মনের মাঝে অগোছানো অনেক চিন্তার উদ্ভব হয় মাঝে মাঝে। এগুলোকে হঠাৎ কলমের কালিতে লিখতে যাওয়া এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। চাকরি জীবনে এ ধরনের কাজকর্ম অনেকে খারাপ ভাববেন। জানি এহেন বিলাসিতা আমাদের সাজে না তবুও আশাকরি সবাই এটাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে নিবেন। এটা আমার বেখেয়ালি মনের কিছু চিন্তা ভাবনা আর অগোছালো কিছু স্মৃতিচারণ।
অতীত নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা স্মৃতিচারণ করা অনেকের কাছেই সময় নষ্ট করার মতো নিতান্তই এক পাপ কাজ। এই পাপে আমিও পাপী। তবে আমার ধারণা অতীতের দিনগুলোর সিঁড়ি বেয়ে আজ আমাদের বর্তমান অবস্থায় উঠে আসা,আর হয়তো ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়া। কেননা অতীত আমাদের সময়ের সাথে নিজেকে চিনতে শেখায় আর নিজের মাঝে পরিবর্তন গুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
“কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ” কথাটা বলতেই আমার মনে ভেসে ওঠে মেঘনা হাউজের শেষ কোনার ঐ ১ নম্বর রুমটা আর সেই সাথে অনেকগুলো মুখচ্ছবি। অনেকদিন আগের এক অন্ধকার রাতে এক কিশোর ঐ place এর জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ভরা হাউজের রাস্তাটা দেখে গোটা কলেজটাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। শুনেছি, হাজারো ক্যাডেটদের স্মৃতির আষ্টে পৃষ্ঠে বাধা এ হাউজ গুলো আর থাকবে না। কারো দোষ দেবোনা,কারণ এটা সময়ের দাবি, সময়ের প্রয়োজন। নতুনদের জন্য বরাবরই ছেড়ে দিতে হবে আমাদেরকে- আর এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
আমাদের সবার এইসব ফেলে আসা দিনগুলো একই কাদামাটিতে গড়া। ক্লাস 7 এ যেমন পিটি শেষে দৌড়ে যেতাম ওয়াশরুমে আগে গোসলের সিরিয়াল পাওয়ার জন্য, তেমনি ক্লাস 12 এ ও নাইট প্রেপ শেষে আমরা দৌড়িয়েছি, Phone call এ কে আগে 4 নম্বর মোবাইলটা পাবে বলে।
ক্লাস 7 এ মেঘনা হাউজের 21 নং রুমে জানালার সাথের বেডটা ছিলো আমার। তখন একাডেমী ব্লকের অনেকগুলো টয়লেটের উপরে পাখি এসে বাসা বাঁধত। পড়ন্ত বিকেলে গার্ডেনিং কম্পিটিশনে লাগানো সূর্যমুখীর বীজ খাওয়ার লোভে এক ঝাঁক পাখি এসে হামলে পড়তো বাগানে। বৃষ্টি হলে fallin হত শেডের নিচে আর হাউজের পিছনে ব্যাঙ ডাকতো প্রচুর।
ছুটি থেকে ফেরার মুহূর্তগুলো ছিল খুবই গল্পের। কৈশোরের দিনগুলোতে 20-22 দিনের সেই ছুটিগুলো ছিলো হুটহাট প্রেমে পড়ার মোক্ষম সময়। পাড়ার কোচিং এ এসে দেখা হওয়া মায়াবী মেয়েটা.. লজ্জা ভেঙ্গে যার সাথে কখনো কথা বলা হয়নি কিংবা রোজ বিকেলে private শেষে বাড়ি ফেরার পথে যেই মেয়েটা ক্ষণিকের জন্য বাঁকা চোখে তাকাতো, আমাদের বাসার ঠিক কতো পড়ে তার বাসা তা কখনো জানা হয়নি। এদের নিয়েও যে কত কল্পনাবিলাসী গল্প থাকতে পারে তা কে বলবে? এত গল্প সেই অপরিচিতাদের শোনালে নিদেনপক্ষে দুই একটা চিঠি অন্তত পাওয়া যেত। কয়েকজন পেয়েছেও। যাই হোক, এটা আমি জানি, চিত্র আর চরিত্রের পরিবর্তন হলেও ছুটি শেষে গল্পগুলো, এখনো আগের মতোই আছে।
আজও হয়তো নাইট প্রেপে সিক রিপোর্ট করতে কোনো ক্যাডেট যখন একা একা “জ্ঞানই আলো” পাহাড়টার সামনে দিয়ে মার্চ করে যায়,ল্যাম্প পোস্টের আবছা আলো আর উঁচু গগন ছায়ার ভয়ের সেই প্রাচীন অনুভূতি তাকে তাড়া করে। এই অনুভূতিতে যে কোনো হেরফের ঘটে না তা আমি ভালোভাবে জানি।
