ক্যাডেট কলেজের কঠোর নিয়মে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো আমার। মাত্র ১২ বছর বয়স তখন। সকাল ৫ টায় ঘুম থেকে উঠা, ৩ মাইল দৌঁড়ানো, খোলা গ্রাউন্ডে ঘন্টার পর ঘন্টা রোদের মাঝে খাকি ড্রেসে প্যারেড প্র্যাকটিস, বিকেলে বাধ্যতামূলক বাস্কেটবল কিংবা ফুটবল- ছোট্ট আমার জন্যে জীবনটা তখন বড্ড কঠিন।
পড়তে বসলে খুব দূর্বল লাগে, বাসার কথা মনে করে মন খারাপ হয়, ক্লাসে স্যারদের কথায় কেনো যেনো মনযোগ দিতে পারিনা। রেজাল্ট ভালো হবে বলে ভরসা পাইনা। তখন প্যারেন্টস ডে এলো। ক্যাডেট কলেজে মাসে একবার মা-বাবা তার সন্তানের সাথে দেখা করতে পারতেন। সময় ছিলো চার ঘন্টা। বাবাকে কাঁদতে কাঁদতে বললাম ‘আব্বু, আমি পড়া বুঝতে পারছিনা’।
আমার বাবা রাগ করলেন না, শাসন করলেন না বরং ঐ চার ঘন্টার মাঝে দু’ঘন্টা কি এক জাদুকরের মতো যত্ন নিয়ে, আবেগ নিয়ে, ধৈর্য্য নিয়ে আমায় পড়ালেন আর আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর কথাগুলো শুনলাম। পুরো মাসের পড়াটা ঐ দুই ঘন্টায় শেষ করলাম। রেজাল্টও ভালো করলাম। আজীবন বাবার কাছেই পড়েছি।
এমনকি ইউনিভার্সিটি লাইফেও হোস্টেলে যখন কম্পিউটার সায়েন্সের কঠিন সূত্রগুলোতে আটকে গিয়েছি- বাবার সাথে ফোনে কথা বলেছি। কি এক অদ্ভুত উপায়ে বাবার কাছেই সবকিছুর সমাধান পেয়েছি।
আর আমার মা? মা চরম ব্রিলিয়ান্ট। বিশ্ব অর্থনীতি কিংবা সাম্প্রতিক রাজনীতি- এসব নিয়ে কথা বললে আমার মায়ের মেধাটা বুঝতে পারি। মা ছাত্রজীবনেও ছিলেন ভালো ছাত্রী। বিলেতের ব্যবসায়ী বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। তবু ঐ সময়ের নিয়ম অনুযায়ী অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে গেলো। পড়ালেখা শেষ হতে হতে দুই সন্তান পৃথিবীতে চলে এলো।
সন্তানের জন্যে আমার মেধাবী মা তখন নিজের ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করে দিলেন। শুধু আমাদের পড়ালেন, অনেক পড়ালেন, দুই ছেলেকেই বিদেশে পড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বানালেন। একমাত্র মেয়েকে এসএসসি পরীক্ষায় বোর্ডে হাইয়েস্ট মার্কস পাওয়ালেন। সন্তানদের বড় করে আবার নিজে চাকুরি শুরু করলেন।
আমি যখন সাসেক্স ইউনিভার্সিতে সেমিষ্টার ফিস দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি, ফোনে মাকে বললাম ‘মা, আমি এক সেমিস্টার ড্রপ দিয়ে দেই’? মা কড়া গলায় বললেন ‘না, প্রয়োজনে আমি আমার সব গয়না বিক্রি করে তোমার ফিসের টাকা দেব তবু তুমি জীবন থেকে একটা দিনও নষ্ট করবেনা’। আমি দিন-রাত পরিশ্রম করেছিলাম, আমার নানাভাই- দিদি আমায় পড়ানোর জন্যে কল্পনাতীত ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মামা-মামীরা সবসময় পাশে ছিলেন- তাই ঐদিন আর আমার মায়ের কোনো গয়না বিক্রি করতে হয়নি।
আমার জীবনে পাওয়া সব শিক্ষকরাই অতুলনীয়। আমার বাবা ও মা উভয়েই পেশায় শিক্ষক। কতো সন্তানকে মানুষ করেছেন তারা। পুরো দেশে ছড়িয়ে আছেন আমার বাবার ছাত্ররা। বিদেশেও অনেকে বড় পদে চাকুরী করছেন, কেউ করছেন ব্যবসা। তারা প্রায়ই হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে এসে আমার বাবার খবর নেন, একবার পা ছুঁয়ে যান। দেখে আমার কি যে ভালো লাগে। এমন বাবা- মায়ের সন্তান হওয়াটা কতো না সৌভাগ্যের! একান্ত আমার কাছে শিক্ষক হিসেবে সেরাদের সেরা আমার মা-বাবা।
প্রতিবছর ৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। সকল শিক্ষকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সাধারণ শিক্ষক লেকচার দেন, ভালো শিক্ষক বুঝাতে পারেন আর মহান শিক্ষক ইন্সপায়ার করেন। আমি এক সাধারণ শিক্ষক হয়ে পথ চলছি আর স্বপ্ন দেখছি, চেষ্টা করছি যেনো কোনো একদিন মহান শিক্ষক হয়ে আমার স্টুডেন্টদের অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারি…