আমি তাকে বলি,
– ভিক্ষা করো না, পড়াশোনা কর।
সে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়,
– পড়াশোনা করলে কি ভাত পাওয়া যায়?
আমি বলি,
– হ্যা, তুমি আমাদের কাছে পড়তে এসো। আমরা প্রতিদিন দুপুরে ভাত খাওয়াই।
– কতোক্ষণ পড়াইবেন?
– দুই ঘন্টা।
সে মনে মনে হিসাব করে, তারপর বলে,
– দুই ঘন্টা ম্যালা সময়, পুষবো না। ট্যাকা কম হইলে মায়ে রাগ করব।
– আমরা তোমাকে প্রতি মাসে টাকাও দেব। তোমার মা কে বলো, কেমন?
– কতো ট্যাকা দিবেন?
দর কষাকষি তে আমি তখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তবু ধৈর্য্য ধরে বললাম,
– পাঁচশর কম দেব না।
সে আবার মনে মনে হিসাব করলো।
– আইচ্ছা, আমু নে।
এমনভাবে বলল যেন অল্পে রাজি হয়ে আমাকে করুণা করেছে। আমি ওকে নিয়ে দোকানে গেলাম। এডভান্স কিছু না দিলে আবার মনে থাকবে না স্কুলে আসার কথা। জিজ্ঞেস করলাম,
– দুপুরে খাওয়া হয়েছে?
– না, হয় নাই।
বেশি টাকা ছিলো না আমার কাছে, অলটাইম বাটার বন কিনে দিলাম একটা। সেটা নিয়ে সে চলে গেল। একটা হাসিও উপহার দিলো না। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ওদের মতো বাচ্চাদেরকে নিয়েই তো আমি কাজ করি।
ওর বয়স ৬/৭ বছর। এই বয়সী বাচ্চাগুলো সাধারণত কোমলমতী আর মিষ্টি হয়। হ্যা, তবে পথশিশুরা ১৫/১৬ বছর বয়সে রুক্ষ আর নিষ্ঠুর হয়ে যায়, তাও আমার দেখা। তবে ৬/৭ বছর বয়সেই এতোটা রুক্ষ সাধারণত কেও হয় না। এই ভিন্নধর্মী শিশুটিকে আমার ঠিক পছন্দ হলো না।
পরেরদিন ক্লাস করাচ্ছি। সেই বাচ্চাটিও এসেছে। দেখলাম, ওকে চেনে আমার কিছু শিক্ষার্থী, মনে হলো, যে কোন কারণেই হোক ওকে তারা পিছন্দ করে না। কারণও বুঝতে পারলাম কিছুক্ষণ পরই। আধা ঘন্টা পার হতে না হতেই সে একটি ছেলের সাথে তুমুল মারামারি বাধিয়ে দিলো। অনেক কষ্টে থামালাম ওদের। ওকে নিয়ে আমি একপাশে চলে এলাম। বললাম,
– তোমার নাম যেন কি?
– জামিলা।
– জামিলা, তুমি ওকে মারলে কেন?
– অয় আমার মায়েরে গালি দিছে।
– ও একটা পচা কাজ করেছে, কিন্তু তুমি তো ওকে মেরে আরো পচা কাজ করলে, তাই না?
– আমার মায়েরে যে গালি দিব, তারে আমি আস্তা রাখুম না। আমি অনেকক্ষণ ধরে তাকে বুঝালাম, কিন্তু কোনোই লাভ হলো না। মনে হলো আমার কথাগুলো একটি কঠিন পাথরে লেগে ফিরে আসছে, ভেদ করতে পারছে না কিছুতেই।
ক্লাস শেষ করে সবাইকে খেতে দিলাম। দেখলাম জামিলা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্লেটের দিকে, খাচ্ছে না। আমি ওর কাছে যেয়ে বললাম,
– কি হয়েছে? খাচ্ছ না কেন?
জামিলা কোন কথা বলল না।
– ক্ষুধা নেই?
