আমার সব থেকে প্রিয় বান্ধবীর নাম রুমকি।আমরা একসাথে স্কুলে যেতাম একসাথে স্কুল থেকে ফিরতাম এমনকি একসাথে মরতেও যেন রাজি ছিলাম আমরা।লোকে বলতো আমরা দুজন জমজ বোন হলে ভালো হতো।আমাদেরও খুব ভালো লাগতো।আমরা যখন একটুখানি বড় হলাম তখন দুজনে দুষ্টুমীর ছলে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা যখন বিয়ে করবো তখন একই পরিবারের দুই ভাইকে বিয়ে করবো যেন আমরা তখনো একসাথে থাকতে পারি।মানুষের সব স্বপ্ন পুরণ হয়না যেমন আমাদের স্বপ্নগুলো হঠাৎ করে ভেঙ্গে গেল।এক সকালে রুমকি আর স্কুলে এলোনা।আমি ভাবলাম ওর মনে হয় জ্বর হয়েছে তাই স্কুলে আসেনি।ওর আবার এই এক সমস্যা ছিল একটুতে একটু রোদ বৃষ্টিতে থাকলেই জ্বর বাধিয়ে বসতো।ভাবলাম পরদিন নিশ্চই জ্বর সেরে যাবে আর ও স্কুলে আসবে।কিন্তু পরদিনও ও স্কুলে আসলো না।ওদের বাড়ি ছিল অন্য একটা গ্রামে।আমরা যখন হেটে হেটে স্কুলে যেতাম তখন একটা তিন রাস্তার মোড়ে দুজন একসাথে হতাম।বন্ধের দিনগুলিতে ও আমাদের বাড়িতে আসতো নয়তো আমি ওদের বাড়িতে যেতাম।সব্বাই আমাদেরকে চিনতো জানতো।পরপর চার পাচদিন হয়ে গেল রুমকি আর স্কুলে এলো না।আমি খুব অবাক হলাম।ওর অসুখ হলেতো আমাকে জানাতে পারতো আমি গিয়ে দেখে আসতাম।
রুমকি একাই ওদের গ্রাম থেকে আমাদের স্কুলে পড়তে আসতো।গ্রামের পাশেই আরেকটা স্কুল থাকার পরও ও আমাদের স্কুলে আসতো কারণ আমাদের স্কুলটা ছিল খুব ভালোমানের।আমরা লেখাপড়ায় যেমন অন্যদের চেয়ে ভালো ছিলাম তেমনি কালচারালা ফাংশানগুলোতেও আমাদের খুব নাম ছিল।রুমকি খুব ভালো গান করতে পারতো কিন্তু সুযোগ সুবিধার অভাবে ওর সুন্দর গলার গান থেকে বঞ্চিত হলো সারা দেশ।বাবা মার অভাবের সংসারে রুমকি যে স্কুলে আসতে পারছে এটাই যেন রুমকির জীবনের সব থেকে বড় অর্জন ছিল।এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে কিছুদিন পর।আমরা এসএসসি দিবো।ক্লাসে রুমকির অবস্থান বেশ ভালোই।তিন থেকে পাচের মধ্যেই থাকে ও।স্কুলের শিক্ষকেরা ওকে নিয়ে আশাবাদী ও নিশ্চই স্কুলের সুনাম বাড়াবে।কিন্তু হঠাৎ সব ওলোটপালট হয়ে গেল রুমকি আর স্কুলে এলো না।একদিন দুদিন করে করে যখন প্রায় পনেরদিন হতে চললো তখন আমার আর সহ্য হলোনা।সব থেকে প্রিয় বান্ধবীকে ছাড়া আমিও যে স্কুলে ক্লাসে মন বসাতে পারছিলাম না।সেদিন সারাকে নিয়ে আমি রওনা হলাম রুমকিদের বাড়িতে।আমাকে জানতেই হবে রুমকি কেন স্কুলে আসে না।বাবা মা আর ভাইয়াকে বলে গেলাম রুমকির কথা।ওর স্কুলে না আসার কারণ কি হতে পারে সেটা ভাইয়া অনুমান করলো যা শুনে আমি চমকে উঠলাম।ভাইয়া বললো ওর বিয়ে হয়ে যেতে পারে!
