ঘোর অন্ধকার। বাইরে ঝম ঝম বৃষ্টি। শীতল বাতাসে ৩০০০ স্কয়ার ফিট বাসাটিতে সবাই আরাম করে ঘুমাচ্ছে। শুধু জেগে আছে তানিয়া নামের এক কিশোরী। জানালা ধরে দাড়িয়ে বর্ষণের স্নিগ্ধতায় আনমনা চোখে সে মুগ্ধতা কুড়াচ্ছে! মনে মনে ভাবছে, “ইশ! যদি টিনের ঘরে বৃষ্টি উপভোগ করতে পারতাম! টিনের চালে বৃষ্টির কথা কতো কাব্যে, উপন্যাসে পড়েছি। যদি সত্যি সত্যি টিনের ঝম ঝম শব্দে নিজেকে রাঙাতে পারতাম, তাহলে কতোই না ভালো হতো!” ঘুম পালানো বর্ষণের মুগ্ধতায় কিশোরী মন আরো চঞ্চল হয়ে ওঠে। ইচ্ছা করে উপন্যাসের মতো কফির মগ হাতে নিয়ে ছাদে ছুটে যেতে! চিৎকার করে তার বলতে ইচ্ছা করছে, “জোরে! আরো জোরে!”
.
.
চাদরটা ভেজা ভেজা লাগছে। ঘুম ভেঙে গেল কিশোরী ফরিদার। আতঙ্কিত চোখে দেখলো তার মাথার ওপর টিনের চালের ফুটো দিয়ে টপটপ করে পড়তে থাকা পানি তার বিছানা ভিজিয়ে দিয়েছে। ভাবলেশহীন চোখে কিছুক্ষণ ভেজা চাদরের দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে গেলো বিছানা থেকে। পাশে ঘুমিয়ে থাকা ২ বছরের ছোট ভাইয়ের কথা ভেবে ছুটে একটা বাটি নিয়ে আসলো। তারপর চালের ফুটো বরাবর বাটিটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো যেন চাদর আর না ভেজে। সময় চলতে থাকলো, বাড়তে থাকলো বৃষ্টি। ফরিদা ক্লান্ত চোখে বাটি হাতে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে বৃষ্টির প্রস্থান কামনা করতে লাগলো।
–
–
২…
-আম্মু, ওই বলটা কিনব।
-কোনটা? এইটা?
-না, ওই মাছের ছবিওয়ালাটা।
-ভাই, ওই বলটা কতো?
-দেড়শ টাকা।
বলটা পেয়ে ৬ বছর বয়সী নাহিদের খুশি আর ধরে না। বাসায় এসে খুব ছুড়াছুঁড়ি করে বলটা নিয়ে। বাবার সাথে মাঠে যায়, বলটা নিয়ে ছুটোছুটি করে। তার বাবা মুগ্ধ হয়ে ছেলের আনন্দ দেখে। রাতেও বলটা নিয়ে ঘুমায়। ২ দিন পর আর ভালো লাগে না ঐ বলটা, ঘরের এক কোণে পড়ে থাকে মৃতের মতো। নাহিদ নতুন খেলনার বায়না করে। কোন কিছুই যেন শৈশবের রং ধারণ করতে পারে না, দূরন্তপণা যেন আবদ্ধ থাকতে চায়না অল্প কিছুর ভেতরে। নতুন খেলনা আসে, নাহিদের কল্পনার রাজ্য আরো রঙিন হয়, আরো গভীর হয় তার বেড়ে ওঠার তৃষ্ণা।
.
.
– আফু দেহো, ওই ভাইয়াগুলা বল দিয়া খেলতাছে।
চোখে এক রাশ উত্তেজনা নিয়ে ৯ বছর বয়সী বোন মরিয়মকে বলল ৫ বছর বয়সী মনির,
– ওরা কি খেলোয়াড়? টিভিতে খেলে?
– হ রে ভাই, আমারো তাই মনে হয়।
– আমিও বড় হইয়া হ্যারার মতোন টিভি তে খেলুম।
– তুই বল খেলতে পারস?
– পারুম না কেন, খুব পারি।
কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে মনির খেলা দেখে। উদয়াচল ক্লাব মাঠে ক্লাবের ছেলেরা অনুশীলন করছে। হঠাৎ মনির বলল-
– আমারে একটা বল কিনা দিবি আফু। আমার খুব মনে চায় হ্যারার মতোন বল দিয়া খেলি।
মরিয়ম ভাইয়ের তাকায়, কিছু বলে না। ছোট্ট ভাইটাকে খুব ভালোবাসে মরিয়ম। নিজের অজান্তেই মনে মনে ভাই কে বল কিনে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে।
মরিয়ম সাধারণত ভিক্ষার সব টাকাই মা কে দেয়। কিন্তু এখন থেকে সে ভিক্ষার টাকা থেকে ২ টাকা করে নিজের কাছে লুকিয়ে রাখে, বাকিটা মায়ের হাতে তুলে দেয়। আটদিন ধরে টাকা জমানোর পর ১৬ টাকা নিয়ে সে একটা মুদির দোকানে গেল।
– একটা বল দেন।
– কোন বল নিবা?
– খেলার বল।
দোকানদার একটা টেনিস বল বের করে দিলো।
– কতো কইরা?
– ৩০ টাকা।
– ১৬ টাকার মইধ্যে বল নাই?
– না, পিংপং বল আছে, ২০ টাকা। এর কমে নাই।
মরিয়ম চুপ হয়ে গেল। ৩০ টাকা জমাতে কতোদিন লাগবে মনে মনে হিসাব করতে করতে মাঠে এল। মন খারাপ করে ভাই কে খুজতে লাগলো। মনির হঠাৎ পেছন থেকে এসে বলল,
– আফু দেখ।
মনিরের চোখ চকচক করছে, হাতে একটা কাঠের বল।
– কই পাইলি? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো মরিয়ম।
– ভাইয়ারা খেলতাছিলো। মাঠের কোণে দুইডা বল রাইখা দিছিলো। আমি আস্তে কইরা একটা বল নিয়া আসছি, অরা দেহে নাই।
মরিয়ম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। খুশিতে উচ্ছাসিত হয়ে বলটা হাতে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল মনির। এই ৫ বছরের অবুঝ শিশুটা কে “চোর” বলে চিহ্নিত করতে যে সমাজের একটুও বাধবে না তা সে জানে না এখনো!
লেখক : মালিহা নামলাহ
মোহাম্মাদপুর প্রিপারেটরী স্কুল এন্ড কলেজ