লেখাঃ তাসফিয়াহ মাহমুদ প্রত্যাশা
৯ম শ্রেণীতে উঠার পর সব সহপাঠীদের আমার কাছে বেশ বড় বড় লাগে। ঠিক আগের মতো না, ওরা আস্তে হাসে, আস্তে চলে, মাথা ঢেকে রাখে, বেশি বেশি সাজ গোজ করে! আর এদিকে নিজের দিকে তাকালে আমার মনে হয় হঠাৎ কোন দানব আমাকে ধরে কুয়োর মাঝে ফেলে দিলো। এ কি! সুমন স্যারের কাছে হায়ার ম্যাথ করতে গেলে রীতিমতো আমার চোখ উল্টে, জিহ্বা বেরিয়ে, হাত পা কাঁপাকাপি শুরু হয়ে যায়।
সকাল ৭ টায় ঝাপসা চোখে দৌড়াতে দৌড়াতে রসায়ন পড়তে যাই। আমি শিখছি, স্যার, পরিবার, সমাজ, প্রতিবেশী সবার কাছ থেকে শিখছি।আর যাই হোক শিখছি, ছাত্র আর ছাত্রী যে এক না, ছেলে আর মেয়ে জাতির মাঝে যোজন যোজন পার্থক্য। ছেলেরা খেলবে,মেয়েরা না।ছেলেরা সাইকেল চালাবে মেয়েরা না।ছেলেরা কথা বলবে, মেয়েরা চুপ থাকবে।রাস্তায় ছেলেরা মেয়েদের ধমকাবে, মেয়েরা মাথা নিচু করে বাড়ি এসে কাঁদবে।
একই প্রজাতি, একই বয়সী,একই স্কুল একই শ্রেণীর ছাত্র আর ছাত্রী পরিচিত হতে পারবেনা, কথা বলবেনা। কারণ ওরা ছেলে আমরা মেয়ে! মনে হয়, খেলার মাঠ, রাস্তা, প্রার্থনাগার,গ্রন্থাগার সব নির্মিত হয়েছে পুরুষদের জন্য। আমরা মাঠে খেলতে পারবোনা, রাস্তায় চলতে হবে সরীসৃপের মতো, কেউ যাতে টের না পায়,আমাদের গলার আওয়াজ না শোনে। পোশাক পড়তে হবে কালো পা ছোয়া, মাথা ঢাকা। নয়তো তুমি খারাপ। তুমি অশ্লীল।
মাঝেমধ্যে মেয়েদের এই অবস্থা দেখে আমার মনে হয়, এমন অবস্থার পেছনে কিছুটা হলেও মেয়েরাও দায়ী!তারা মায়াবী, রুপবতী,তুলতুলে আর যা আছে, তা হতে চায়, এই চাওয়াগুলো অনেক সময় নারীদের বঞ্চিত ,লাঞ্ছিত অত্যাচারিত হতে সাহায্য করে। নৌবাহিনী স্কুলে পড়ার জন্য আমাদের সবার পরিচিত হতে হয় একদল পাষণ্ড প্রিফেক্ট গ্রুপের সাথে।স্কুলের সব দায় দায়িত্ব তাদের হাতে। কারা নির্দোষ হয়ে শাস্তি পাবে, আর কারা দোষী হয়েও অনেকটা বলা যায় সিগারেট খেতে খেতে স্যারদের গলা জড়িয়ে বুক ২ ইঞ্চি ফুলিয়ে চলবে, তা ঐ প্রিফেক্টরাই ঠিক করে রাখবে।
আমাদের সহপাঠীদের মাঝে যারা এই দলের তারা আবার বহুরূপী। এই দেখবো এখানে সেখানে আমাদের শাষিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান বানাচ্ছে, আবার একটু পর দেখবো এই হিংস্র, শক্তিশালী, পাষন্ডরা হঠাৎই বিলাই হয়ে যায়। স্কুল ছুটির পর গেট দিয়ে বের হয়ে দৌড়ে আমাদের সাথে রাস্তা পার হয়ে ঝালমুড়ি, চা,ফুচকা খাবে এই আবার এরাই একই রাস্তা পার হবে প্রেমিকদের হাত, পা ধরে। ওদের রীতিমতো ঠেলতে ঠেলতে, কোলে নিয়ে প্রেমিকরা রাস্তা পার করে দিবে। কারন ওরাতো রাস্তা পার হতে পারেনা। আমি অবাক হই, বিস্মিত হই, নির্বাক হই।
মেয়েরা মেয়ে বলতে বোঝে, ওদের অনেক মায়াবী হতে হবে, ন্যাকামী করতে হবে। রুঢ় আচরণ, জোড় গলায় কথা বলা, মতামত দেওয়া চলবেনা। কেউ অন্যায় করলেও প্রতিবাদ করা যাবে না। রসায়ন বুঝি আর না বুঝি আমাকে বুঝতে হবে, ‘তুমি মেয়ে, তুমি দূর্বল, তোমাকে চুপ থাকতে হবে। আর যাই হোক তুমি চুপ থাকবে।’
৫জানুয়ারি ২০২০।