এবার যে মেয়েটি এসএসসি পরীক্ষা দিবে তার কি বিয়ের বয়স হয়েছে?আমাদের দেশে না বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ? আমাদের দেশেনা মানবাধিকার কমিশন আছে,ইউনিসেফ,সেভ দ্য চিলড্রেন আরো কত কত প্রতিষ্ঠান আছে শিশু কিশোর কিশোরীদের নিরাপত্তা ও অধিকার আদায়ের জন্য?তারাকি তবে রুমকির বিয়েটা রুখে দিতে পারেনা?আমি মনে মনে ভাবি ভাইয়া যেটা বলেছে সেটা যেন না হয়।রুমকি অসুস্থ হলেও মনকে শান্তনা দিতে পারবো কিন্তু ওর যদি সত্যি সত্যিই বিয়ে হয়ে যায় তাহলে কি করবো?ভাবতে ভাবতে সারাকে কথাটা বললাম।সারাও শুনে মনখারাপ করলো আর পথে যেতে যেতে পরিকল্পনা করলো যদি গিয়ে দেখা যায় রুমকির বিয়ে হয়ে গেছে তাহলেতো কিছু করার থাকবে না আর যদি জানা যায় ওর বিয়ে হয়নি শুধু বিয়ে ঠিক হয়েছে তাহলে কি কি করতে হবে।সারা স্বর্ণকিশোরী।ওর কথাগুলো শুনে বেশ সাহস পেলাম।ওরা বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করে।স্বর্ণকিশোরীরা সব সময় কিশোরীদের নানা অধিকার নিয়ে সোচ্চার।গিয়ে দেখা গেল সত্যিই ভাইয়া যা বলেছিল ঠিক তাই হয়েছে।আমার বান্ধবী রুমকির বিয়ে ঠিক হয়েছে আর সে জন্যই ওর বাবা মা ওকে স্কুলে যেতে দেয়নি।আজ বাদে কাল বিয়ে।আমরা ওর বান্ধবী বলে ওর বাবা মা তেমন কিছু বলেনি বরং ওর সাথে দেখা করতে দিয়েছে তবে অন্য কেউ নাকি ওর সাথে এ কয়দিন দেখা করা বা কথা বলার সুযোগ পায়নি।
শোলার বেড়া দেওয়া ঘরের একটা খাটের উপর লাল শাড়ী পরে বসে ছিল আমার বান্ধবী রুমকি।রুমকিকে পুতুলে মত ছোট্টটি মনে হচ্ছিল।আমাদেরকে দেখে সে হাউমাউ করে কেদে ফেললো।ওর কান্না দেখে আমিও কেদে ফেললাম।শুধু কাদলোনা সারা।স্বর্ণকিশোরী সারা কঠোর মনে দমে গেল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনার জন্য।তার পর রুমকির সাথে কথা হলো কবে বিয়ে ছেলে কে বয়স কত কি করে নানা বিষয়ে।ছেলের বয়স ৪২ বছর। আগের স্ত্রী মারা যাওয়ায় নতুন করে বিয়ে করছে।আর আমাদের রুমকির বয়স সবে মাত্র ১৫ বছর।আমি রুমকিকে শান্তনা দিতে পারিনি।যা বলার সারা বলেছে।তার পর আমরা আর বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি সারা আমাকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে।আমি যখন কোন কিছুই ভাবতে পারছিনা তখন সারা বললো চল কাজ আছে এখানে বসে থেকে কিছু করা যাবে না।আমি তখনো জানতাম না সারা ঠিক কি কাজের কথা বলছে।আমাকে নিয়ে ও সোজা ফারিহার সাথে দেখা করতে গেল।ফারিহা ইসলাম তিফলা আরেকজন স্বর্ণকিশোরী।বাল্যবিবাহ রোধ কল্পে সে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে।তিফলা সব কিছু শুনে সাথে সাথে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করলো এবং উপজেলা নিবার্হী অফিসার মুনতাসির সিয়াম সাহেবকে অবহিত করলো।তিনি সাথে সাথে পুলিশকে নির্দেশ দিলেন এই বিয়েটা বন্ধ করতেই হবে।
