১.
২য় বর্ষের প্রথমদিককার সময়। প্রায় ৬টা বাজে। কলেজ হতে ক্লান্তশ্রান্ত দেহ আর মন নিয়ে বের হচ্ছি, মেইন গেটের সামনে এসে দেখি ছোট ছোট বেশ কিছু বাচ্চাকাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে। ওহ, তখনই মনে পড়লো, আরে, এরা তো আমাদের এখানে নৈশ স্কুলে পড়ে! এদের সকলেরই পরনের পোশাকাদি মলিনতার চাদরে ঢাকা তবে চোখেমুখে উজ্জলতার কোনো কমতি নেয়।
হঠাৎ কোনো এক বাচ্চার মস্তিষ্কে নিউরনের দপাদপির মাঝে ঢুকে গেলাম। ফিকে লাল রঙের ফ্রক পরা এক মেয়ে। কাধে বেখাপ্পা এক বিশাল ব্যাগ ঝুলছে।
মেয়েটির নাম সম্ভবত রূম্পা। কারন, ওর দিকে চেয়েই আমার মনে হলো ও রূম্পা। রূম্পার মা হয়তো দুবেলা অন্ন জোটানোর জন্য মানুষের বাসায় বাসায় কাজ করেন। বাবার কথা সে জানেনা, শুধু জানে বাবা ওদের সাথে থাকেনা। সবার বাবা আছে কিন্তু ওর নেই কেন- এ প্রশ্নের উত্তর ও কখনো পায়নি। ছোট একটা ভাই অথবা বোন আর মা নিয়ে তার ছোট একটি জগত, আর এ স্কুল ওর ছোট্ট জগতের অনেক বড় এক অংশ। কেননা এইতো সেই স্থান যা ওকে স্বপ্ন দেখায় আকাশ ছোঁয়ার। স্বপ্ন দেখায় দারিদ্রভরা কষ্টের জীবন হতে চিরতরে মুক্তির! পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাড়ানোর।
রূম্পা কলেজ ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে যে এরা কতো লেখাপড়া জানা মানুষ! আর মনে মনে পণ করে যে একদিন সেও অনেক বড় বড় ক্লাসে পড়বে।
দারোয়ান মামার ইশারায় ভেতরে যাবার জন্য প্রস্তুত সকলে। রূম্পার এ জায়গা খুব ভালো লাগে। কি সুন্দর! সিনেমার মতো। ঢুকতেই রাজকীয় রাস্তা, পাশেই বিস্তর মাঠ! ইয়া বড় বড় লাল লাল বিল্ডিং!
সবাই মাঠে জড়ো হতেই দেখে ফাদার আসছেন। ও জানে ফাদার অর্থ বাবা, কিন্তু ইনি ঐ বাবা নন। ইনি অন্য ফাদার, সবার অভিভাবকের মতো কিছু একটা। একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ। তবে ফাদারের আদর বাবার আদর যেমন হয়, তেমনই স্নেহসুলভ। আজকে সবাইকে চিপসের প্যাকেট দিচ্ছেন ফাদার। আশেপাশে কয়েকজন চিপস পেয়েই খুলে খাওয়া শুরু, কিন্তু রূম্পা তা না করে বরঞ্চ ব্যাগে রেখে দিল। বাসায় যেয়ে ভাইয়ের সাথে খাবে, মাকেও ২টা দিবে, এর বেশি না। উনি বড় মানুষ, বড় মানুষরা চিপস খায়না, চিপস খায় বাচ্চারা। এসব ভাবতে ভাবতে ক্লাস শুরুর সময় হয়ে যায়। আজ ওরা পড়বে বাংলা। বাংলা ওর খুব ভাল লাগে, কি সুন্দর সুন্দর কবিতা, কি সুন্দর গল্প। ম্যাডাম মাঝে মাঝে পড়ার মাঝে ভাষা আন্দোলন, বায়ান্নো, ২১শে ফেব্রুয়ারি এসব কি যেন বলেন, ও এসবের মানে সম্পূর্ন রূপে বোঝেনা তবে শুনলেই শরীরে এক অদ্ভুত চমক অনুভব করে।
এ জায়গাটা ওর কাছে আরো একটি কারনে প্রিয়। এখানের স্যার ম্যাডামরা কি সুন্দর করে কথা বলেন। বাংলা বললেও মনে হয় যেন আরেক ভাষা। আর ওর বাসার আশেপাশে সবাই পচা পচা কথা বলে। ওর মা বলে যে আশেপাশের এরা বস্তি, এদের সাথে মিশতে না। ওর মাকেও ও বলে দিয়েছে যে সে যখন বড় হবে, তখন অনেক পড়ালেখা করবে, তখন কিন্তু তারা আর এখানে থাকবেনা। ও বড় একটা বাসা নিয়ে থাকবে যেখানে রোজ রোজ রন্নাবান্নাকিংবা পানি নিয়ে অন্যের সাথে ঝামেলা হবেনা, পাশের বাসার বিলকিস আন্টিও ওকে বকা দিবেনা, ওর মায়েরও আর মানুষের ঘরে ঘরে যেয়ে কাজ করতে হবেনা। ওর মা রানীর মতো থাকবে । তার ভাইও অনেক পড়াশোনা করবে, ওর চেয়েও বেশি পড়াশোনা। এরপর এই কলেজেই পড়বে। রূম্পারও বড় হয়ে এ কলেজে পড়ার ইচ্ছা কিন্তু এখানে কেন যেন মেয়েরা পড়েনা, সব ছেলে। অবশ্য ও ফাদারকে বলেছিল যেন বড় হলে ওকে এ কলেজে ভর্তি নেয়া হয়! এ ক্রিম কালারের ড্রেসটা ও গায়ে জড়াতে চায়! কালো রঙের এ ব্যাগে বই খাতার সাথে বইতে চায় অনেক বড় বড় স্বপ্ন!