এবারও সে নিশ্চুপ। একটুপর বলল,
– আমি একটু আইতাছি।
এই বলে সে বাইরে চলে গেল। একটু পর একটা পলিথিন এনে প্লেটের খাবার গুলো পলিথিনে ভরে ফেলল। ততোক্ষণে বাকি বাচ্চারা পেট ভরে খেয়ে উঠেছে। আমি জামিলার কাণ্ডকারখানা দেখে একটু অবাক না হয়ে পাড়লাম না। কারণ জিজ্ঞেস করায় কোন উত্তর পেলাম না। পরেরদিনও জামিলা একই কাজ করলো, ভাত পলিথিনে ভরে নিলো। এই দুইদিনে আমি তাকে একটিবারও হাসতে দেখিনি। সবসময় কেমন যেন অন্যমনস্ক। যে কথায় অন্য বাচ্চারা হেসে কুটিকুটি হয়, সে কথায়ও সে মুখ ভোতা করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
তৃতীয় দিন ক্লাস শেষ হওয়ার পরের ঘটনা। সব বাচ্চাদের সাথে জামিলাও চলে যাচ্ছিলো, আমি পেছন থেকে ডাকলাম,
– জামিলা, একটু এদিকে আস।
সে আসলো। আমার পাশের জায়গাটা দেখিয়ে বললাম,
– এখানে বস।
আমার পাশে নির্ভয়ে বসলো সে। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– তোমার বাসা কোথায়?
– বেরিবান্দ।
– বাসায় কে কে আছে?
– আমার মায় আর ছোট দুই ভাই।
– মা কি করে?
– কিছু না।
– কিছুই করে না?
– না।
– কেন?
– মায়ের অসুখ।
– কি অসুখ?
– জানি না, বিছানার তন উঠতে পারে না।
– কতোদিন ধরে অসুখ?
– ম্যালা দিন। ২-৩ বচ্ছর হইব।
– তোমার বাবা কোথায়?
– মায়ের অসুখ হওয়ার পর বাপে কই জানি চইল্যা গেছে।
– তোমাদের চলে কিভাবে?
– আমি ট্যাকা আনি, আমার ট্যাকায়ই চলে।
– এই ভাত কি তোমার মা আর ভাইদের জন্য নিয়ে যাও?
জামিলা হ্যা সূচক মাথা নাড়লো। তার মুখ অসম্ভব গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। আমি তাকে এক হাত দিয়ে বুকে টেনে নিলাম। সে অঝোরে কাঁদলো। এতো কষ্ট ঐ ছোট্ট বুকটার ভেতরে কিভাবে জমে ছিলো কে জানে! একটু পরি সচেতনভাবে চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়, বলে,
– আমি যাই, ভাই দুইডা না খাইয়া আছে।
আমি কিছু বললাম না। সে হাঁটা শুরু করলো। আমি শুধু তাকিয়ে দেখলাম, সংসারের বোঝা কাঁধে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একটি শিশু!
যে সময়টা শিশুরা খেলাধুলা করে কাটায়, সে সময়টা জামিলা পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করে! যে বয়সে শিশুরা পরিবারের আদর পাওয়ার চিন্তায় উদগ্রীব থাকে, সে বয়সে জামিলা পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার চিন্তায় মগ্ন থাকে। দায়িত্বের ভার সামলাতে সে তার আবেগ- অনুভূতিটুকুও পায়ে পিষে ফেলেছে, গলা টিপে মেরে ফেলেছে নিজের শৈশবকে! অভিজ্ঞতার ঝুড়ি নিয়ে ৭ বছর বয়সী জামিলা বিচরণ করছে সেই একই চারণভূমি তে, যেখানে তোমার আমার ৭ বছর বয়সী বোন পুতুল খেলায় মত্ত!
এরপর থেকে জামিলা আর স্কুলে আসে নি। কেন আসে নি তা জানি না। বাচ্চাদের কাছ থেকে তেমন কোন তথ্য পাইনি ওর ব্যপারে। তারপর কাজের ব্যস্ততায় ভুলেও গিয়েছিলাম ওর কথা। মাঝেমাঝে মনে পড়ে, বুকটা হু হু করে ওর জন্য। এই ব-দ্বীপেই কতো শত জামিলারা আসে যায়, কয়জনের কথা আমরা জানি? ওর জন্য কিছু করতে পারিনি ভেবে কষ্ট হয়, কিন্তু কিছুই তো করার নেই। সুতা কাটা ঘুড়ির মতোই ছন্নছাড়া ওরা, ওদের কি আর খুঁজে পাওয়া যায়? তাই ভুলে যাওয়াটাকেই সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছে আমার। আসলে সত্যিকথা বলতে, জামিলাদেরকে কেও মনে রাখে না।
লেখক : মালিহা নামলাহ
মোহাম্মাদপুর প্রিপারেটরী স্কুল এন্ড কলেজ
Comments are closed.