লেখকঃ হিমু চন্দ্র শীল
বেশ কিছুদিন আগে আনন্দবাজার পত্রিকা পড়ার সময় একটা নিউজের শিরোনামে চোখ আটকে যায়।নিউজটার বিষয়বস্তু ছিল স্কুল বাসে এক ছাত্রীর পিরিয়ড শুরু হলে তার জামায় রক্তের দাগ লেগে যায়।তখন এক ছাত্র ওই ছাত্রীর কানে কানে গিয়ে বলল;তোমার জামায় রক্তের দাগ!তখন মেয়েটি লজ্জায় নাজেহাল হয়ে যাওয়ার অবস্থা।কিন্তু পরক্ষনে ছাত্রটি তার সোয়োটারটা মেয়েটার হাতে দিয়ে বলল নাও এটা ওখানে বেধে নাও।আমার ও বোন আছে,আমার বোনেরও পিরিয়ড হয়।তখন ছাত্রিটি আবেগে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি।
এই ঘটনাটা দেখতে সাদাসিধে মনে হলেও পার্শ্ববর্তী দেশে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে অনেক গুরুত্ব বহন করে।সেই সাথে ওই ঘটনায় ফুটে ওঠেছে বর্তমান সময়ে যে কুসংস্কার বিলুপ্ত হচ্ছে তারও প্রতিফলন।চাইলে ওই ঘটনা থেকে আমরাও শিক্ষা নিতে পারি কিভাবে প্রকৃতি প্রদত্ত বিষয়গুলোকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে মা-বোনদের শ্রদ্ধা করতে হয় তা।
তখনকার দিনে মানুষদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত ছিল।তারা প্রকৃতি প্রদত্ত শরীরবৃত্তীয় কোনো বিষয়কে ঈশ্বরের অভিশাপ মনে করত।কেউ কেউ ওই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিকে ঘৃণার চোখে দেখত।বিভিন্ন জনের কাছে বিভিন্ন ধরণের কুৎসা রটাতো বিষয়টি নিয়ে।ফলে ওই স্বাভাবিক জিনিসটি সবার কাছে একটা অস্বাভাবিক রূপ ধারণ করত।আমার স্পষ্ট মনে আছে একাদশ শ্রেণিতে স্যার যখন হুমায়ুন আহমেদের ‘অপরাহ্নের গল্প’প্রবন্ধটি পড়াচ্ছিল,তখন সবার চোখেমুখে সে কি অস্বস্তি।এমনকি স্যার নিজেও কয়েকটি শব্দ এড়িয়ে গেলেন।
আসলে আমাদের দেশের মানুষরা এখনো মানব দেহের স্বাভাবিক ব্যাপার গুলো সম্পর্কে ট্যাবু।বিশেষ করে পিরিয়ডের মতো মানব দেহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলো।এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে আমাদের জানা প্রয়োজন,জ্ঞান রাখা উচিত।কিন্তু আমাদের আশেপাশে তাকালে আপনি বুঝতে পারবেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি লোক চক্ষুর আড়ালে থেকে গেছে।এমনকি মানব দেহের স্বাভাবিক ব্যাপারগুলোকে সমাজে অঘোষিতভাবে ট্যাবু করে দেওয়া হয়েছে।হঠাৎ কেউ শরীরবৃত্তিয় কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বললে তার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে এসব এখানে চলে না।এমন কি আমরা আমাদের প্রিয় মা বাবার সামনেও আমাদের দেহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে সংকোচ বোধ করি।এই সংকোচ বোধ করার দোষটা কিন্তু সন্তানদের নয়।
আসলে আমাদের চারপাশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা আমাদেরকে শিখিয়েছে এ ব্যাপারে খোলাখুলি কথা না বলতে।আমরা সবকিছুতে খারাপ দেখতে দেখতে আমাদের চোখ এখন ওই প্রকৃতি প্রদত্ত জিনিসের মধ্যেও খারাপ খুঁজে বেড়ায়।এই যে এই ট্যাবু বিষয়টার ফলে,আমাদের আগামী প্রজন্ম বিরাট একটি ভুল ধারণা নিয়ে সামনে এগুচ্ছে।এটার দায়ভার কে নেবে?শিশুকাল শেষ হওয়ার পর একজন মানুষ কৈশোরে পা বাড়ায়।তখন দেহের স্বাভাবিক পরিবর্তন চলে আসে।শৈশবটা পরিবার কিংবা, মা বাবার গন্ডির মধ্যে থাকলেও কৈশোরে গন্ডি বড় হতে থাকে।তখন সমাজের সবার সাথে মিশতে হয়।নানান প্রয়োজনে এদিক-ওদিক যেতে হয়।তার নিজস্ব গন্ডিটা বাড়তে থাকে।
