- টি এইচ মাহির
১)
দরজা খুলেই বাইরে বেরুতে যাচ্ছিলো বাবলু।ঠিক তখুনি পেছন থেকে মা চেঁচিয়ে উঠলেন,”অ্যাঁই বাবলু,কই যাচ্ছিস…ঘর থেকে এক পাও বের হবি না।”
ইদানিং বাবলুদের শহরে আতংক বেড়েই চলেছে।ছেলে ধরার আতংক।প্রতিদিন কোনো না কোনো ছেলে-মেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের শহর থেকে।দিনে দুপুরে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট বাচ্চারা।পুলিশও কোনো ক্লু খুঁজে পাচ্ছেনা,কে বা কারা বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে কিংবা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে ওরা। এই তো সেদিন ও বাবলুর স্কুলের এক বন্ধু হারিয়ে গেছে।স্কুলে বেশ হইচই পরে গেছে।মা-বাবারা আতংকে তাদের ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না।বাবলু নিজেও বেশ কিছুদিন ধরে স্কুলে যাচ্ছে না।অবশ্য যাচ্ছে না বললে ভুল হবে।বাবলুর মা বাবা যেতে দিচ্ছে না।ঘরে শুয়ে বসে দিন কাটছে না তার।তাই বাইরে বেরুতে চায়।অবশ্য একটা কাজও আছে।সাইদের বাসায় যেতে হবে।সাইদের কাছে বাবলুর বেশ কিছু বই আছে।কিছুদিনের জন্য পড়তে দেয় ।স্কুল না যাওয়ায় আর ফেরত নেয়া হয়নি।তাই বই গুলো আনতে হবে।শুয়ে বসে অন্তত বই পড়ে দিন কাটবে বাবলুর।বইগুলো আনতেই বাইরে বেরুচ্ছিল বাবলু কিন্তু মায়ের ডাকে ফিরে এলো।
এদিকে মা ছাদে কাপড় শুকাতে যাচ্ছেন।সেই ফাঁকেই আবার বেরিয়ে পড়লো বাবলু। সাইদদের বাসাটা বেশি দূরে নয়।বাবলুদের শহরটা কিছুটা মফস্বল এলাকা।বাড়ি ঘর কম।রাস্তাগুলোও ফাঁকা থাকে।তবে ইদানিং ছেলেধরার আতংকে আরো বেশি নিস্তব্ধ।কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে বাবলুর।সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সাইদদের বাসার গলির সামনে এসে পড়লো বাবলু।এই গলিটা বেশ বড়।গলিতে ঢোকার আগে একটা বড় ময়লা ফেলার ডাস্টবিন আছে।সিটি কর্পোরেশনের লোকেরা এসে ময়লা নিয়ে যায়।
এখানে এসে কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগলো বাবলুর।তার ভয়ে মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো একটা যান্ত্রিক শব্দ।মনে হচ্ছে ডাস্টবিনে কেউ রোবট ফেলে গেছে।একটু সাহসী হয়ে এগিয়ে গেল।ঠিক তখনই চারপাশ কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল।মনে হচ্ছে একশটা গাড়ির ধোঁয়া বাবলুকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে।কেমন ঝিম ধরানো গন্ধ।বাবলু ধীরে ধীরে মাটিতে পরে যাচ্ছে।যান্ত্রিকভাবে যেন কেউ কথা বলছে।বাবলুর কিছু বুঝতে পারছে না।তার কাছে পৃথিবীটা ঝাপসা হয়ে আসছে।
২)
“স্যার এই ছেলেটা তো অংকে কাঁচা।ওকে কেন ধরে এনেছি আমরা।আমাদের দরকার বুদ্ধিমান কেউ।যারা অংকে খুব ভালো।তাহলেই তো আমরা সারাজীবন বসে খেতে পারবো।আর অন্যদের গ্যালাক্সিতে হানা দিতে হবে না।”
“তুমি কি করে জানলে ছেলেটা অংকে কাঁচা?”
