প্রতিটি সুবিধা বঞ্চিত শিশুকে আমরা বই খাতা পেন্সিল দিতে চাই,শিক্ষার আলো দিতে চাই।স্বার্ণকিশোরী ক্লাবের আনিকা আপুদের স্বপ্ন এটা। একদিন হঠাৎ শুনি মিনহাজ আর স্কুলে আসবে না।আমি জানতাম মিনহাজ একটি মেধাবী ছেলে এবং দুরন্ত হওয়ায় শরীরে তেমন কোন রোগও নেই যে অসুস্থ্য হয়ে বিছানায় পড়ে থাকার কারণে মিনজার স্কুলে আসবে না।
আর কেউ অসুস্থ্য হলেও একেবারেই স্কুলে আসবেনা এমনতো নয়।বিষয়টি আমাকে খুব চিন্তায় ফেলে দিলো।আমি খুব ছোট মানুষ তাই বন্ধুর জন্য ব্যকুল হয়ে উঠলাম।আম্মুকে বলে দেখা করতে গেলাম মিনহাজের সাথে।
গিয়ে দেখি ও বাড়িতেই আছে বাবাকে সাহায্য করছে ঝুড়ি পলো বানানোর কাজে।ওর বাবা নিপুণ হাতে ঝুড়ি পলো আরো অনেক কিছু বানায় এবং বিক্রি করে।কুটিরশিল্প বলে যে অধ্যায়টা আমরা পড়েছি তা মিনহাজদের বাড়িটা দেখলেই বুঝা যায়।ছনের ঘরে পাটকাঠির বেড়া।খুব গরীব ওরা।তবে গরীব বড়লোক যাই হোক আমি আর মিনহাজ খুব ভালোবন্ধু।ওকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নদীর পাড়ে চলে গেলাম।
জানতে চাইলাম তুই নাকি আর স্কুলে আসবি না।কেন আসবি না?ক্লাসে তুইতো দারুণ মেধাবী।পড়াশোনা করলে তুই অনেক বড় হবি।তাহলে কেন তুই স্কুলে যাবি না।মিনহাজ প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ থাকলো তার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানতে চাইলে তুই সকালে কি খেয়েছিস?আমি বললাম আম্মু ডিমপোচ করে দিয়েছিল সাথে পরাটা এবং জেলি।
মিনহাজ আবার প্রশ্ন করলো দুপুরে কি খেয়েছিস?আমি বললাম দুপুরে ইলিশ মাছ আর ভাত।মিনহাজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো হয়তো রাতেও মাছ নয়তো মাংশ খাবি।আমি ওর কথায় সায় দিলাম।জানতে চাইলাম তুই সকালে কি খেয়েছিস দুপুরেইবা কি খেয়েছিস?মিনহাজ কথা বললো না।
আমি ভাবলাম ও রাগ করেছে তাই কাধে হাত রেখে জানতে চাইলাম বলনা কি খেয়েছিস?আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো এক গ্লাস পানি খেয়েছি আর গতকাল রাতে খাওয়ার পর যে ভাত ছিল সেটাতে পানি দিয়ে রেখেছিল তার সাথে একটা কাচামরিচ আর পিয়াজ নিয়ে খেয়েছি এগারটার দিকে।ওটাই আমার সকাল এবং দুপুরের খাওয়া।
আমরাতো কখনো তিনবেলা খেতে পারিনা।ইদানিংতো আরো খারাপ অবস্থা।বাবার আয়রোজগার নেই বললেই চলে।স্কুলে গেলে সেই খরচ দেবার মত অবস্থাতো বাবার নেই।আর তাছাড়া বাবার একার আয়ে কোন ভাবেই আমাদের চারজনের এক বেলা দু বেলা খাওয়া জোটেনা তাই আমি স্কুলে যাওয়া বাদ দিয়ে বাবাকে সাহায্য করছি।এতে করে বাবা একটা দুটো ঝুড়ি বেশি বানাতে পারছে যা দিয়ে দুই কেজি চাল কিনলে চারজনে খেতে পারি কিছুটা।
আমার পকেটে তখন পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ছিল।সকালে আনিকা আপুর কাছ থেকে নিয়েছিলাম।আমার বোন আনিকা আপু স্বর্ণকিশোরী।ও সত্যিই স্বর্ণের মত আলো দিচ্ছে আমাদের।আমি কখনো কিছু চাইলেই আপু না করেনা।আম্মু আমাকে টাকা দেয় ভাইয়া দেয় আবার আপুও দেয়।আনিকা আপুর দেওয়া টাকাটা আমি মিনহাজের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললাম এই নে এটা রাখ।বন্ধু হিসেবে এর চেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারি।মিনহাজ নিলো না।বললো ওটা রেখে দে তোর কাজে লাগবে।আমাদের নেই নেই করে কোন না কোন ভাবে চলে যাবে।
আমি মনখারাপ করে বাসায় ফিরলাম।প্রতি রাতে আনিকা আপু আমাকে পড়া শিখিয়ে দেয়।সেদিন রাতে পড়তে বসে আমি খুব আনমনা ছিলাম চিন্তিত ছিলাম।ভাবছিলাম মিনহাজের কথা।ও যদি স্কুলে না যায় তবে পড়াশোনা শিখতে পারবেনা আর পড়াশোনা শিখতে না পারলে ও আজীবন অভাবিই থেকে যাবে।বন্ধু হয়ে আমি কি করে এটা মেনে নেব?
