হিমু চন্দ্র শীল
তখনকার সময় ইরাকে ভালো পড়াশুনা ও ব্যবসার সুযোগ থাকার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পড়াশুনা ও ব্যবসার জন্য মানুষ ইরাকের রাজধানী বাগদাদে আসত।পড়াশুনার জন্য হযরত আবদুল কাদের জিলানী একদিন বাগদাদ শহরের উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীদের সাথে যাত্রা শুরু করেন।কতিথ ছিল তারা যে পথ দিয়ে যাবে ওই পথে ডাকাতের উৎপাত বেশি ছিল।জিলানী যখন ব্যবসায়ীদের সাথে বাগদাদ যাত্রা শুরু করেন তখন সত্যি সত্যি তাদের দল পথিমধ্যে ডাকাতের কবলে পড়েন।তখন ডাকাত সর্দার জিলানীকে জিজ্ঞাসা করলেন,তোমার সাথে কি আছে?জিলানী এতটুকুও না ঘাবড়িয়ে বললেন,আমার কাছে ৪০টি স্বর্ণ মুদ্রা আছে।আর শার্টের বোতামগুলো দেখিয়ে বললেন,এই সেই স্বর্ণ মুদ্রা।
তখন ডাকাত সর্দার আশ্চার্যন্বিত হয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন হে যুবক!তুমি তো মিথ্যা কথা বলে আমাদের কাছ থেকে স্বর্ণ মুদ্রা লুকাতে পারতে?তখন আবদুল কাদের জিলানী বললেন,মিথ্যা কথা বলতে আমার মা আমাকে নিষেধ করেছেন।এ কথা শুনে ডাকাত সর্দার বললেন,মায়ের আদেশ তুমি এভাবে পালন কর।তখন ডাকাতগুলো অশ্রুসিক্ত নয়নে লুন্ঠিত মাল ফেরত দিয়ে ডাকাতি করা ছেড়ে দিলেন।বালকের সততায় মুগ্ধ হয়ে তারা ফিরে আসলেন সতপথে।করতে লাগলেন সত্যের সন্ধানে যাত্রা।গুণীদের মতে সততা সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা।বলা হয়ে থাকে চরিত্র মানবজীবনের মুকুটস্বরূপ।আর সেই চরিত্র যদি হয় সৎ,তাহলেতো একেবারে সোনায় সোহাগা!সেই সৎ ব্যক্তিটি তখন সবার কাছে হয়ে ওঠে আদর্শ আর শ্রদ্ধার বিমূর্ত এক প্রতীক।সমাজে বা আশেপাশে বাড়তে থাকে তার কদর,ও তার প্রতি শ্রদ্ধা।দিনদিন অফুরন্ত সম্মান আর ভালোবাসায় সমাদৃত হন তিনি।
পৃথিবীতে যারা চির স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন তাদের মধ্যে সম্ভবত একটা জিনিসের খুব মিল আছে;আর সেটা হলো জাগতিক মায়া-মোহ ও লোভ-লালসা না থাকা।তাদের নীতি ছিল সদা সত্য কথা বলা।তারা কোনো দিন মনে লোভ পোষণ করে রাখেনি।বঙ্গবন্ধু থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা,পৃথিবীর যত অবিসংবাদিত নেতা-জ্ঞানীগুণী রয়েছেন তারা সবাই নিজেদের অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন সমাজের আশেপাশের মানুষদের জন্য।মানবতার কান্ডারী হয়ে প্রশস্ত হৃদয়ে সেবা করে গেছেন অসহায়দের।বিলাসী জীবনযাপন ত্যাগ করে বেছে নিয়েছেন সাধারণ জীবনযাপন।সত্যের পক্ষে অনড় থাকতে গিয়ে তাদের সইতে হয়েছে নানান বঞ্চনা,জেল-জুলুম।তবুও তারা তাদের নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দেননি।একচুলও বিচ্যুত হননি তাদের আদর্শ থেকে।যার কারণে আজ তারা মৃত্যুর পরও অমর।এখনো তাদের নামের পাশে তাদের মহান কীর্তিগুলো ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে গৌরবোজ্জ্বল।
সাধারণ মানুষের কাছে তারা অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব।তাদের নাম স্মরণ করলে আপনা আপনি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায়।পৃথিবীতে যদি কেউ মহৎ হতে চায় তাহলে তাকে কিছু ভালো গুণ অর্জন করতে হয়।আর এই ভালো গুণগুলোর মধ্যে প্রথমেই থাকে সততা।তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবীতে যত কঠিন কাজ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হলো সৎ থাকা।লোভ-লালসা ত্যাগ করে সৎ থাকাটা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার।যার কারণে বর্তমান যুগে ওই গুণটি বিরল।অতীতে কিন্তু আমাদের দেশে গুণটি অহরহ দেখা যেতো।যার ফলে আমরা কিছু মহান মানুষ পেয়েছিলাম।তবে সততা এই দেশ থেকে বিলুপ্তির পথে হলেও, কিছু মানুষ যে ভাবেই হোক সততাকে এই দেশে ঠিকিয়ে রাখতে পণ করেছে।তারা এই সততার বীজটি বপণ করার জন্য বেছে নিয়েছে আমাদের আগামী প্রজন্মকে।
একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে যেন সৎ ব্যক্তিত্ব উঠে আসে,ওই জন্য তারা বের করেছে এক অভিনব কৌশল।এই অভিনব কৌশলটি হলো দেশের বিভিন্ন স্কুলের প্রাঙ্গনে স্থাপিত সততা ষ্টোর।আপনি একবার ভেবে দেখুনতো এমন একটা দোকান যেখানে প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা আছে।কিন্তু দোকান পাহারা দেওয়ার কেউ নেই।মানে আপনি যদি কয়েকটা জিনিস নিয়ে সটকে পড়েন!তাহলে কেউ আপনাকে কিছু বলবে না।আপনি কি ওই কাজটা করবেন?করবেন কি করবেননা ওটা আপনার নীতির ওপর।কিন্তু আমাদের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা তাদের নীতির ওপর এতটা অনড় যে তারা প্রত্যেকদিন তাদের সামনে ওই রকম দোকান পেয়েও কোনো জিনিসে বিনামূল্যে হাত দেয় না।