“স্যার আমি ওদের স্কুলের ঘুলঘুলি দিয়ে ডুকেছিলাম।ওরা খাতা দেখেছি।নাম তার বাবলু।অংকে খুব খারাপ নাম্বার পেয়েছে ছেলেটা।”
“ওহ হো! আবার ভুল কাউকে ধরে এনেছে শিরু আর বিরু।এরা তো কোনো কাজের না।এই নিয়ে সাইত্রিশ জন স্কুলের বাচ্চাকে ধরে এনেছে।একটাও তো আমাদের দরজাটা খুলতে পারলো না।”
আবার যান্ত্রিক শব্দে জেগে উঠলো বাবলু।দুইজন বিশাল রোবট আকৃতির লোক চেঁচিয়ে কথা বলছে।জায়গাটা একটা হলঘরের মতো।তবে কেমন যেন লোহার দেয়াল দিয়ে ষড়ভুজ আকৃতির ঘর।আর রোবট দুটোর কথাগুলো যান্ত্রিক শুনাচ্ছে।দুইজনে বাবলুর দিকে এগিয়ে এলো।
“তোমরা কারা”-বাবলু জানতে চাইলো।”আমাকে ধরে এনেছ কেনো?আমার হাত দুটো খুলে দাও।”
“দিবো তবে আমাদের একটা কাজ করে দিতে হবে।তবেই তুমি এখানে থেকে ছাড়া পাবে।বাকি যে সাইত্রিশ জনকে ধরে এনেছি সবাইকে ছেড়ে দিবো।”
“কি কাজ? আর তোমরা কারা?”
“আমরা হলাম এআই রোবট।এটা আমাদের গ্রহ।তুমি এখন আমাদের গ্রহে।”
“তোমরা আমার ভাষা বুঝতে পারছো কি করে?”
“কারণ আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট।মানুষের ভাষা বুঝে তাদের সাথে সেই ভাষাতেই কথা বলি।আমরা এআই দিয়ে অনেক কিছুই করতে পারি।ছোট থেকে বড় হতে পারি আবার বড় থেকে একদম মাছি আকৃতির আকার ধারণ করতে পারি। তবে একটা কাজ এখনো করতে পারি নাই।সেটা করতে পারবে পৃথিবীর মানুষ নামক প্রানীরা। তাই পৃথিবী থেকে বুদ্ধিমান বাচ্চাদের ধরে আনছি।শুনেছি মানুষের বাচ্চারা খুব বুদ্ধিমান হয়।”
“বাবলু তুমি কি কাজটা করবে?”-এবার রোবটদের বস বলল।এতোক্ষণ বাবলুর সাথে কথা বলছিল ছোট রোবটটা।
“কী কাজ?”-বাবলু শান্ত গলায় বলল।
“আমাদের গ্রহে মাটির নিচে একটা গোপন কুঠুরি আছে।আমার দাদা মৃত্যুর আগে আমাকে জানিয়েছিলেন।ঐখানে হাজার হাজার রত্ন লুকিয়ে আছে।ওইগুলো পেলে নাকি আমরা সারাজীবন বসে খেতে পারবো। তিনি বলেছিলেন এই কুঠুরি দরজাটা শুধু বুদ্ধিমান মানুষই খুলতে পারবে।আমরা এই পর্যন্ত সাইত্রিশটা বাচ্চাকে ধরে এনেছি।সবাই পড়ালেখা ভালো।স্কুলের ফার্স্ট স্টুডেন্ট।কিন্তু কেউ এই দরজাটা খুলতে পারেনি।ওদের কাউকে আর পৃথিবীতে পাঠাবো না।যদি তুমি এই দরজাটা খুলে দিতে পারবো তবে তোমার সাথে তাদেরকেও পৃথিবীতে পাঠাবো।”
“আমি পারবো।”-বাবলু বেশ সাহসের সাথেই বলল।যে করেই হোক তাকে পারতেই হবে।নাহয় বাকি সাইত্রিশ জনের মতো এই অচীন গ্রহেই পরে থাকতে হবে।
বাবলুকে রোবটরা একটা পাহাড়ের মতো জায়গায় নিয়ে গেল।পাহাড়ের নিচে একটা কুঠুরি।দেখে মনে হচ্ছে গুহা।পৃথিবীতে যেরকম থাকে।কিন্তু এখানে কিছুটা ভিন্ন অনেকটা বাংকারের মতো।
দরজায় একটা স্ক্রিন আছে।বাবলু সেখানে ট্যাপ করলো।সাথে সাথে একটা ক্যাপচা এলো।সেখানে লেখা ‘আর ইউ অ্যা রোবট?’।তারপর নিচে কিছু ছবি দেয়া।পাজল ধরণের।সেখানে লেখা নিচের কোনটি কোনোটি পাখি বাছাই করো।মোট নয়টা ছবি দেয়া।মুরগি,পায়রা,মাছি,মশা,মৌমাছি,হাঁস,প্রজাপতি,বাদুড় আর বানর।বাবলু পাখির ছবি হিসেবে তিনটা প্রানীর ছবির উপর ক্লিক করলো।মুরগি,পায়রা আর হাঁস।তারপর আই এম নট অ্যা রোবটে ক্লিক করলো।