শারীরিক পরিবর্তনের সময়ে একজন মানুষের মনে নানান প্রশ্ন উঁকি দেয়।স্বাভাবিক জৈবিক বিষয়গুলো নিয়ে বাড়তে থাকে কৌতূহল।এই সময় পরিবারের উচিত তাদের পাশে থাকা।বিশেষ করে মা বাবার উচিত তাদের বাড়ন্ত সন্তানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে প্রশ্নগুলোর উত্তর জানিয়ে দেওয়া।ভালোবাসার হাত মাথায় রেখে অকপটে বলতে হবে ‘তোমার যে কোনো সমস্যা আমাকে নিঃসংশয়ে বলতে পার’।কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট এ বিষয়ে ভিন্ন কথা বলে।আমরা সবসময় এই স্বাভাবিক ব্যাপারগুলো নিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে থাকি।যদিও বা মুখ ফসকে এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানতে চাওয়া হয়,তখন বড়দের ধমক খেতে হয়।কিংবা বিষয়টা বড়রা এড়িয়ে যায়।ফলে ওই বিষয়ে আমরা থেকে যায় অজ্ঞ।তখন কৈশোর বয়সের ওই কৌতূহল মেটানোর জন্য আমাদের দেশের ছেলে মেয়েরা মোক্ষম উপায় হিসেবে বেছে নেয় গুগল,কিংবা বন্ধুমহল।
কিন্তু বন্ধুমহলে এই বিষয়টা উত্থাপন করলেই হাসি ঠাট্টার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কৈশোর বয়সটা ছেলেরা যেমন-তেমনভাবে পার করে দিতে পারলেও,মেয়েরা পারে না।ওই সময়কালটা মেয়েদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।কারণ কৈশোরে শারীরিক পরিবর্তনের সাথে সাথে একজন মেয়ে প্রজনন ক্ষমতা লাভ করে।প্রকৃতি প্রদত্ত শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ‘পিরিয়ডের’ মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার কৈশোরের অধ্যায়।ষষ্ঠ শ্রেণির শারীরিক শিক্ষা বইয়ে ‘আমাদের জীবনে বয়ঃসন্ধিকাল‘ অধ্যায়ে বলা হয়েছে ৯ থেকে ১২ বছর বয়সে মেয়েদের মাসিক শুরু হয়।পাশাপাশি মাসিক হলে কী করণীয় বা কোন ধরনের স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা উচিত তা সম্পর্কেও বিশদ আলোকপাত করা হয়েছে।এই পিরিয়ড একটা স্বাভাবিক বিষয় হলেও অনেকের কাছে কিন্তু তা নয়।
অনেকে এই পিরিয়ড বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না।শহরে পিরিয়ড নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা কিছুটা কম হলেও,গ্রামে বা মফস্বলে পিরিয়ড নিয়ে কুসংস্কার বেশি।এখনো অনেক গ্রামের লোকেরা পিরিয়ডকে স্রষ্টার অভিশাপ হিসেবে মনে করে।আর কারও যদি পিরিয়ড হয় তাহলে কাউকে তার কাছে যেতে দেওয়া হয় না।এমনকি নিজের ভাই-বোনকেও না।সবসময় সতর্ক থাকে যাতে সে কাউকে না ছুঁই।সবসময় মেয়েটার ওপর তীর্যক দৃষ্টি দিয়ে রাখা হয়।কথাটা শুনতে অদ্ভুত টাইপের হলেও,আসলে এটাই নির্মম সত্য বাস্তব।বিশেষ করে গ্রামে পিরিয়ড চলাকালীন কোনো মেয়েও ঠিক মতো স্কুলে যেতে পারে না।সেটা নিজস্ব লজ্জা,কিংবা ভয় হোক বা পরিবারের বাধা নিষেধ।অবশ্য এটাও ঠিক যে,গ্রামের কোনো স্কুলে পিরিয়ডকালীন সময়ে ছাত্রীদের ব্যবহার করার জন্য বাথরুমের কোনো সুব্যবস্থা নেই।পিরিয়ডের সময় গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এখনো পুরনো কাপড়,ন্যাকড়া ব্যবহার করে।বেশিরভাগই জানেনা ন্যাপকিন সম্পর্কে।
এই বিষয়টা যে মেয়েদের শিক্ষার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা গত বছরের জুনে প্রকাশিত একটি ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের নিবন্ধে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে মাসিকের কারণে বাংলাদেশের ৪১শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী মাসে গড়ে তিন দিন স্কুলে উপস্থিত থাকতে পারে না।এই সমস্যাটির কারণে অস্বস্তিতে ভোগে ৯৯শতাংশ শিক্ষার্থী।
গ্রামে,কিংবা শহরে পিরিয়ড নিয়ে যখন এত অজ্ঞতা তখন ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদনে দেখলাম সিরাজগঞ্জের ফুলকুচা গ্রামের ঘোড়াচড়া উচ্চ বিদ্যালয় অনন্য এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।ওই স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অর্ধেক ছাত্রী।পিরিয়ডের সময় স্কুল থেকেই দেওয়া হয় স্যানিটারি ন্যাপকিন।পিরিয়ড চলাকালীন ছাত্রীদের সহায়তা করতে কয়েকজন প্রশিক্ষিত নারী শিক্ষকের পাশাপাশি রাখা হয়েছে সার্বক্ষণিক পানি ও আলাদা বাথরুমের সুব্যবস্থা।যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও অনুকরণীয়।চাইলে আমাদের দেশের অন্যান্য স্কুলগুলোও মফস্বলের এই স্কুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
