করে। তারা নিজেদের মনের মধ্যে হারিয়ে যায়।
আমিও রুপকের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। যেখানে আমি নিজেও অনেক কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু একজন ভালো বন্ধুর সহায়তায় আমি আবার নিজের পথ খুঁজে পেয়েছি। আমার মতো অনেকের মনেই এই সময়ে অনেক প্রশ্ন থাকে।
- আমার সাথে কেন এমন হচ্ছে?
- ওর যা আছে তা কেন আমার নেই?
- কেন সব কিছু এতো কঠিন লাগে?
- বাবা মা কেন আমার মতামতকে গুরুত্ব দেয়না?
- আমি কেন তাদের মতো হতে পারিনা?
এই কেন এর উত্তর খুঁজতেই আমরা যখন ব্যস্ত তখন জীবনের এই কঠিন কিন্তু প্রাণ খুলে বেঁচে থাকা, আনন্দ করার সময় সম্পর্কে আমরা ভুলে যাই। রুপকের জীবনে ফিরে যাই সেখানে এক পর্যায়ে দেখা যায় রুপক আত্মহননের পথ বেছে নিতে চায় কিন্তু পারেনা।
সারা বিশ্ব্ এই কিশোর বয়সেই সবচেয়ে বেশি কিশোর কিশোরী মানসিক অবসাদ ও হতাশার জন্য আত্মহত্যা করে।মূলত তাদের মধ্যে জীবনের কাছে পরাজিত হওয়ার মনোভাব কাজ করে। চলে যায় তাজা প্রাণ যারা একটু ধৈর্য ধরলেই এক উজ্জল ভবিষ্যত তাদের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু এর জন্য স্বাভাবিক ভাবেই সমাজ বলবে ছেলে মেয়েগুলো যে এই বয়সে কি পেয়েছে! বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিতা মাতারা এখনো তাদের সন্তানের সাথে খোলাখুলি ভাবে সমস্যা গুলো সম্পর্কে কথা বলতে পারে না। তেমনি সন্তানদের মধ্যে তাদের পিতা মাতা বিষয়টি কিভাবে নিবেন এই বিষয়ে দুঃশ্চিন্তা থাকে। পক্ষান্তরে বিদেশে পিতা মাতা তাদের সন্তানকে এই বয়সে তাদের কেন এর উত্তর দিতে যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। তাছাড়া উন্নত দেশগুলিতে পরিবারে সন্তান ও পিতা মাতার মধ্যে মতামত প্রদানের প্রবনতা বাংলাদেশের খুব কম পরিবারে লক্ষ্য করা যায়। পিতা মাতার সাথে সন্তানের সম্পর্ক হবে বন্ধুর মতো যাতে কিশোর বয়সে তাদের সকল সমস্যার সমাধান ও কেন এর উত্তর জানার জন্য পিতামাতা সর্বদা তাদের সাহায্য করেন।
কিশোর বয়সের এ সকল সমস্যা স্বাভাবিক কিন্তু কিছু মানসিক সহযোগিতা এবং পারস্পারিক বন্ধু সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমেই হয়তো ছেলে মেয়েদের বিভিন্ন মানসিক কষ্ট হতাশা থেকে দূরে রাখা যাবে। হয়তো বাঁচানো সম্ভব হবে কিছু হারিয়ে যেতে চাওয়া প্রাণ। তাই এই বয়সে পিতা মাতার মধ্যে এই মনোভাব রাখা উচিত যেন তাদের কিশোর কিশোরী সন্তানের অস্বাভাবিক ব্যবহার দেখলে তাদের সাথে মুক্তভাবে আলোচনা করতে পারে।
আমরা জানি নিজের সন্তানের সাথে সব বিষয়ে কথা বলার মত পরিবেশ এখনো গড়ে ওঠেনি আবার সন্তানেরাও তাদের বাবা মায়ের কাছে সব কিছু খুলে বলতে পারেনা।বন্ধুদের কাছে বলবে তেমন বন্ধু কোথায়?সবাই হাসাহাসি করবে কিংবা তাদের যে অভিজ্ঞতা তা দিয়ে কিছু বলা তাদের জন্য খুবই কঠিন।অন্যদিকে বড় ভাই বোন বা পরিচিত ভাইদের বলতেও লজ্জা লাগে ফলে আমাদের কিশোর কিশোরীদের সমস্যাগুলো আর সমাধান করা হয়না মনের মধ্যে থেকেই যায়। এই সব কথা বিবেচনা করে ছোটদেরবন্ধু তাদের দুহাত প্রশস্থ করে রেখেছে খুলে রেখেছে মনের দুয়ার। ছোটদেরবন্ধু সব সময় চায় কিশোর কিশোরী ভাই বোন বন্ধুরা তাদের যে কোন সমস্যার কথা ছোটদেরবন্ধুর সাথে শেয়ার করুক এবং তাদের সমস্যাগুলো মিটিয়ে নিক।এমন অনেক কথা আছে যা কাউকে বলতে পারেনা বলা যায়না কিংবা বলা হয়না সেসব কথাও নির্দ্বিধায় ছোটদেরবন্ধুকে বলা যায়। সে সেসব শুনে নিশ্চই ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিবে। ছোটদেরবন্ধু সব সময় নিশ্চয়তা দিয়ে একটা কথাই বলে “Your Secrets Safe with me” সুতরাং যে কোন সমস্যাকে মনের মধ্যে পুশে না রেখে ছোটদেরবন্ধুর সাথে শেয়ার করো দেখবে তোমার ভুলগুলো সমস্যাগুলো দূর হয়ে গেছে এবং তুমি একটি অনাবিল সুন্দর জীবন পেয়েছ।
পরিবারের বড়দেরকে বলতে চাই আপনারা যখন আপনাদের সন্তানের সাথে তাদের কোন বিষয়ে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন তখন চেষ্টা করুন আমাদেরকে জানাতে এবং আমাদের সাথে আপনার কিশোর কিশোরী সন্তানদের যোগাযোগ করিয়ে দিন।আমরা বন্ধু হয়ে ভাই হয়ে তাদের জন্য ভালোবাসা বিলিয়ে দেব। তাদের সমস্যাগুলি আমাদের নিজেদের মনে করে সমাধান করবো।
কিশোর বয়সের সমস্যাগুলোকে হার মানিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ও নিজের উপর আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি করো। জীবনকে তখন অসাধারণ এক রোলার কোষ্টার লাগবে।
লেখকঃ পূর্ণ সিয়ন সাংমা
মহম্মদপুর মডেল স্কুল এন্ড কলেজ।
Comments are closed.