দেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ২০২১ সালে আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে। কোভিডের প্রাদুর্ভাবে ওই দুই বছর এই বয়সী প্রায় ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে।
আজ রোববার বাল্যবিবাহের ওপর এক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে এ তথ্য জানিয়েছে জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)।
রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বাল্যবিবাহ এবং শহরের বস্তি এলাকায় মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা’ শিরোনামে দুটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
দেশে ১৮ বছরের নিচের বয়সী মেয়েদের বিয়ে হলে তা বাল্যবিবাহ হিসেবে ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে জরিপ প্রতিবেদনে ১৫–১৯ বছর বয়সী গ্রুপ বিবেচনা করার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে অনুষ্ঠানে বলা হয়, জরিপকালে ১৯ বছর বয়সী বেশ কিছু মেয়েকে পাওয়া গেছে, যাদের বয়স ২০২০ ও ২০২১ সালের শুরুতে ১৮ বছরের নিচে ছিল।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনা মহামারির দুই বছরে ১৫–১৯ বছর বয়সী যে ২৭ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়েছে তাদের মধ্যে প্রথম বছর (২০২০) বিয়ে হয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশের ও দ্বিতীয় বছর (২০২১) বিয়ে হয়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশের।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিকস্) ২০১৯ অনুসারে, একই বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার প্রায় ৩৩ শতাংশ। আর ১৮ বছর বয়সের নিচে এ হার ৫১ শতাংশ।
ইউএনএফপিএর জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিডের কারণে ২০২০ সালে বাল্যবিবাহের হার কম হয়ে থাকতে পারে। তবে জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগের মত ছিল, কোভিডকালে বাল্যবিবাহ বেড়েছে। এই সময়ে বুলিংসহ নানা ধরনের সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বোধ করেছে। বাল্যবিবাহে মহামারি ও লকডাউনের প্রভাব সম্পর্কে জানতে আরও জরিপ ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
ইউএনএফপিএর সহায়তায় জরিপটি পরিচালনা করে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। ২০২১ সালের ডিসেম্বর ও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ২০টি জেলায় ২ হাজার ৮২০ জন মেয়ের ওপর জরিপ করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জেলায় জেলায় বাল্যবিবাহের হারের ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। যেমন রাঙামাটিতে বাল্যবিবাহ ৪ শতাংশ ও লক্ষ্মীপুরে ৪০ শতাংশ। জরিপের সময় দেখা গেছে, বিবাহিত ওই মেয়েদের ১৫ শতাংশ ছিল অন্তঃসত্ত্বা। বিবাহিত মেয়েদের মাত্র ২৪ শতাংশ স্কুলে ফিরেছে।
মাসিক নিয়ে নানা সীমাবদ্ধতা
মাসিক বিষয়ে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় এক হাজার কিশোরী ও নারীকে অন্তর্ভুক্ত করে পরিচালনা করা হয় জরিপ। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এখনো ৪২ শতাংশ মেয়ে/নারী মাসিকের সময় কাপড় ব্যবহার করে। মাসিকের বিষয়ে তাদের মধ্যে নানা কুসংস্কার কাজ করে।
কোনো কোনো মেয়ে/নারী বলেছেন, বেশির ভাগ সময় টয়লেটে ভিড় থাকে বলে মাসিকের জন্য ব্যবহৃত কাপড় ভালোভাবে পরিষ্কার করতে পারেন না তাঁরা। ধোয়ার জন্য তাঁরা রাত বা ভোরের সময়কে বেছে নেন।
স্যানিটারি প্যাড ব্যবহারকারী মেয়ে/নারীদের ৬৮ শতাংশ নিজে প্যাড কিনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। মাসিকে ব্যবহৃত কাপড় ধোয়ার পর ৮০ শতাংশ মেয়ে/নারীই বাড়ির ভেতর গোপন জায়গায় শুকাতে দেন। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মাসিক ব্যবস্থাপনার জন্য মেয়েদের আলাদা টয়লেট থাকা, কোথায়, কীভাবে ব্যবহৃত প্যাড ফেলতে হবে, তা শেখানোসহ সচেতনতা সৃষ্টির পরামর্শ দেওয়া হয় প্রতিবেদনে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হাসানুজ্জামান বলেন, মাসিক নিয়ে প্রচলিত সংস্কার থেকে বেরোতে হবে। বাবা–ভাইকেও সচেতন হয়ে পরিবারের মেয়ে সদস্যটির প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। বাল্যবিবাহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিবেদনে প্রথম বছরে বাল্যবিবাহ কমলেও দ্বিতীয় বছরে বেড়েছে দেখানো হয়েছে। এটা কিছুটা বিভ্রান্তিকর লাগছে। কারণ, সরকারের কাছে যে তথ্য আছে, সেটির সঙ্গে তা মেলে না। বাল্যবিবাহ কমাতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভীন বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ থেকে বাল্যবিবাহ নির্মূলের অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করছে সরকার। বাল্যবিবাহ রোধে অধিদপ্তর আরও প্রকল্প হাতে নিচ্ছে।
মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, কোভিডে বাল্যবিবাহ বেড়েছে, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া বেড়েছে, শেখার ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়েছিল। তবে বিবিএসের সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, বাল্যবিবাহ কিছুটা কমেছে, ঝরে পড়া সামান্য বেড়েছে। বাল্যবিবাহ ও ঝরে পড়া বিষয়ে গণমাধ্যমে যেভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, বাস্তবে তা ঘটেনি।
অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন ইউএনএফপিএর উপপ্রতিনিধি মাসাকি ওয়াতাবে। তিনি সমস্যা সমাধানে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।