তার পর পুলিশের জীপে করে স্বর্ণকিশোরী সারা আর স্বর্ণকিশোরী ফারিহা ইসলাম তিফলার সাথে আমিও রওনা হলাম রুমকিদের বাড়িতে।পুলিশ সহ আমরা যখন রুমকির বাড়িতে পৌছালাম তখন বরপক্ষ চলে এসেছে।ম্যাজিষ্ট্রেট গিয়ে সেই বিয়েটা বন্ধ করলো।তিফলা তখন পরিবারের সবাইকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে বললো এবং সচেতন করলো।তখন সবাই তাদের ভুল বুঝতে পারলো।সব থেকে বেশি খুশি হলো আমার বান্ধবী রুমকি।সে তিফলাকে জড়িয়ে ধরে বললো আপু তুমি না থাকলে আমার যে কি হতো। আমার সব স্বপ্ন অপুরণীয় থেকে যেতো।তিফলা ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো আমার চেয়ে তোমার বান্ধবীরাই বেশি করেছে।ওরা যদি আমাকে না জানাতো তাহলে আমিওতো কিছু করতে পারতাম না।এর পর রুমকি পড়াশোনায় মন দিলো।আর কদিন বাদেই আমাদের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবে।আমরা জানি রুমকি সেরা হবে।সেদিন যদি রুমকির বিয়ে হয়ে যেত তাহলে একটি বাল্যবিবাহের কবলে পড়ে রুমকি নামের মেয়েটিকে আমরা হারিয়ে ফেলতাম।
লেখকঃ সুমাইয়া মিফরা
এটি একটি কল্পিত গল্প হলেও এমনই অসংখ্য বাল্যবিবাহের কবলে পড়ে কত কিশোরীর জীবন নষ্ট হচ্ছে তার কোন হিসেব আমাদের হাতে নেই।আর স্বর্ণকিশোরীরা সত্যি সত্যিই প্রতিনিয়ত দেশের নানা প্রান্তে বাল্যবিবাহ রোধ করছে ঠেকিয়ে দিচ্ছে।এমনকি শারমিনতো নিজেই নিজের বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছিল।
বাল্যবিবাহ রোধ করি ,
কৌশর বান্ধব বাংলাদেশ গড়ি”
কবি গুরু রবী ঠাকুরের নামকরণকৃত ঝালকাঠি সদর উপজেলার সনামধন্য উদ্ধোধন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কিশোর কিশোরী সুরক্ষা ক্লাব গঠন করেছে স্বর্ণকিশোর সারা ও তার দল।ওরা চায় সকল কিশোর কিশোরীদের ওরা সচেতন করবে। একটি সুন্দর দেশ গড়ে তোলার জন্য ওরা পণ করেছে।ওদের সেই পণকে সবার সাথে শেয়ার করার দায়িত্বটুকু নিয়েছে ছোটদেরবন্ধু।পৃথিবীর প্রতিটি শিশু কিশোর কিশোরী নিরাপদ হোক এবং তাদের অধিকার ফিরে পাক সেই প্রত্যাশাই ব্যক্ত করছে ছোটদেরবন্ধু।সেই সাথে সবার কাছে আবদার করছে আপনিও লিখুন শিশু কিশোর কিশোরীদের অধিকার নিয়ে।
আরও পড়ুনঃ
- ক্ষুদে লেখক রাশিকের মিস্ট্রি অব দ্য সুপার ন্যাচারাল।
- শিহাব এবং টিটোনের সাহসীকতার গল্প।
- অনন্য যারিফ আকন্দ,গ্রহ নয় যেন একটি নক্ষত্রের নাম।
- বয়স ১৪ তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
- রিয়া দিয়া ক্ষুদে মহাতারকা।
Comments are closed.