২.
গতকাল আমি কলেজ থেকে একটু পরেই বের হচ্ছি, প্রায় সন্ধ্যা ৬টা বেজে গেছে। তখনি আমার কলেজের সেই নৈশস্কুলের ছেলেমেয়েরদের সাথে দেখা। একেকজন প্রতিযোগিতা করে দৌড়াচ্ছে। সেদিনের চেয়ে আজ বিশদভাবে খেয়াল করলাম তাদের। কারো মা, কারো বাবা তাদের পৌছে দিচ্ছে, অনেকে আবার একা, অনেকে আবার গ্রুপ হয়ে ঢুকছে।
আমি আমার কাল্পনিক বন্ধু রূম্পার খোজ করতে লাগলাম। ঐযে! দেখা যাচ্ছে ওকে, অসম্ভব চটপটে মেয়ে এই রূম্পা! চেহারা দেখেই অনুমান করা যায় তার মনের ভেতরের অকল্পনীয় উৎসাহ!
“চাচি, দেন, আমি নিয়া যাই।” রূম্পার হাতে হুইলচেয়ার এবং তাতে বসে আছে একটু কালো করে স্বাস্থ্যবান এক ছেলে, তার দুটো পা ই নেই, একদম হাটু বরাবর কাটা।
রূম্পার সাথে যার কথা হচ্ছে সে হয়তো ছেলেটির মা।
ছেলেটির নাম হতে পারে হাফিজ। পা দুটো হয়তো জন্ম থেকে নেই। নাহ, জন্ম থেকে না থাকলে এমনভাবে কাটা থাকতোনা। হতে পারে বাসের নিচে চাপা পড়েছে অথবা হতে পারে কোনো দূর্ঘটনা।
তবে সত্যটা ভয়ংকর। বছর তিনেক আগে হাফিজকে ধরে নিয়ে যায় ছেলেধরারা। তার কিডনি বের করে নিতে পারতো, চোখ খুলে নিতে পারতো কিন্তু লোকগুলা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। তার পা দুটো কেটে দেয়। ওদের এক সংস্থা আছে। না, সংস্থা না, গ্যাং। আসলে সংস্থা আর গ্যাং একই জিনিস, শুধু একটা ব্যবহৃত হয় পজিটিভ অর্থে আর আরেকটা হয় নেগেটিভ অর্থে। তাদের এ ভিক্ষুক গ্যাংয়ের কাজ হলো বাচ্চাদের ধরে এনে শারীরিকভাবে ডিজেবল করে তাদের দিয়ে ভিক্ষা করানো। বিরাট ধান্ধা। কারো চোখ অন্ধ করে দেয়, কারো হাত কাটে, কারো আবার কাটে পা। কাটে একটাই, কিন্তু সেদিন হাবু কসাইয়ের মন মর্জি ভালো না থাকায় হাফিজের দুটো পা-ই কাটা পড়ে। এরপর তাকে নামিয়ে দেয় ভিক্ষা করার জন্য। সারাদিন ভিক্ষা করে সে টাকা ফেরত দিতে হয় ঐ লোকদের কাছে। হাফিজ সেখানে দুবছর ছিল। পরে সেখান থেকে কোনোমতে পালিয়ে আসে মা বাবার কাছে। তখন তার জীবনে ছিলনা কোনো স্বপ্ন, কোনো আশা। এভাবে কি আর লেখাপড়া করা যায়?!?
তবে তার এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়ার আশা পায় যখন তাদের বস্তিতে আসে কিছু মানুষ। দুটো লোক ইন করা শার্ট প্যান্ট পরা আর এক মহিলা শাড়ি পরা। কি সুন্দর কথা বলার ঢং! তারা এসেছে নৈশ স্কুল থেকে। এখানে যেসব বাচ্চা পড়ালেখা করেনা
বা করতে পারেনা তাদের পড়ালেখা শিখানো হবে…।। রূম্পা, হাফিজ, বাবলু সহ আরো অনেকেই ভর্তি হয়ে যায় স্কুলে। আজ প্রায় ৬মাস হলো এ স্কুলে পড়ছে ওরা!
“ঐ হাফিজ্জা, দেখিস, আজকের পরীক্ষা ফাটায়া দিমু।”- অহমিকা নিয়ে বলে উঠলো রূম্পা।
রাগী রাগী চোখে রূম্পার দিকে তাকিয়ে মায়ের কাছে হাফিজের নালিশ, “মা, দেহো, ওরে না আমি হাফিজ্জা কইতে মানা করসি? ঐ রূম্পা, তুই জানোস, হাফিজ আল্লাহর একটা নাম। আর এম্নেও মাইনষের নাম নিয়া মজা করা নিষেধ।”
“হ, হ, হইসে হইসে, একশোবার বলসোস। আর বলা লাগবোনা।” বলেই রূম্পা হাফিজের হুইলচেয়ার নিয়ে দৌড়!
লিখা-Nazmus Saquib
ছবি সংগৃহীত…
Comments are closed.