বন্ধুত্ব তিন অক্ষরের এক শব্দ। অথচ এই শব্দটিই একসময় নীরব ঘাতক হয়ে উঠতে পারে আপনার টিনএজ সন্তানের জন্য। একটি শিশু তার শৈশবের খোলস থেকে বের হয়ে আসে যখন সে কৈশোরে পদার্পণ করে। কৈশোর এমন একটি সময় যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কেননা এ সময় একটি শিশু তার খোলস ছেড়ে যৌবনের পথে যাত্রা শুরু করে; এ সময় শরীরের অনেকগুলো হরমোন নিঃসৃত হয়, যেমন- ছেলেদের দাড়িগোঁফ গজায়, গলার স্বর মোটা হয়, মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হয়। এ সময় তারা না ছোট না বড়; তারা নিজেরাও তাদের এই আকস্মিক পরিবর্তনে হতবিহ্বল থাকে; কারণ ছাড়াই মন খারাপ থাকে, কান্না পায়, অনেক সময় নিজেকে নিয়ে অপরাধবোধেও অনেকে ভুগে থাকে।
আর ঠিক এ সময়টাই ছেলে ও মেয়ের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে তার ক্লাসমেট ও বন্ধুরা। কথায় আছে, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’ তাই খেয়াল রাখুন আপনার টিনএজ সন্তান কাদের সঙ্গে মিশছে। কারণ একটি ভালো বন্ধু যেমন সঠিক পথে চালিত করে ঠিক তেমনি একজন খারাপ বন্ধু ক্ষতির পথে নিয়ে যাবে। তাই পড়াশোনা যেমন শিক্ষার অংশ, ঠিক তেমনি একজন ভালো বন্ধু নির্বাচনও সন্তানের জন্য একটি বড় অংশ। কেননা এ সময় তারা এক স্বপ্নের জগতে বিচরণ করে। তারা অনেক সময় বুঝতে পারে না আসল ও নকলের ফারাক।
যুক্তরাষ্ট্রের সাইকোলজিস্ট ড. রেইনোল্ডস বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় বা বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে অনেক সময়ই অনেক প্রতারক, স্বার্থান্বেষী ও দুষ্ট চক্রের লোকজন কিশোর-কিশোরীদের বিপথে পরিচালিত করতে পারে বা ফাঁদে ফেলতে পারে। আর এখন তথ্য প্রযুক্তির যুগে সবকিছুই হাতের মুঠোয়। প্রবাদ আছে যে কিশোর-কিশোরীদের নিয়ন্ত্রণ করা আর একটি খাঁচায় রাখা সিংহকে বশ মানানো একই ব্যাপার। আর ঠিক এ সময়টাতেই মা-বাবার চেয়েও প্রিয় হয়ে ওঠে বন্ধুদের সঙ্গ। তাই সন্তানের সঙ্গে চেষ্টা করুন বন্ধু হয়ে ওঠার। চেষ্টা করুন জানতে সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হচ্ছে, অথবা কী ধরনের গেম পছন্দ করছে। তবে একটি বিষয়, কখনো ভুলেও তার ওয়ালেট, ফোন বা চিঠি অথবা ডায়েরি ঘাঁটতে যাবেন না। অন্তত তার সামনে তো নয়ই এবং আড়ালে করলেও তার অজান্তে করুন। কেননা এ সময় তার ব্যক্তিত্ব তৈরি হয় এবং সে নিজেকে তখন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে ভাবতে থাকে। তাই অযাচিত নজরদারিতে সে বিরক্ত হতে পারে।
সন্তানের বন্ধু নির্বাচনে কী বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে সে সম্পর্কে তাকে সাবধান করে দিতে পারেন। মনোবিদরা মনে করেন, সন্তানের বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে একটি পারিবারিক বলয় তৈরি করা বিশেষ জরুরি, যাতে করে সন্তানের গতিবিধি সম্পর্কে সহজেই জানা যায়। শৈশব থেকেই সন্তানের ভেতরে একটি পারিবারিক মূল্যবোধ, শিক্ষা ও আদর্শের জায়গা তৈরি করতে হবে। তার ভেতরে ভালো বিষয়গুলোর প্রতি উৎসাহ দিতে হবে আর খারাপ বিষয়গুলো সম্পর্কে সাবধান করতে হবে, যেন সে নিজেই তার বন্ধু নির্বাচনের সময় সেই ইতিবাচক বিষয়গুলোকে মনে রাখে। বয়ঃসন্ধিকালে একই রকম মানসিকতা বা একই ধরনের কাজ বা শখের প্রতি তাদের আগ্রহ আছে এই বিষয়গুলোর মিল হলে তারা একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্বে আগ্রহী হয়। তাই শৈশব থেকেই সন্তানের ভেতর ভালো অভ্যাস ও শখ গড়ে তুলুন।
কৈশোরের বন্ধু নির্বাচনে বিশেষ যত্নশীল হতে হবে, কারণ এই সময়টা তাদের আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে। বন্ধুদের একটি বিশাল প্রভাব এই সময়ে তাদের মনের ওপর পড়ে। বন্ধুত্ব এমন একটি বিষয় যা আস্থা ও ভরসার ওপর তৈরি হয়। তাই নিজস্ব মতাদর্শ, পারিবারিক শিক্ষা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যারা নিজেদের গড়ে তুলছে তেমন ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব গড়ে তোলা উচিত। এ ছাড়া কৈশোর ভীষণ সংবেদনশীল এক সময় এবং ঠিক এই সময়টাই তাদের নিজেদের গড়ে নেওয়ার সময়। এ সময় যদি তারা কোনো খারাপসঙ্গতে পড়ে যায় তবে সেটার চড়া মাসুল তাকে তো বটেই, পরিবারকেও সেই মাসুল বয়ে বেড়াতে হয়।