লেখাঃ লতা হামিদ
শান্তনুর আজকে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। এবার ও ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠলো। এখন স্কুল কিছুদিনের জন্য বন্ধ।এই ছুটিতে গ্রামে নানার বাড়ি যাবে। ওর বোনও যাবে।যদিও নানা নেই, মামা আছে। অনেকদিন পর যাবে। বাবাতো রাজিই ছিলনা, বলে গ্রামে অনেক পুকুর, তোমরা সাঁতার জানোনা। মাকে রাজি করালো। আগামী কাল যাবে। ওর আনন্দ দেখে কে! গ্রামে যাবে, খুব মজা হবে। স্কুল থেকে এসে ঝটপট ব্যাগ গুছিয়ে নিল।রাতে আনন্দে ঘুমই হলোনা।
বাবা যাচ্ছে না,এখন অফিস থেকে ছুটি নিতে পারবে না।বাবা বললো গ্রামে খুব শীত, গরম কাপড় বেশি করে নিয়ে যাও।ওদের সাথে ওর মামা যাবে। খুব সকালেই ওরা রওনা দিলো। মা খুব খুশি।অনেকদিন পর গ্রামের বাড়ি যাচ্ছে।পড়ন্ত বিকেলে ওরা পৌঁছালো।ওরা এসেছে শুনে সবাই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো। গ্রামটা দেখেই ওর ভালো লাগলো।উঠোনে ধান শুকোতে দিয়েছে। একটা মিষ্টি গন্ধ বাতাসে। কিন্তু বাবা ঠিকই বলেছে, খুব শীত। ও অবশ্য সোয়েটার পরে এসেছে। মামা ওকে জড়িয়ে ধরলো।সবাই হইহই করে বাড়িতে ঢুকলো। বাড়িটা ছিমছাম, পরিষ্কার। ওদের জন্য অনেক পিঠা তৈরি করে রেখেছে।খেয়ে দেয়ে মা তার ব্যাগ খুললো। সবার জন্য কিছু না কিছু এনেছে। সবাই খুশি।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। শান্তনু বাইরে বের হয়ে সিঁড়িতে দাড়াঁলো। দেখলো সাদা কাপড়ে জড়ানো কিছু দাঁড়িয়ে আছে। ও খুব সাহসী, আস্তে করে বাইরে নেমে পেছন থেকে কাঁধের উপর হাত রাখলো। চমকে একটা ছেলে ওর দিকে তাকালো। ওর বয়সী হবে। কি চাও?এখানে কেন? শান্তনু জিজ্ঞেস করলো। ছেলেটি বললো, আমার নাম জলিল।তোমার সাথে কথা বলার জন্য এসেছি।আমরা গরীব তাই ভয়ে ভিতরে ঢুকিনি।শান্তনু ওর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে এলো।দেখলো হাতটা ঠাণ্ডা,গায়ে একটা পাতলা চাদর। শান্তনুর খুব খারাপ লাগলো।ও ওর একটা সোয়েটার জলিলকে পরিয়ে দিলো।জলিল লজ্জা পাচ্ছিল।ওরা দুজনে অনেকক্ষণ গল্প করলো।ঠিক করলো পরেরদিন দুপুরে ওরা ছিপ দিয়ে মাছ ধরবে পুকুরে।
রাতে মামা ওকে চুপি চুপি বললো, রাতে জেগে থেকো। আমরা খেজুরের রস খাবো।অনেক রাতে মামা রস নিয়ে এলো। ও এর আগে কখনো রস খায়নি, খেয়ে ওর খুব ভালো লাগলো।পরদিন খুব সকালে পাখির ডাকে ওর ঘুম ভাঙ্গলো। দেখলো মামাও উঠেছে।মামা বললো, চলো গ্রামটা একটু ঘুরে আসি।ঘুরে ঘুরে ওরা একটা চায়ের দোকানে বসলো।চা গরুর দুধ আর গুড় দিয়ে বানানো।অন্যরকম স্বাদ।কিন্তু ওর খেতে ভালো লাগলো।