ডায়েরিতে, স্ক্রাববুকে কিংবা কবাটে পেপার কাটিং আমরাও লাগাতাম। ক্যাডেটের ব্যক্তিত্ব বোঝা যেত কাবার্ডে কে বা কার ছবি লাগিয়েছে তা দেখে। সেকালে কারোর কাবার্ডে রোনালদিনহোর ছবি থাকতো, তো কারো থাকতো শারাপোভার। ত্রুটি মার্জনীয়। খেলাধুলায় বিশেষ ভক্ত কখনোই ছিলাম না। শেতাঙ্গী কোনো তন্বীর প্রেমেও পড়তে পারিনি। তবে তখনকার বাংলা নাটকের মিথিলা কিংবা হিন্দি মুভির আলিয়া ভাটকে নিয়ে এই অধমের বিচিত্র কিছু পাগলামির স্মৃতি আছে। সুজন মাত্রই তা স্মরণ করতে পারেন। বাজি ধরে বলতে পারি এখনো কোনো না কোনো ক্যাডেট দূরে রুপালি কোনো নারীর বেতার প্রেমে সংক্রমিত হয়। চিন্তা নেই। এর ওষুধ ও আছে। সময় সবাইকে সুস্থ করে দেয়। আমিও হয়েছি, তাই জামিন থাকতে রাজি। শুক্রবারের অপশনালের না শেষ হওয়া মুহূর্তগুলো যদি কখনো শেষ না হতো! অনেক কিছুই করেছি হয়তো ঝোকের বশে,নয়তো না বুঝে। সবার দেখাদেখি কলেজ লাইফে যে কটা প্লেসে থেকেছি সবগুলোতে নিজের নাম লিখে রেখে এসেছিলাম। হয়তো সেগুলো আজ আর নেই।
কিছু কিছু রাতে একদম ঘুম আসতো না। আবার কোনো কোনো রাতে দু চোখের পাতায় ঘুম ঝুলে থাকলেও prep ড্রেস পড়ে সাবধান হয়ে থাকতে হতো। দেয়াল পত্রিকা অথবা কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ডিসপ্লের আগে এরকম রাত হামেশাই আসতো। কাজে একটু ফাঁকি দিয়ে সেসব রাতে ৩ তলার রেলি়ং এ দাঁড়িয়ে প্লেনের মিটিমিটি আলো দেখতে কিংবা হাউজের বারান্দায় এসে তারা গুনতে ভালো লাগতো। নাইট ডিউটি মাস্টার ঘুমিয়ে পড়লে এরকম নিষিদ্ধ রাত্রি বিলাস অনেক ক্যাডেট এখনো নিশ্চয়ই করে।
আজও রাত আসে, সেই “বৃহস্পতিবার” রাত। হাজারো ব্যস্ততার মাঝে বৃহস্পতিবার রাতটা আমরা ঠিকই এখনো স্মরণ করি। সেদিন থাকতো আমাদের ঈদ রাত। রাতে কোন হাউজ এ কোন মুভি দেখা হবে তা নিয়ে সকাল থেকে ক্লাসের হর্তাকর্তাদের চিল্লাচিল্লি, লাইটস অফের পর কোন রুমে কিসের আসর বসবে তার planning … এগুলো হয়তো এখনো আনমনে ভেবে উঠি।
সেদিনগুলো থেকে, জীবন আমাদের পেরিয়ে এসেছে অনেকখানি পথ। তবুও বলতে পারি, ঠিকই সেই আবার কারো না কারো পা নিশ্চয়ই পড়েছে। ভালো খারাপ ভাবিনা, দোষগুলো বাছিনা, ন্যায় অন্যায় মানিনা,শুধু বুঝি হৃদয়ের সবটুকু বালখিল্যতা মিটিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে হাউজের সামনে আম তলায় আম কুড়াতে ছোটা, রাতের অন্ধকারে ডাইনিং হলের পিছে কাঠাল চুরি করতে যাওয়া, গভীর রাতের ক্রিকেট খেলা নিয়ে নাইট ডিউটি মাস্টারের সাথে লুকোচুরি খেলার আনন্দের জন্য হলেও অন্তত এই পথগুলি আমি স্মৃতিচারণ করি। হাউজের গ্রিল দিয়ে তারাভরা আকাশের দিকে একলা তাকিয়ে নিঃসঙ্গতাকে উপভোগ করার সময়গুলো খুব মনে পড়ে।
কলেজ থেকে নেবার মতো নিয়েছি সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর স্মৃতি। সেগুলো হরহামেশাই মনটাকে নস্টালজিক করে তোলে।প্রিয় মুখগুলো তখন আর চাইলেই একত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো এক অদৃশ্য prefect এর “ক্যাডেটস, পিছনে ফিরবে, উল্টা ঘোর” কমান্ডে হয়তো আমাদের ফেলে আসা অতীতের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে ফেলে আসা দিনগুলির কথা।ব্যস্ত সময়ের মাঝে… meghna house এর ১ নম্বর রুমের জানালার পাশের সেই বেডটায়, গল্পের বই পড়ার মতো নিঝুম দুপুরগুলো হয়তো আজ আসেনা,কিন্তু অলিখিত এই গল্পগুলো মনে মনেই পড়ি,হয়তো মনে মনেই আবার ভুলে যাই।বিচিত্র বর্ণিল শৈশব কৈশোরের মায়া প্রাঙ্গন ঘেরা জায়গাটুকু অনেকগুলো আর্তনাদ নিয়ে স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে, বারবার,হাজারবার।
লেখকঃ নাফিজ বিন জামাল
(ম/১৫৮২,কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ)
Comments are closed.