মানুষদের পিরিয়ডের ব্যাপারে সচেতন করে তোলতে (বিশেষ করে মেয়েদের) সিরাজগঞ্জের ফুলকুচা এলাকায় ২০১১ সালে অ্যাডভোকেসি প্রোগ্রাম চালু করে ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন অব দ্য রুরাল পুওর নামের একটি বেসরকারী সংস্থা।পিরিয়ড নিয়ে ওই স্কুলের সুব্যবস্থা তাদেরই কর্মকান্ডের একটি অংশ।আমাদের দেশে সরকারী বেসরকারী অনেক সংস্থা নানা কর্মকান্ডের সাথে জড়িত আছে।এই সংস্থাগুলো চাইলে সারা দেশে পিরিয়ডের ব্যাপারে যত-সব ভ্রান্ত ধারণা আছে তা দূর করে ওই সংস্থার মতো অনন্য এক নজির স্থাপন করতে।পিরয়ডের ব্যাপারে আমাদের দেশের নারীরা কতটা অজ্ঞ তা আইসিডিডিআরবির এক জরিপেও উঠে এসেছে।
ওই জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশের ৮৬ শতাংশ নারী পিরিয়ড চলাকালীন পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন।অর্থাৎ ওই ৮৬ শতাংশ নারীই এখনো জানে না স্যানিটারি ন্যাপকিন কি।আর ৬৮ শতাংশ ছাত্রী তাদের প্রথমবার পিরিয়ড হওয়ার পূর্বে তারা এই বিষয়ে জানতেন না।জরিপটিতে আরও দেখা যায় ৮২ শতাংশ ছাত্রী পিরিয়ডের সময় পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন।পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহারের ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিও তৈরি হয়।তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো দেশের মাত্র ১ শতাংশ স্কুলে ব্যবহার করা প্যাড ফেলার ব্যবস্থা আছে!দেহের স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াটি নিয়ে আমারা কতটা ট্যাবু তা ওই জরিপে সুন্দর করে ফোটে উঠেছে।
এখন দিন বদলেছে,মানুষের সেকেলে ধ্যান-ধারণার উন্নতি ঘটেছে।পরিবর্তন হচ্ছে মন-মানসিকতার।দিন বদলের এই ধারায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে শরীরবৃত্তীয় ব্যাপারগুলো নিয়ে মানুষদের সচেতন করার বিষয়টি।তবে স্বস্তির কথা ইতিমধ্যে বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের দেশের সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠান মিলে কাজ শুরু করেছে।আন্তর্জাতিক সংস্থা দি হাঙ্গার প্রজেক্ট এবং জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম দেশের আটটি বিভাগে সেফ স্কুলস ফর গার্লস ক্যাম্পেইন শিরোনামে একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে।
দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সারা দেশে কো-এডুকেশনের তিন হাজার বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য আলাদা ওয়াশ ব্লকের পাশাপাশি মেয়েদের ওয়াশ ব্লকে স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলার জন্য পৃথক বিন রাখার নির্দেশ দিয়েছে।যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।এই বিষয়টা থেকে তখনি উত্তরণ সম্ভব হবে যখন জনসচেতনতা শুরু হবে পিরিয়ড ও এসব ভ্রান্ত ধারণার ব্যাপারে।পাশাপাশি পাঠ্য বইয়ে পিরিয়ডের মতো স্বাভাবিক প্রকৃতি প্রদত্ত বিষয়গুলো আরও অন্তর্ভুক্ত করলে আমাদের আগামী প্রজন্ম এসব ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে।
তাহলে সমস্যাগুলোও অচিরেই দূর হবে।এত সমস্যায় জর্জরিত হওয়ার পরও আমরা স্বপ্ন দেখি অনন্য এক বাংলাদেশের।কারণ আমরা আশাহতদের দলে নয়,আশাবাদীদের দলে।এইসব অজ্ঞতা কাটিয়ে গড়ে উঠবে আনকোরা এক বাংলাদেশ।
লেখক;হিমু চন্দ্র শীল,ছাত্র-কক্সবাজার সরকারী কলেজ,কক্সবাজার।