সকালে জলিল এলো।জলিল ওকে মার্বেল খেলা শেখালো।দুজনে কিছুক্ষণ খেললো।দুপুরে ওরা সবাই মামার সাথে পুকুরে গোসল করতে নামলো।ও সাঁতার জানেনা।তাই মামাকে ধরে থাকলো।ও ডুব দিতে ভয় পাচ্ছিল। সবাই হাসতে লাগলো।দুপুরে খেয়েদেয়ে জলিলের সাথে মাছ ধরতে বসলো।বাঁধানো ঘাট। জলিল শিখিয়ে দিচ্ছিল কিভাবে মাছ ধরে।হঠাৎ ওর ছিপে একটা মাছ উঠলো। ও আনন্দে এতো জোরে চিৎকার দিলো যে, সবাই দৌড়ে এলো।মামি বললো এই মাছটা শান্তনু খাবে।বিকেলে মামার সাথে ওরা নদীর পাড়ে গেলো।মামা বললো, চলো নৌকায় করে ঘুরে আসি।নৌকায় করে ওরা যাচ্ছে আর পাশ দিয়ে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ওদের নৌকার সাথে দৌড়াচ্ছে।শান্তনু ওদের দিকে হাত নাড়ছিলো।সন্ধ্যার দিকে ওরা ফিরে এলো।
জলিলের সাথে ওর খুব বন্ধুত্ব হলো।জলিল ওকে ওর স্কুলে নিয়ে গেল।স্কুলটা ভাঙ্গা, ওর মন খারাপ হয়ে গেল।ওদের স্কুল কত সুন্দর।ও জলিলকে বললো, একটু বড় হলে পর ওকে ওদের কাছে নিয়ে যাবে।
পরদিন মামা কাজে বাইরে গিয়েছে।ওরা ঠিক করলো নিজেরাই পুকুরে গোসল করবে। কারণ শান্তনু ছাড়া সবাই সাঁতার জানে।অতএব অসুবিধা নেই।ওরা এ ওর গায়ে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছিল গোসল করতে।শান্তনু ধাক্কা খেয়ে দূরে সরে গেল।ও হাবুডুবু খাচ্ছিল।জলিল দেখে ওকে পাড়ে নিয়ে এলো।ওদের চিৎকারে বাড়ির সবাই পুকুরপাড়ে জমা হলো।শান্তনুকে তোলার জন্য সবাই জলিলকে আদর করলো।শান্তনুর মা বললো, আজ বড় একটা বিপদ হতে পারতো।এবার গিয়ে শান্তনুকে সুইমিং ট্রেইনিং সেন্টারে ভর্তি করে দেব।আসলে সব বাচ্চাদের সাঁতার শেখানো উচিত।ও রাজি হলো।বিকেলে মামা ওকে হাটে নিয়ে গেল।ও কখনো হাটে যায়নি।ওর অবাক লাগলো।হাটের সবাই সবাইকে চেনে।মামাকে অনেকে সালাম দিলো। ওরা হাট থেকে অনেক জিনিষ কিনলো।সন্ধ্যার সময় হাট থেকে ফিরে এলো।
দেখতে দেখতে সাত দিন কেটে গেল। ওদের যাওয়ার সময় হয়ে গেল।শান্তনুর খুব মন খারাপ লাগছিল।গ্রামে ওর খুব ভালো লেগেছে।এতো গাছপালা,আর মানুষজন খুব আন্তরিক।প্রকৃতি এতো সুন্দর! গাড়িতে ওঠার সময় ও জলিলকে জড়িয়ে ধরলো।মনে করিয়ে দিল ও এর পর জলিলকে নিয়ে যাবে ঢাকাতে– পড়াশোনা করার জন্য।মামাকে, বড়দের সালাম দিলো।
ও গাড়িতে উঠলো।কিন্তু যেতে মন চাইছে না।গ্রামের রূপ-রস-গন্ধ ওকে আকর্ষণ করেছে।কী অনাবিল শান্তি।
ও যদি থেকে যেতে পারতো!