আমাকে আনমনা থাকতে দেখে আপু আমার মাথায় টোকা দিয়ে বললো কিরে পচারাজপুত্র তুই কি ভাবছিস?প্রেমে পড়েছিস নাকি যে কোন রাজকন্যাকে নিয়ে ভাবছিস। আমি বললাম আপু তুমিনা ভীষণ পাজি।ক্লাস থ্রিতে পড়ে এমন কেউ কি প্রেম করে?তুমিকি করেছিলে?আপু হেসে দিয়ে বললো কথায় তোর সাথে পারবো না।এখন বল এতো চিন্তা কিসের।
আমি তখন আপুকে সব খুলে বললাম।আপুও ভাবনায় পড়ে গেল।তবে আমাকে কথা দিলো সে নিশ্চই মিনহাজের জন্য কিছু না কিছু ব্যবস্থা করবে।শুনে আমি আপুকে ধন্যবাদ দিলাম।খুশি হলাম।
তিনচারদিন পর দেখি মিনহাজ স্কুলে এসেছে।ওর হাতে নতুন বই খাতা পেন্সিল।ওকে দেখে খুবই খুশি হলাম।জানতে চাইলাম পিছনের ঘটনা তখন ও খুলে বললো।একদল স্বর্ণকিশোরী এসেছিল ওদের বাড়িতে।তারাই দিয়ে গেছে নতুন বই খাতা পেন্সিল।বলে গেছে আগামীতেও নিয়মিত তারা মিনহাজের লেখাপড়ার যাবতীয় উপকরণ দিবে।এটা শুনে মিনহাজের বাবা মাও খুশি হয়েছে এবং ওকে আবার স্কুলে পাঠিয়েছে।
সেদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আপুর ঘরে গেলাম।গিয়ে আপুর সামনে বাড়িয়ে ধরলাম একটা আইসক্রিম।আমি আইসক্রিমের খুব্বি ভক্ত এবং কখনোই নিজে না খেয়ে কাউকে আইসক্রিম খেতে দেইনা।কিন্তু সেদিন আমি নিজে না খেয়ে সেটা আপুর সামনে বাড়িয়ে ধরলাম।আনিকা আপু এটা দেখে খুব্বি আশ্চর্য হলো।
আমি বললাম আপু তুমি এবং তোমরা মিনহাজের জন্য যা করেছ তার জন্য অন্নেক ধন্যবাদ।এ জন্যই তোমাকে এ উপহার দিলাম।আপু খুব খুশি হলো আর আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে বললো শোন পচারাজপুত্র আমরা স্বর্ণকিশোরী ক্লাব কোন কিছু পাওয়ার আশায় এটা করিনি।
তুমি যে আমাকে আইসক্রিম দিচ্ছ এতে আমি খুশি তবে না দিলেও কোন সমস্যা নেই।আমরা চাই প্রতিটি সুবিধাবঞ্চিত শিশু কিশোর কিশোরী স্কুলে যাক এবং তাদের পাশে আমরা দাড়াবো বলেই আমরা স্বর্ণকিশোরী ক্লাব খুলেছি।
পড়ার টেবিলের অন্যপ্রান্তে আমি তখন মুখের দুই পাশে হাত ঠেকিয়ে অপলোক তাকিয়ে আছি আমাদের স্বর্ণকিশোরী আনিকা তানজিম আপুর দিকে।আর ভাবছি এটাকি সত্যিই আনিকা আপু নাকি মাদার তেরেসা।
লেখকঃ জাজাফী
এটি একটি গল্প।তবে গল্প হলেও এখানে আছে সত্য কিছু ঘটনা।আনিকা তানজিম এবং তার বন্ধুরা স্বর্ণকিশোরী ক্লাব করেছে।এইতো সেদিন নাজিরপুর বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্বর্ণ কিশোরী ক্লাবের পক্ষ থেকে কিছু অসহায় শিশুকে বই,খাতা ও কলম দিয়ে সহায়তা করা হয়েছে যা নিচের ছবিতে দেখানো হয়েছে।
তাদেরকে বাল্যবিবাহ ও অপুষ্টি বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য জানানো হয়।তাদেরকে স্কুলে যেতেও উৎসাহিত করা হয়।আনিকা আপু ও তার ক্লাবের সকল বন্ধুরা মিলে এই কার্যক্রমটি সফলভাবে শেষ করেছে।
আনিকা আপুদের স্কুলের নাম নাজিরপুর বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়।ওরা ক্লাবের ২৫ জন বন্ধু মিলে ওরা সহায়তা করেছে।ওরা ৬০ জন বাচ্চাকে নিয়ে কাজটি করছে।৬০ জন বাচ্চাকে বই,খাতা,কলম দেওয়া হয়েছে।
নাজিরপুর বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্বর্ণ কিশোরী ক্লাবের এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে ছোটদেরবন্ধু এই প্রত্যাশা করে।ঠিক একই ভাবে আমরা চাই সারাদেশেই এমন ক্লাব গড়ে উঠুক।ধন্যবাদ আনিকা তানজিম ও তার বন্ধুদের যারা অসাধারণ একটি কাজ করে ছোটদেরবন্ধু হিসেবে নিজেদেরকে প্রমান করেছে।
আরও পড়ুনঃ
- ক্ষুদে লেখক রাশিকের মিস্ট্রি অব দ্য সুপার ন্যাচারাল।
- শিহাব এবং টিটোনের সাহসীকতার গল্প।
- অনন্য যারিফ আকন্দ,গ্রহ নয় যেন একটি নক্ষত্রের নাম।
- বয়স ১৪ তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
- রিয়া দিয়া ক্ষুদে মহাতারকা।
Comments are closed.