ব্যতিক্রমধর্মী দোকানগুলোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো দোকানে প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী থাকবে,কিন্তু কোনো বিক্রেতা বা সিসি ক্যামেরা থাকবে না।তবে প্রতিটি পণ্যের মূল্য দেয়ালে টানিয়ে রাখা হয়।আর দোকানের কোন এক পাশে থাকে ক্যাশ বাক্স।শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনীয় পণ্যটি নিয়ে ওই ক্যাশ বাক্সে টাকা রাখে।আমাদের দেশের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা তাদের নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন না দিয়ে সততা ষ্টোরের মাধ্যমে দিনদিন তাদের সততার স্বাক্ষর রেখেই যাচ্ছে।যার ফলে ধারুণ এই সততা ষ্টোরের ধারণাটি দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে।ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সততা ষ্টোর দেশের স্কুলগুলোর ক্যাম্পাসে।এই সততা ষ্টোরগুলো মূলত পরিচালিত হয় বিদ্যালয়ের নিজস্ব ফান্ডে।তবে সততা ষ্টোরের উদ্যোগটি স্কুল পরিচালনা কমিটি কিংবা বিভিন্ন সংস্থা নিয়ে থাকে।সততা ষ্টোরে মূলত শিক্ষা সামগ্রীর পাশাপাশি কিছু খাদ্য সামগ্রীও রাখা থাকে।এতে কোন জিনিসের কত মূল্য তা ও লিখা থাকে।ওখান থেকে জিনিসপত্রের মূল্য দেখে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনমতো পণ্যটি কিনে তা খাতায় লিখে,টাকাটা ক্যাশ বাক্সে রেখে দেয়।
‘সততা ষ্টোর’ দেখতে এক সহজ সরল ধারণা হলেও,এর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক আদর্শ।যেটা চর্চার ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ছোট থেকেই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে সততা আর মূল্যবোধের সহিত জীবনযাপন করতে।পাশাপাশি ছাত্র অবস্থায় তাদের মাঝে গড়ে উঠবে নীতি-নৈতিকতা।ভাবতেই অবাক লাগে যে দেশে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লুপাট হয়ে যায় দুর্নীতির মাধ্যমে!যেখানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তি অবৈধ আয়ের মাধ্যমে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যায়,কিংবা লাগেজ ভর্তি টাকা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।সে দেশে পুচকে শিক্ষার্থীরা চোখের সামনে লোভনীয় জিনিস পেয়েও বিনামূল্যে ওই জিনিসে হাত দেয়না।আর ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা সড়িয়ে নেওয়া!এতো আকাশ কুসুম ভাবনা।হোকনা সেটা দশ কিংবা পাঁচ টাকা।বিন্দু বিন্দু সততা থেকেই তো একদিন সিন্ধুর মতো সততা গড়ে উঠবে।
এই সততা ষ্টোরের ফলে দেশে তৈরি হবে আদর্শ এক তরুণ প্রজন্ম।তৈরি হবে বিবেকবান কিছু নাগরিক।যারা নেতৃত্ব দেবে আগামীর বাংলাদেশের।তখন কোন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজে গেলে হতে হবেনা অযথা হয়রানি।উৎকোচ টাকা দাবি করে বসবে না কেউ।রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রের মানুষের ক্ষতি হয় এমন কাজ করতে তারা ন্যায় অন্যায় নিয়ে ভাববে।কোনো মানুষকে হেয় করে কথা বলার আগে নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করবে।আমরা জানি সততা সব সময় সব জায়গায় পুরস্কৃত হয়।’কাঠুরিয়ার সততা’ গল্পে আমরা দেখতে পায় কাঠুরিয়ার সততায় মুগ্ধ হয়ে জলপরি দরিদ্র কাঠুরিয়াকে সোনার কুড়াল দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল।ঠিক তেমনি,
হয়তো ছোটদের এই বিন্দু বিন্দু পরিমাণ সততা একদিন সারা দেশে জালের মতো ছড়িয়ে মহা এক সিন্ধুতে পরিণত হবে।তখন দেশটাই হয়ে উঠবে বিরাট এক সততা ষ্টোর।পুরুস্কার হিসেবে তখন আমরা পাবো এক অসাধারণ বাংলাদেশ।সেই পুচকেদের হাত ধরে দেশ এগিয়ে যাবে দুর্বার গতিতে সমৃদ্ধির পথে।আসলে মাঝে-মধ্যে ছোটদের থেকেও যে অনেক কিছু শেখার থাকে,সেটা সততা ষ্টোরের মাধ্যমেই আমরা দেখতে পাই।
লেখক;হিমু চন্দ্র শীল,শিক্ষার্থী কক্সবাজার সরকারী কলেজ।