সাথে সাথে সমাধান হলো প্রথম ধাপ।এদিকে রোবটরা সবাই হাত তালি দিলো।বাবলুর উৎসাহ দ্বিগুণ হলো।
তারপর এলো দ্বিতীয় ধাপ।দ্বিতীয় ধাপে দিতে হবে একটি চার অংকের পাসওয়ার্ড তাহলেই খুলে যাবে দরজা।আর সেই পাসওয়ার্ডের ক্ল দেয়া আছে স্ক্রিনেই।বাবলু এবার কেমন যেন ঘামতে শুরু করলো।কারণ এখানে দেয়া আছে অংক ধাঁধা।কিন্তু বাবলু তো অংকে কাঁচা।চার অংকে প্রথম তিন অংকের জন্য একটি ধাঁধা সমাধান করতে হবে তাহলেই প্রথম তিন অংক পাওয়া যাবে।
সেখানে লেখা,’একটি তিন অংকের সংখ্যা।আর দ্বিতীয় অংকটি প্রথম অংকের পাঁচগুণ এবং তৃতীয় অংকটি দ্বিতীয় অংকের চেয়ে দুই কম।’
বাবলু মনে মনে হিসাব কষলো প্রথম অংকটি যদি ১ হয় তবে দ্বিতীয় অংকটি হবে ৫;যেহেতু বলা আছে প্রথম অংকের পাঁচগুণ।আবার তৃতীয় অংকটি দ্বিতীয় অংক (৫) এর চেয়ে দুই কম,অর্থাৎ ৩।যেহেতু এখানে তিন অংক বের করতে হবে তাই প্রথম সংখ্যাটি ১ এর চেয়ে বেশি হতে পারবে না।কারণ প্রথম অংকটি যদি ১ এর চেয়ে বেশি হয় তাহলে দ্বিতীয় অংকটি পাঁচগুণ হলে দুইটি অংকের সংখ্যা হয়ে যাবে,শর্তের সাথে মিলে না।তাই বাবলু পাসওয়ার্ডের প্রথম তিনটি অংক পেল ১৫৩।এবার শেষ অংকটি খোঁজার পালা।পরের ধাঁধাটি পড়তে যাবে এমন সময় রোবটদের বস বললো,
“তাড়াতাড়ি করো বাবলু।আর মাত্র দুই মিনিট সময় আছে।ওই দেখো উপরে ঘড়িতে কাউন্টডাউন হচ্ছে।সময় শেষ হয়ে গেলে আবার এক বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে এই দরজার স্ক্রিন।”
বাবলুর হাত পা কাঁপতে লাগলো।বিড়বিড় করে পড়লো শেষ ধাঁধাটা।
‘১২+১=১ হলে ১০+৫= কতো হবে?’
বারো আর এক যোগে কখন আবার ১ হয়।এ কেমন ধাঁধা। বাবলু ভাবতে লাগলো।এদিকে সময় ফুরিয়ে আসছে।সে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে লাগলো।হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ধাঁধার সমাধান পেল বাবলু।পৃথিবীতে ঘড়িতে ১২টা আর ১টা মিলে হয় দুপুর ১টা।তাহলে ১০টা আর ৫টা যোগ করলে হবে দুপুর ৩টা।অর্থাৎ পাসওয়ার্ডের শেষ অংকটি হবে ৩।
বাবলু ধুরু ধুরু বুকে ১৫৩৩ লিখে পাসওয়ার্ড লিখলো দরজার স্ক্রিনে।তখন আর মাত্রা ত্রিশ সেকেন্ড আছে।পাসওয়ার্ড লিখতেই বাবলুর মন লাফিয়ে উঠলো খুশিতে আর সেই সাথে উল্লাস শুরু করলো রোবটরা।কারণ বাবলুর পাসওয়ার্ডটি সঠিক। কিন্তু একি! কুঠুরির দরজা খুলতেই দেখা গেল হাজার হাজার পিঁড়ি।বেতের মোড়া।এগুলো তো বাবলুর দাদীও বানাতে পারে।এই জিনিস নেওয়ার জন্যই বাবলুকে পৃথিবী থেকে নিয়ে এনেছে!
রোবটরা বললো এটাই তো বসে খাওয়ার জিনিসে।আমরা এখন থেকে পিঁড়িতে বসে খেতে পারবো।জানোই তো আমরা এআই রোবট, এসব শৈল্পিক বেতের পিড়ি বানাতে পারি না।