নূরুল আলম ছাত্র গড়ার চেয়ে মানুষ গড়ার কথাই ভেবেছেন বেশি। অবসর নেওয়ার পরও ভাবেন।
কেউ ঝাঁ-চকচকে চাকরির লোভ ছেড়ে দুর্গম কোনো পাঠশালায় জ্ঞানের আলো ছড়ানোকেই করে নিয়েছেন জীবনের মোক্ষ, কেউ নিজের কষ্টার্জিত আয়ের একটা বড় অংশ অকাতরে খরচ করেছেন অনগ্রসর কোনো গোষ্ঠীর শিক্ষার পেছনে। গ্রামবাংলার আনাচকানাচে ছড়িয়ে আছেন এমন হাজারো শিক্ষক।
স্কুললাগোয়া সবুজ চত্বরে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে পড়াশোনা করে ছেলে-মেয়েরা। প্রতিটি দলের সামনে একটি ব্ল্যাকবোর্ড। পাঠদানের মাঝে মাঝে ছাত্রদের বোঝার সুবিধার জন্য উপস্থাপন করা হয় বিষয়ভিত্তিক উপকরণ। আছে ভৌগোলিক ও উপকরণ নামে দুটি কক্ষ। ভৌগোলিক কক্ষে শহর, নগর, গ্রাম, নদ-নদী, জলপ্রপাত, আগ্নেয়গিরি, বন ও মরুভূমির মডেল। উপকরণ কক্ষে বিভিন্ন প্রাণী, গাড়ির মডেল, হাজারেরও বেশি খেলনা, ১০টি বড় গোলাপ ও ৩০টি মানচিত্র, বড় বড় কবি-সাহিত্যিক, রাজনীতিক ও বিজ্ঞানীর ছবি।
শ্রেণিকক্ষ ও ছাত্রাবাসগুলোর নামও ব্যতিক্রমী—দীপের আলো, ঊর্মিমালা, নয়নের নীড় ইত্যাদি। সামাজিক কর্মকাণ্ডেও ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপক উৎসাহ। বিশুদ্ধ পানি, খাবার স্যালাইন তৈরির পদ্ধতি, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা, শিশুদের টিকাদান বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে মাসে একবার বাড়ি বাড়ি যায় স্কুলের ছাত্র ব্রিগেড। কখনো কখনো নাটিকা করেও মানুষকে সচেতন করে। এলাকায় একবার ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে গেল।
কৃষি বিভাগ ঘোষণা দিল, যে যত ইঁদুরের লেজ জমা দিতে পারবে, তাকে তত পুরস্কার দেওয়া হবে। ব্যস, একদিনেই বাড়ি, বাঁধ, জমি ঘুরে ইঁদুর নিধন করে রেকর্ডসংখ্যক লেজ জমা দিয়ে পুরস্কার জিতে নিল ছাত্র-ছাত্রীরা। যেন এক মজার খেলা। নাটক আর সংগীত বিষয়েও ছাত্রদের ব্যাপক উৎসাহ। ছাত্র ও শিক্ষকদের নিয়ে গড়ে উঠেছে সমিতি। এর মাধ্যমে মাছ চাষ, সেলাই প্রশিক্ষণ, বৃক্ষরোপণ, মুরগি ও গরু পালনের মতো কাজ হয়। প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে দেওয়া হয় বাড়তি শিক্ষকদের বেতন।
এ রকম একটা স্কুলই গড়ে তুলেছিলেন নূরুল আলম। স্কুলটির নাম শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
১৯৮৪ সালে গাইবান্ধার এই স্কুলটিতে প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন নূরুল আলম। পরের বছরই জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯১ সালে বিদ্যালয়টিকে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি দেয় ইউনিসেফ। ১৯৯৬ সালে বিদ্যালয়টি জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। ২০০০ সালে জাতীয় পদক লাভ করে স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটি। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গঠিত সমবায় সমিতিও বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।
প্রতিবছরই এখানকার অনেক ছাত্র ট্যালেন্টপুল ও সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পায়। ইউনিসেফ বিদ্যালয়টির পরিচিতি ছাপিয়ে বিলি করলে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে এর নাম। মাঝেমধ্যেই বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে আসে দেশি-বিদেশি প্রতিনিধিদল। এ পর্যন্ত ২২টি দেশের প্রতিনিধিরা এই বিদ্যালয়ে এসেছেন।
অবশ্য আলম মাস্টারের অবসরগ্রহণের পর স্কুলটির সেই রমরমা আর নেই। স্থানীয় সমাজসেবী হাবিবুর রহমান যেমন বলছিলেন, ‘আলম স্যার স্কুলটির সম্মান বিদেশেও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এখন আর আগের মতো চলছে না শিবরাম।’
আমার বাংলা
অবসর নেওয়ার পর গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়কের ধারে আরেকটি স্কুল গড়ে তুলেছেন আলম মাস্টার। নাম দিয়েছেন আমার বাংলা মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠ। পিছিয়ে পড়া, বিত্তহীন শিশুদের জন্য এই স্কুল। ভাড়া জায়গায় ঘর করতে গিয়ে সর্বস্ব ব্যয় করেছেন। স্কুলটিতে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ৭০০ জন। আবাসিক শিক্ষার্থী আছে ৬০ জন। বিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, মনীষীদের ছবিসংবলিত প্রদর্শনী ঘর, বিজ্ঞানাগার, জীবজন্তুর মডেল কর্নার, সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের আলাদা কক্ষ, ৩০টি শ্রেণি শাখা দেখলে মন জুড়ায়।
নিজে পরিচালক হিসেবে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করলেও প্রতিদিনই ক্লাসরুমে ঢুকে ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা দেখেন। রোদ, বৃষ্টি যা-ই থাক, বিশেষ কারণ ছাড়া কখনো অ্যাসেম্বলিতে অনুপস্থিত থাকেন না নূরুল আলম। স্যারকে দেখলে ছাত্ররাও নেচে ওঠে। তিনি নিজের লেখা ও সুর করা গান করেন সবার সঙ্গে মিলে। গাইবান্ধা পিটিআইয়ের সুপার শামসিয়া আকতার বলেন, শিশুদের শিক্ষাদান কিংবা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার এই অসাধারণ ক্ষমতা সবার থাকে না। তিনি যা করেন সবই খেলাচ্ছলে।
প্রধান শিক্ষক মাহমুদা খাতুন বললেন, শিক্ষকদের প্রতিদিন নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে সমৃদ্ধ করেন নূরুল আলম। বোর্ডে একজন শিক্ষক কী লিখেছেন খেয়াল করে দেখেন তিনি। কাউকে পিঠ চাপড়ে বাহবা দেন, কারো ভুল শুধরে দেন। জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি বিষয়ে প্রশ্ন করলে হাসিমুখে উত্তর দেন, ‘আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি ছাত্র-ছাত্রীদের ভালোবাসা। জজ, ব্যারিস্টার, ম্যাজিস্ট্রেট, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, শিক্ষক যখন পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে, চোখের জল ধরে রাখতে পারি না।’
তথ্যসূত্রঃ কালেরকন্ঠ।